উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৩৬
ভয়েস বিভ্রাট
মমতা রায়চৌধুরী
কল্যান সেমিনার শেষ করে কৃষ্ণনগর স্টেশনে যখন আসলো তখন মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে চারিদিকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। এমন অবস্থায় অটো থেকে নামতে নামতে কিছুটা ভিজেও গেল। ভাবছে তাই তো গলার এই অবস্থা ।এর মধ্যে যদি আবার ঠান্ডাতে কিছু একটা হয় তাহলে তো দারুণ মুশকিল হয়ে যাবে।
যথারীতি ট্রেন ঢুকে গেল। কল্যান ট্রেনে গিয়ে বসলো।
নির্দিষ্ট টাইম এ ট্রেন ছেড়ে দিল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আজকে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে পারবে না মনে হচ্ছে কৃষ্ঞনগরেই ৬. ৪০
অথচ ডাক্তার না দেখালেও নয়। দেখা যাক 'ডাক্তারবাবু তো ৯টা পর্যন্ত থাকবেন বলেছেন?'
মাথাটা ভেজেনি এই রক্ষে। প্যান্টের নিচের অংশ ভিজেছে ।হাতের অংশটুকুও ভিজেছে। ট্রেনে
বসে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। ট্রেনে বসে হাজারো কথা মনে পড়তে লাগলো। মনে পড়ল অনিন্দ্যর কথা। কল্যাণদের চারজনের একটা ভালো বন্ধুত্ব ছিল। তাদের মধ্যে শুধুমাত্র অনিন্দ্য তখন প্রেম করতো। অনিন্দ্য হচ্ছে ওদের প্রেমের দীক্ষাগুরু। অনিন্দ্য আর মনীষা যখন চুটিয়ে প্রেম করছে ।তখন কল্যাণরা দূতের কাজ করতো। সম্ভবত ওদের লায়লা মজনুর প্রেম দেখেই কল্যাণের ভেতরেও একটা প্রেম প্রেম ভাব এসেছিলো। তারই ফলশ্রুতি বোধহয় প্রভা।
আজ আবার কেন ঘুরে ফিরে আসছে প্রভার কথা। এ যেন বৃষ্টি হলেই কল্যাণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে এন্টেনার মত। কোথায় অনিন্দ্য মনীষার গল্প করছিল সেখানে এসে পাতা জুড়ে নিল কল্যান প্রভার গল্প।
' হ্যাঁ, একদিন এসে হঠাৎ অনিন্দ্য বলল
'যাই বলিস ভাই ফাইনাল পরীক্ষার হয়ে গেলেই আমরা দুজন পালাচ্ছি।'
কল্যান তো অবাক হয়ে গেল 'বলে কি?
পালাচ্ছি মানে?
তুই তো এখনো নিজের পায়ে দাঁড়ালি না মনীষাকে কি খাওয়াবি?
পরে কিন্তু প্রেম জানলা দিয়ে পালাবে।'
ভুরু কুঁচকে অনিন্দ্য বলেছিল শত্তুর না হলে তো কেউ এরকম কথা বলে ।না তুই আমার নাকি আসল বন্ধু। প্রিয় বন্ধু ।কোথায় আমাকে উৎসাহ দিবি ।সেসব নয়।'
'দেখ ভাই আমি কিন্তু বাস্তবটাই বললাম। আমি প্রকৃত বন্ধু বলে তোর বাস্তব অবস্থাটাকে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি ।এবার তুই যেটা ভালো বুঝিস?'
তারপর অনিন্দ্য কি একটা ভাবল কিছুক্ষন তারপর বললো' না কথাটা তুই ঠিকই বলেছিস কিন্তু আমার তো একটা সমস্যা হয়ে যাচ্ছে?'
'কিসের সমস্যা?'
'আরে মনীষাকে নিয়ে। ও তো এখনই বলছে বিয়ে করতে হবে,।'
'মানেটা কি? খেপেছে নাকি?'
তখন কল্যাণ বলল ' বুঝতে পারছি ।প্রেমের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস…
বলেই হাসতে শুরু করলো।
'তুই হাসছিস আমি মরমে মরমে মরছি।'
আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে বল কি বলবো তোকে?'
'শোন,আমার আর পড়াশোনা হবে না।'
'ঠিক আছে তাহলে কি করতে চাইছিস?'
'আমি আমেদাবাদ চলে যাব।'
'কার ভরসায়?'
'আরে হারুদের একটা গদি আছে। ও বলেছিল ওখানে ব্যবস্থা করে দেবে একটা চাকরি।'
বেশ বোদ্বার মত মাথা নেড়ে কল্যান বলল' তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেল।'
কিন্তু কি ট্রাজিক চরিত্র হয়ে গেল অনিন্দ্য।
এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই মনীষার বাবা ট্রানস্ফার নিয়ে চলে গেল দূরে সপরিবারে।
মনের দুঃখে অনিন্দ্য কিছুদিন দাড়ি রাখল, সাই গোলের রেকর্ড শুনল। তারপর এ ম, পরীক্ষা এসে গেল ।পড়ার চাপে সবই ঠিকঠাক হয়ে
গেল। মজা করে বলেছিল কল্যান হারুকে
অনিন্দ্য আর মনীষার প্রেমের কাহিনী লাস্ট চ্যাপ্টার অনিন্দ্যের দাড়ি রাখা ।আমার মনে হয় আমাদের এই বাকি তিনজনেরো দাড়ি রাখা উচিত ছিল কারণ ওর প্রেমটা তাদের বাকি তিন জনেরও প্রেম।'
হারু তখন মজা করে বলেছিল 'তুইতো বাবা প্রভার সঙ্গে জড়িয়ে গেছিস ।তোর তো জীবনে বসন্ত এসেগেছে কিন্তু আমরা দেখ কি অভাগা আমাদের না জুটলো কোন সুন্দরী গোলাপ।
না নিতে পারলাম তার কোন ঘ্রাণ।'
ট্রেনে যেতে যেতে এইসব কথাই মনে পড়ছিল কিন্তু অনিন্দর মত কল্যাণের প্রেমের পরিসমাপ্তি ঘটল একটা প্রহেলিকার মধ্যে দিয়ে। প্রভার থেকে আর কোনো উত্তর কক্ষনো আশা করেনি ।প্রভা কিভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল অথচ কল্যাণ তো প্রভাকে মনেপ্রাণে ভালবেসেছিল ।দুরন্ত উচ্ছল নদী যেন ছিল ।কখনো মনে হয়েছে
ঝরনা ।ঝরনার সঙ্গে হারিয়ে যেতে কল্যাণের কোন আপত্তি ছিল না।
অথচ…. শুধুই অন্তহীন জিজ্ঞাসা রয়ে গেল।'
এরই মধ্যে ট্রেন নির্দিষ্ট স্টেশনে এসে পড়ল।
ফোনটা বার করতে দেখলএরমধ্যেতে কটা মিসকল হয়ে পড়ে রয়েছে। এতটাই ভাবনায় মশগুল ছিল যে সেটা খেয়াল করে উঠতে পারেনি।
ফোনটা খুলে দেখল শিখার বেশ কয়েকটা মিসকল হয়ে যাচ্ছে।
কল্যাণের উচিত ছিল শিখাকে ফোনটা করে দেয়া যে সে ট্রেনে উঠে পড়েছে।
কি করে ইরেস্পন্সাইবেল হলো?
নিজেকে নিজের প্রতি খুব বিরক্ত লাগলো।
তারপর একটা ফোন করলো।
ফোনের রিং হতেই শিখা ফোনটা রিসিভ করে বলল'কি ব্যাপার বলতো?'
কল্যান মনে মনে ভাবল এই শুরু হল অধিকারবোধ এটা তো হতেই হবে তারপর নিজেকে ঠিক রেখে বলল 'সরি এক্সট্রিমলি সরি ডিয়ার।'
'না না সরি কেন বলছো?'
'একবার ও মনে হয়নি চিন্তা হতে পারে?'
'আরে হ্যাঁ ,ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন করবো শোনো না এত বৃষ্টি তারপর??'
'তারপর ,তারপর কি হয়েছে?'
'আরে সেরকম কিছু নয়।'
'ভিজে গেছ?'
"একটু ভিজেছি।'
গলাটা যেই দেখলে একটু আওয়াজ বেরোচ্ছে অমনি বৃষ্টিতে ভিজলে?'
'কিছু করার ছিল না গো অটো থেকে নামতে নামতে যেটুকু ভিজেছি।'
সকালে যখন বেরিয়েছি তখন ওয়েদারটা তো ভালই ছিল ।বোঝা গেছে কি বৃষ্টি হবে বল?'
'ঠিক আছে আর তোমাকে কোন কিছু বলতে হবে না।'
'এখন বল কতদুর আছো?'
'আর একটা স্টেশন।তার পরেই নেমে যাব।'
'ঠিক আছে ডাক্তারের এপারমেন্ট নিয়েছো তো?'
'নিয়েছি কিন্তু ডাক্তার থাকবেন কিনা কে জানে?'
'যদিও নটাএখনো বাজে নি।'
'ঠিক আছে ।দেখো কি হয়।
সাবধানে এসো।'
'ওকে'
বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তোমাকে ফোন করবো।'
শিখা প্রসন্নতায় একগাল হেসে উঠলো।
কথা বলতে বলতেই স্টেশন এসে গেল। তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল কল্যান। কাঁকিনাড়া থেকে খুব বেশি সময় লাগে না ডাক্তার বাবুর চেম্বারে যেতে। এখনো দশ মিনিট বাকি আছে 9:00 বাজতে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল। হাঁপাতে হাঁপাতে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে এসে দেখল ডাক্তার মুখার্জির চেম্বারে ভীষণ ভিড়। যদিও কল্যান সাক্ষাৎ লগ্ন আগেই স্থির করে এসেছে ।তবুও প্রায় ১৫মিনিট হলো স্লিপ জমা দিয়ে বসে আছে কল্যাণএর এখনো ডাকআসেনি। এদিকে সেই বৃষ্টিতে ভেজা চ্যাট চ্যাটে ভাব ভালো লাগছে না বসে থাকতে ডাক্তার বাবুর চেম্বারে অনেকগুলো উইলি ম্যাগাজিন রয়েছে ।সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। হঠাৎ ম্যাগাজিনে যখন নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই 'কল্যাণ চৌধুরী কে আছেন ?এখানে ডক্টর কল্যাণ চৌধুরী?'
কল্যান বলল' আমি ।আমি ডক্টর কল্যাণ চৌধুরী।"
'আপনার ডাক এসেছে আপনি চেম্বার এ যান।'
পত্রিকাটি নামিয়ে রেখে নিজের ব্রিফকেস টি সঙ্গে নিয়ে উঠে দাঁড়াল কল্যাণ চৌধুরী।
বাবা প্রায় ঘড়ি দেখে আধ ঘন্টার মতো দেরী করিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার বাবু।
চেম্বারে ঢুকে হেসে নমস্কার করল চৌধুরী।
ডাক্তারবাবু নিজের ডান হাতটা কপালে ছুইয়ে বললেন 'বসুন 'চেয়ারটা দেখিয়ে।
"আচ্ছা বলুন আপনার কি সমস্যা?
কি কি অসুবিধা বোধ করছেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আপনার,?. একটু জোর করে হাসি এনে ডাক্তারবাবু আরো বললেন 'নট টু ওয়ারি'! ডোন্ট বি সো ডিপ্রেসড।'
কল্যাণ আমতা আমতা করে বলল আমার কি ডিফিকাল্ট কিছু হয়েছে?
'ফেটাল তো কিছু হয়নি আপনার?'
তবে আপনার প্রফেশনটা একটু অসুবিধে হতে পারে?
তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই এখন তো অনেক ভালো ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। মানে অপারেশনের ব্যবস্থা আছে। বিদেশ থেকে যদি করাতে চান করাতে পারেন আপনাদের তো দেশ বিদেশের যাতায়াত আছে বিভিন্ন সেমিনার উপলক্ষে।
এবার একটু ভয় পেয়ে কল্যান বলল' ডাক্তারবাবু আপনি কি বলছেন আমি কি চিরকালের মতো তাহলে আমার কন্ঠস্বর হারাবো?'
আজকাল ভয়েস বক্সটা রিপ্লেস করা কিছুই না। এতে আপনার অনেক কাজ চলে যাবে। সব কথাই বলতে পারবেন ।এটা হচ্ছে উইথ এ সিম্পল এন্ড সাইন্টিফিক ফলস ভয়েস।'
আপনি স্মকিং করেন?'
কল্যান বলল' হ্যাঁ করি।'
মনে রাখবেন' স্মোকিং ইজ ডেডলি ফর ইউ'।
একটা কড আপনার একেবারেই গেছে এবং অন্যটাও প্রায় অলমোস্ট গন।'
ধোয়ায় ধোয়ায় গলাটার বারোটা বাজিয়ে দিবেন না আর।'
'ডাক্তারবাবু আমি কতদিন পর্যন্ত কথা বলতে পারব না?'
কেবল সপ্তাহে সপ্তাহে সাত দিন গান্ধীজী সপ্তাহে একদিন মৌনব্রত পালন করতেন জানেন তো আপনি ওরকমই করুন তিন সপ্তাহ ঘরে থাকুন চুপচাপ । কমপ্লিটলি গলাটার রেস্ট দিন।'
'তাহলে কি বলছেন আমি কি আর কথা বলতেই পারবোনা। ওটা একেবারেই চলে গেল । আ পার্মানেন্ট লস?'
'কি মুশকিল আমি কি তাই বললাম নাকি ।তিন সপ্তাহ আপনাকে কথা বলতে বারণ করা হলো এরপর অপারেশন টা করিয়ে নেবেন ।কেন অত অরিড হচ্ছেন।'
এই মুহূর্তে কিছু ওষুধ দেবেন না?
হ্যাঁ মাক্রাবিন আর ভিটামিন ইনজেকশন দুটো তিন সপ্তাহ এবং স্টেরয়েড অ্যান্টিবায়োটিক টা 10 দিন ঠিক যে ভাবে লিখে দেয়া হয়েছে সেই ভাবে চালিয়ে যান আর ওই যে বললাম ভয়েসকে কমপ্লিটলি রেস্ট দিন।
তিন সপ্তাহ পর আবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে।'
কল্যান বলল' থ্যাংক ইউ ডাক্তার'।
এরপর ডাক্তারবাবু আচ্ছা বলে টেবিলের উপরে রাখা ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে বলেন
' ওয়েলকাম ।নেক্সট।'
ডাক্তারবাবুর ওখান থেকে বেরিয়ে এবার কল্যাণ ভাবল সামনে রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার নিয়ে চলে যেতে হবে বাড়িতে। স্টুডেন্টের দিকে যেতে যেতে ডাক্তারবাবু কতটা অর্থ পিচাশ সেটাই মনে মনে ভাবার চেষ্টা করছিল ভিজিট দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টি বাজিয়ে দিলন আর একটা কথাও শুনতে রাজি হলেন না ডাক্তার বাবু।
বাপরে কি প্রফেশনাল।
তারপর নিজের ভয়েসটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে লাগল এর মধ্যে যদি ঠিক না হয় পরের মাসেই আছে আবার আর একটা সেমিনার। এছাড়া কলেজে ক্লাস রয়েছে।কি হবে কে জানে জীবনে টানাপোড়েন তো রয়েছেই এখন চলে ভয়েজের টানাপোড়েন দেখা যাক ঈশ্বর কি করেন। কতদিন ভয়েস বিভ্রাটে থাকতে হয় কি যেন?