একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (১৯)
নতুন ডাক।
শরতের শুভ্র আকাশ ,পেঁজা তুলোর মতো মেঘ কাশ,শিউলির সমারোহ , আগমনী সুর। কেমন চারিদিকে একটা পুজো পুজো গন্ধ। মায়ের আরাধনার জন্য তার আসার অপেক্ষায় ধরাবাসি যেন উদগ্রীব। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের মনে আনন্দের দিন। কিন্তু আজকে যেন শিখার আনন্দ অনেকটাই বিবর্ণতা ধারণ করেছে। প্রতিবছর পঞ্চমী থেকে কলকাতার প্যান্ডেল প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখা ,মজা ,আড্ডা। এবার মনটা একদমই ভালো নেই। আজ যে দিব্যেন্দু নেই ।শিখা ভাবতেই পারে না পাঁচ বছরের সম্পর্ক এভাবে ভেঙে যাবে ।যদিও শিখার দিক থেকেই আপত্তি ।আপত্তি করার কারণ ও আছে। কিন্তু মন থেকে যে স্মৃতিগুলো মুছে ফেলা যায় না ।অতীত বড় বেদনাদায়ক ।বর্তমানে ঝড় তোলে, ভবিষ্যতেও ঝড় তোলে, মনের ভেতরে শুধুই আলোড়িত করে। ভেবেছিল একটা ছোট্ট সংসার হবে ।দিব্যেন্দুর জন্য সারাদিনের অপেক্ষার পর অফিস থেকে ফিরলে সামান্য খুনসুটি আর মধুর ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পাবে তাদের জীবন। কিন্তু কি হলো ভাবতে-ভাবতে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ।পাঁচতলার ফ্ল্যাট থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছে, কত আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে পুজোর মার্কেটিং করতে বেরিয়েছে ।গাড়ির হর্নে জেরবার হবার অবস্থা ।এ বছরটা কি করবে? দিব্যেন্দু কি তাহলে রীতার সঙ্গে ঘর করবে? শেষ পর্যন্ত দিব্যেন্দুর মনে ধরল রীতাকে?কোন দিকে রীতার উপযোগী নয় সে ।যদিও রীতা হতে চায় না শিখা । তাতে দিব্যেন্দু তার মনের আকাশে বিচরণ করুক বা না করুক ।এলোমেলো ভাবনা সারাটা সন্ধ্যে যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে ।হঠাৎই কানে আসে শিখা শিখা শিখা বলতে বলতেই বৌদি (মাধু )ঘরে ঢোকে। এসেই লাইটটা জ্বেলে কি ব্যাপার রে, অন্ধকার করে আছিস কেন? পুজো এসেছে কোথায় একটু হাসি খুশি থাকবি তা নয় ।বললাম চল পুজোর মার্কেটিং করে আসি তাতেও রাজি হলি না।'
বৌদি শিখার কাছে গিয়ে আলতো করে চুলে হাত বোলাতে থাকে। 'চল নিচে চল। তুই তো বললি তোমরা যা নিয়ে আসবে মার্কেটিং করে সেটাই আমার পছন্দ ।চল বৃষ্টি ও পছন্দ করেছে পিসিমণির জন্য ।'
শিখা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে আর একটু মলিন হাসে।
বৌদি বলে " 'শিখা তোর মন খারাপ কেন , আমি জানি। দেখ মা মারা যাবার পর থেকে তোকে আমি মানুষ করেছি ।তুই আমার সন্তানের মতো তাই তোর ভালো মন্দ সমস্ত কিছু তো আমাদেরই দেখতে হবে ।বল জেনে শুনে কেউ এরকম একটা ছেলের সঙ্গে তোর সম্পর্ক মেনে নিতে পারে?'
শিখা বলে ' না বৌদি তোমরা যথার্থই সিদ্ধান্ত নিয়েছ'
বৌদি বলে 'কিন্তু তোকে এরকম অবস্থায় দেখলে তো
আমাদের ভালো লাগে না। পূজা এসেছে কোথায় বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ঘুরবি ।হৈ হৈ করবি আনন্দ আড্ডা..। তা নয় ঘরের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে আছিস।'
শিখার চোখে জল। শিখা বলে 'এতোকাল তো অনেক ঘুরেছি বৌদি। এবার একটু বাড়িতেই থাকি না?'
বৌদি শিখাকে বুকের কাছে টেনে এনে বলে 'জানি তোর কষ্ট হচ্ছে ।কিন্তু কি করবো বল?'
শিখা বলে 'জানি তোমারা আমার ভালোর জন্যই করবে ।মা মারা যাবার পর দুঃখ-কষ্ট সব তোমরা ভুলিয়ে দিয়েছ বৌদিভাই ।তাই তোমাদের সিদ্ধান্তই আমি মাথা পেতে নেব ।আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করো না।'
বৌদি একটু ভরসা পেয়ে বলল ' হ্যাঁরে ,সেদিন বলেছিলাম না তোর একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে ।তাহলে তাদের সঙ্গে কি কথাটা পারব? ছেলেটি ভালো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ওল্ড বালিগঞ্জে বাড়ি ।একটাই ছেলে দেখতে-শুনতেও ভালো।'
শিখা বলে 'বৌদি ভাই একটা কথা বলব, রাখবে?
বৌদি বলে 'যদি দিব্যেন্দুর ব্যাপারে কোন কিছু কথা ভেবে থাকিস ।তাহলে সেটা না বলাই ভালো।'
শিখা বলে ' 'না বৌদি ভাই সেরকম কোন কথা নয়।"
বৌদি হেসে বলে ' তাহলে কি বলবি বল?"
শিখা বলে (আবদারের সুরে )'আমার জন্য সম্বন্ধ দেখো না।'
বৌদি অবাক হয়ে বলে 'সে কিরে? কেন?'
শিখা বলে '"আসলে আমি বিয়ে করতে চাইছি না ।আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছি বৌদি ভাই।
তাই বলছিলাম যে আমার তো এমএ ফাইনাল ইয়ার হয়ে গেল ।এবার বি.এড ভর্তি করে দাও।'
বৌদি বলে (খুশি হয়ে) 'সেটা তো খুব ভালো কথা।'
কিন্তু এটাও ভাবার বিষয় আছে, তোকে সুপাত্রস্থ করতে পারলে তোর দাদা একটু চিন্তা মুক্ত হ'ত। এদিকে বৃষ্টি ও তো বড় হচ্ছে।'
শিখা বলল 'আমি জানি বৌদিভাই। কিন্তু তুমি দাদাকে বললেই হবে।'
বৌদি বলে ' দ্যাখ, ছোট থেকেই তোর সব আবদার মিটিয়েছি।চেষ্টা করব যাতে তোরে এই আশাটা পূর্ণ তা পায়।'
শিখা আনন্দে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে আর বলে 'লাভ ইউ বৌদি ভাই।'
বৌদি বলে 'ঠিক আছে। চলো এবার নীচে চলো।'
ওদিকে বৃষ্টি মা মা মা বলে ডাকছে।
বৌদি বলল 'ওই দেখ বৃষ্টি কেমন ডাকছে?'
শিখা বলল 'তুমি যাও আমি আসছি।'
বৌদি বলে 'ঠিক আছে দেরি করিস না যেন। আর পুরনো সেই সব কথাগুলো নিয়ে কষ্ট পাস না। তুই এতদিনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। প্রত্যেক নারীর উচিত স্বাবলম্বী হওয়া -বলেই বৌদি নিচে চলে যায়।'
শিখার কানে বাজতে লাগল বৌদির কথা। সত্যিই তো ওসব কথা ভেবে ভেবে তার কোন লাভই নেই। তারচেয়ে বরং নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, স্বাবলম্বী হয়ে দিব্যেন্দুকে দেখিয়ে দিতে হবে। তাই দিব্যেন্দুর কথা ভেবে ভেবে সারাটা দিন কাটালে হবে না। জীবনটাই রঙ্গ মঞ্চ।
শিখা এসব কথা ভাবলো বটে কিন্তু মনের কোণে যে মেঘ জমেছে, তা কি করে কাটবে? তবে সে জানে এই মেঘ রোদ্দুর লুকোচুরি খেলায় রোদ্দুর এসেই খুশির আলোতে ভরিয়ে তুলবে।
ওদিকে বৌদি ডাচ্ছে 'শিখা শিখা...?'
বৌদির ডাকে শিখার ভাবনায় ছেদ পড়ে। যাচ্ছি বলেই সে ছুটে যায় নিচে।
নিচে গেলে বৃষ্টি শিখাকে জড়িয়ে ধরে বলে ' পিসিমণি জানো তো, তোমার জন্য আমি একটা খুব সুন্দর ড্রেস চুজ করেছি।'
শিখা বৃষ্টিকে গাল দুটো ধরে আদর করে বলে ' তাই ?তাহলে তো আমার খুব পছন্দ হবে। আমাদের বৃষ্টি সোনা যে পছন্দ করেছে।'
ওদিকে সুরঞ্জন এসে বলছে 'হ্যাঁরে শিখা তুই নাকি বিএড এ ভর্তি হতে চাইছিস?'
শিখার বৌদি বলল 'হ্যাঁ ওকে সেই ব্যবস্থাই করে দাও। আমি চাই শিখার মনে কোনদিন যেন আফসোস থেকে না যায় ,আমাদের জন্য ওর বিএড পড়া হয়নি। আর তাছাড়া ওতো নিজে স্বাবলম্বী হতে চাইছে। এদিকে বি এড টা করে নেবে ।অন্যদিকে নেট ,সেটের জন্য ও চেষ্টা করতে থাকবে। ওটাই যথার্থ ডিসিশন।'
সুরঞ্জন বলে কিন্তু..? শিখার বৌদি কথাটা শেষ করতে দেয় না বলে কোন কিন্তু নয়। আজ বাবা-মা বেঁচে থাকলে শিখার মতামতের গুরুত্ব দিত। আর তাছাড়া কেউ যেন বলতে না পারে ওর বৌদি জন্যই এটা হয়নি।'
শিখা বলে 'না বৌদি ভাই সমাজ সংসার কি বলল তাতে কিছু এসে যায় না। আমি জানি আমার জীবনে আমার দাদা বৌদির গুরুত্ব কতটা? ছোট থেকে অভাব আমাকে বুঝতে দাও নি। সব সময় আমার চাহিদাগুলো পূরণ করার চেষ্টা করেছ। দাদাকে দেখেছি ওভারটাইম করতে ।তবে জানি দাদার কিছুটা অসুবিধে হবে ।তবে দেখো আমি ঠিক দাদার পাশে দাঁড়াবো একদিন।
শিখার দাদা শিখাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে আমরা তো এটাই চাই বোন ।তুই যাতে সুখী হোস। প্রথম প্রথম তোর বৌদির প্রতি আমার একটু সন্দেহ ছিল। আজ অকপটে স্বীকার করছি তোর বৌদি না থাকলে সত্যিই হয়তো আমি সব চাহিদা পূরণ করতে পারতাম না। কখনো কখনো তোর কিছু কিছু আবদার পূরণ করতে গিয়ে ভাবতাম এতটা গুরুত্ব না দিলেই হয় কিন্তু তোর বৌদি বরাবর আমাকে বুঝিয়ে এসেছে মা-বাবা নেই আমরাই ওর মা-বাবা ওর মনে যেন কোনো খেদ না জন্মায়।'
শিখা বলে ' আমি জানি দাদা ।তুমি এবং বৌদি আমার জন্য কি কি করেছ ?কাউকে নতুন করে আমাকে বলতে হবে না ।তাই আমিও চাই একটি ছেলের মত আমি তোমার সংসারের হাল ধরতে। বৃষ্টির দায়িত্ব নিতে ।তোমরা সেই আশীর্বাদ করো। তোমরা আমার পাশে থাকলে ,আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। দাদা ,তাছাড়া আমার জীবনে ঘটে যাওয়া দিনগুলোর জন্য হয়তো আমার মনে কষ্ট আছে ।কিন্তু আমি জানি তোমরা আমাকে সঠিক পথে চালিত করেছ।'
দাদা বৌদি দুজনাই কাছে এসে শিখাকে বুকের কাছে টেনে নেয় আর বলে আমাদেরও বিশ্বাস আছে তোমার প্রতি। তুমি পারবে ।আমরা তোমার পাশে আছি।'
শেখার জীবন শুরু হলো নতুন করে নতুন ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ।পরের দিন শরতের রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ তাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে কোথায় মেঘ, কোথায় বৃষ্টি ?এসো আমরা সোনা রোদ হয়ে ভাসি। শিখাও যেনও তার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে চায় কোন সূদুরালোকে। আজ যেন সকালটা আলো আলোময়।তাই গেয়ে ওঠে শিখা 'ও আকাশ সোনা সোনা, এ মাটি সবুজ সবুজ, রঙের ছোঁয়ায় হৃদয় রেঙেছে ,আলোর জোয়ারে খুশির বাঁধ ভেঙেছে।'
দাদা বৌদিদি নূতন করে শিখার কন্ঠে গান শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর ভাবে অমানিশার অন্ধকার বোধহয় কাটলো।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৯ ক্রমশ