শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৭২)
শামীমা আহমেদ
সারাদিন ফ্যাক্টরির কাজ তদারকির দ্বায়িত্ব শেষ করে,দিনশেষে গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে, শিহাবের উত্তরায় ফিরতে রাত প্রায় দশটা হয়ে গেলো। পথিমধ্যে,চন্দ্রা, জিরাবো,আশুলিয়া, আবদুল্লাপুরের ভয়ানক যানজটে প্রায় একঘন্টা বসে থাকা। যদিও চাইলে আশপাশ দিয়ে বাইক চালিয়ে বেরিয়ে আসা যেতো।কিন্তু শিহাবেরতো ঘরে ফেরার অত তাড়া নেই।কেউতো আর ঘরে তার জন্য অপেক্ষায় নেই।বরং বাইকে বসে উদাস হয়ে আকাশের চাঁদ দেখে কয়েক স্টিক টেনে নেয়া যায়। আর এর সাথে কয়েককাপ চা, কফি চালান দেয়া হয় ভিতরে ভ্রাম্যমাণ চা, কফি বিক্রেতাদের কাছ থেকে।
যানজট ছাড়তেই শিহাব বাইকের স্পীড বাড়িয়ে সময়টা পুষিয়ে নিলো।
শিহাব বাসার গেটে এসে হর্ণ দিতেই কেয়ারটেকার বিল্লাল গেট খুলে৷ দিলো। বিল্লালের ভয়ার্ত দৃষ্টি! শিহাবের অনুমতি ছাড়া তার বাসায় অতিথি ঢুকেছে। কিভাবে তা ছারকে জানাবে। শিহাব বাইক পার্ক করে হেলমেট খুলতেই বিল্লাল তার কাছে এসে বললো, ছার মাফ কইরা দিয়েন। আপনার অনুমতি ছাড়া একটা কাজ কইরা ফেলছি ছার।
কি করেছো বিল্লাল? শিহাব বেশ নরম সুরেই জানতে চাইলো।
তাই কি এত কল দিচ্ছিলে সকালে?
জ্বী ছার।
তা কি করেছো?
ছার আপনি ঘরে গেলেই দেখতে পারবেন।
ক্লান্ত শিহাব আর কথা বাড়ালো না। বাইকের চাবি হাতে নিয়ে ঘিরের চাবি চাইতেই বিল্লাল বললো, ঘরে অতিথি আছে, তার কাছেই চাবি দিয়া গেছে বুয়া।
এবার শিহাবের মাঝে একটু ভাবনা এলো,,কে হতে পারে যে আমার অনুমতি ছাড়াই আমার ফ্ল্যাটে ঢুকে যায়। শায়লা নয় তো? তবে কি সেদিন এখানে আসাতে বাসায় কোন ঝামেলা হয়েছে? সেকি তবে বাসা থেজে রাগ করে চলে এলো হাবের কৌতুহল বেড়ে গেলো।সে দ্রুত লিফটের দিকে পা বাড়ালো। শস্যলা কোন বিপদ হলো! লিফট উপরে উঠতেই শিহাব এক ঝটকায় বেরিয়ে দরজার কলিং বেলে আঙুল দিয়ে বেশ কয়েকবার বিরতি ছাড়াই পুশ করলো।
রিশতিনাতো এতটাক্ষণ ধরে, সেই সকাল দুপুর রাত কাটিয়ে শিহাবের ফেরার অপেক্ষাতেই উন্মুখ হয়ে ছিল। অলস ভঙ্গিতে টিভির সাউন্ড অফ করে চালিয়ে রেখে সময় পার করছিল।কলিং বেল শুনেই চমকে উঠে ঘর থেকে রক দৌড়ে দরজার কাছে এলো।
দরজা খিলতেই দেখলো শিহাব দাঁড়িয়ে!
অপরপ্রান্তে শিহাবের জন্য রিশতিনা বড় একটা বিস্ময় হয়ে এলো। দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে! দরজার এপাশ আর ওপাশে।শিহাবের পা যেন আর ঘরের দিকে চলছিলই না। শিহাবকে কাছে পেয়ে রিশতিনার চোখ জলে ভরে উঠলো। মন চাইছে এখুনি শিহাবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।যেন খুব ইচ্ছা করছে শিহাব এখুনি যেন হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে নিক।কত জনমের চাওয়া।কত যুগের তৃষ্ণা।
শিহাব যেন এর কিছুই অনুভব করছে না।তার দুচোখ শুধু শায়লাকে খুঁজছে। সামনের মানুষটা অদৃশ্য হয়ে রইল। রিশতিনা বুঝতে পারছে শিহাবের কাছে সে একেবারেই অপ্রত্যাশিত হয়েছে।তাইতো সে এমন বরফ
কঠিন হয়ে আছে। এই বরফকে গলাতে হবে। শিহাবের ভেতরে তার জন্য ভালবাসার জলধারা বহাতে হবে আর এর জন্য শিহাবের শত অপমান সে সহ্য করবে। শিহাবের মন জয় করে আবার আগের সেই আবেগ অনুভূতি অনুভব ফিরিয়ে আনতে হবে।
রিশতিনা হাত বাড়িয়ে শিহাবের হাত ধরলো।শিহাবের ভেতর তখনো কোন চেতনা ফিরে আসেনি। তার চোখ রিশতিনার দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে আছে। রিশতিনা এক টানে শিহাবকে ঘরে নিয়ে এলো। দরজা লাগিয়ে শিহাবকে বেড রুমে নিয়ে গেলো।বিছানায় বসিয়ে দুই হাত ধরে জানতে চাইলো,কেমন আছো চাঁদ? ভালোবাসার দিনগুলিতে রিশতিনা শিহাবকে চাঁদ নাম ডাকতো। শিহাব কি সব হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে শুধু শায়লার মুখটিই ভাবছে।
শিহাবের নীরবতায় রিশতিনা বললো,শিহাব তুমি কি ভুলে গেছো, তুমি আমায় কি নামে ডাকতে? আবার সেই নামে ডাকো চাঁদ।আবার সেই নামটিতে ডাকো।বলেই রিশতিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। শিহাবের বুকে মাথা রাখলো।এবার যেন একটু স্বাভাবিকে এলো। একটা মেয়ে তার সামনে তার জন্য কাঁদছে, তার বুকে আছড়ে পড়ছে আর সে এমন স্থির হয়ে বসে আছে? শিহাব কথা বলে উঠলো, রিশতিনা তুমি কেঁদোনা। বলেই রিশতিনার মুখটা দুই হাতে তুলে ধরলো।
রিশতিনা তখনো চোখ বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেই যাচ্ছে।আর বিড়বিড় করে বলছে
শিহাব তুমি আমাকে ক্ষমা করো। সব ভুলে আমায় গ্রহণ করো। আমি একেবারে তোমার কাছে চলে এসেছি।আমার পরিবারের
সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছি।
শিহাব বুঝতে পারছে না এখন সে কি করবে বা তার কি করা উচিত? শায়লাকে সে কি বলবে? শায়লা যে কোন ভাবেই তার কাছে আসবে।রিশতিনা স্থির হলো।কান্না থামালো।
রিশতিনা বললো, তুমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি। আজ জিগাতলা থেকে মা ভাবী অনেক খাবের পাঠিয়েছে। আমি আভেনে গরম করছি।শিহাবের তখন যেন আজ সকালের সব মনে পড়লো।কেন বিল্লাল এত ফোন দিচ্ছিল তাকে।সে বুঝতে পারছে আজ আর রিশতিনাকে ফেরানোর কোন পথ কি সে পাবে?সে তার স্ত্রীর অধিকার নিয়ে তার কাছে এসেছে।কোন আইন বা ধর্মের দোহাই আজ আর কাজ করবে না। কিন্তু শায়লা যে তার মন প্রাণের অনেকখানি জুড়ে আছে।
রিশতিনা শিহাবের হাত ধরে ওয়াশরুমের দরজার কাছে নিয়ে গেলো।এওতটা পথ বাইক চালিয়ে সারাদিনের শত ঝামেলায় ক্লান শ্রান্ত শিহাব টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
রিশতিনা কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো।ফ্রিজ খুলে খাবার বক্স খুলে দেখে নিচ্ছিল কি কি আছে। দুটো প্লেট হাতে নিয়ে ডাইনিং এ এলো। রিশতিনা বুঝিতে এভাবেই শিহাব ক্লান্ত ঘরে ফেরে আর একাই সব কিছু করে।শিহাবের জন্য তার মনটা হু হু করে উঠলো।
হঠাৎই শিহাবের মোবাইল বেজে উঠলো। রিশতিনা ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো,রাত এগারোটা। এত রাতে কে কল করলো।রিশতিনা এগিয়ে এলো।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো,মায়া নাম ভেসে উঠেছে আর স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে, টানা টানা চোখে মায়াবতী মুখের একটি মেয়ের ছবি যার কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ।রিশতিনার কেন যেন ঐ টিপটাকে একেবারেই সহ্য হলো না।
চলবে.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much