উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৩৫
মিষ্টি একটা গন্ধ
মমতা রায়চৌধুরী
কল্যাণ এলার্ম দিয়ে রেখেছিল যথাসময়ে ঘুম ভাঙলো কিন্তু শরীর মন এতটাই ক্লান্ত ,উঠতে ইচ্ছে করছিল না । তবুও উঠতে তো হবেই। সকালে বিছানায় উঠে বসে দেখছে গলার অবস্থা আরো খারাপ। আজকে কি করে লেকচার টা দেবে ,গভীর সমস্যায় পড়ল।
এরমধ্যে কলিং বেলের আওয়াজ শুরু হলো। এবার পুরোপুরি না উঠে আর পারল না কল্যাণ। নিশ্চয় মাসি এসেছে। আবার কলিংবেল বাজছে।
আড়মোড়া কেটে কল্যান আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোল, তারপর দরজা খুললো।
সত্যি ,সত্যি মাসি এসেছে।
মাসি বলল 'অনেক রাত্রে ঘুমিয়েছো নাকি?'
কল্যান একটা মস্ত বড় করে হাই তুলল। মাসির সাথে ইশারায় কথা বলল। কল্যাণ ইশারায় বুঝিয়ে দিল গারগিল করার জল দেবার জন্য।
মাসি যথারীতি গিয়ে আগে গারগিল করার জল দিল ।তারপর চা বানালো। তারপর আনুষঙ্গিক অন্যান্য কাজে হাত দিল।
মাসি জিজ্ঞেস করল 'কি খেয়ে যাবে
আজকে ?কখন বেরোবে?'
কল্যাণ যা মুখে বলল বুঝানো অসুবিধে হল, তার থেকে আবার কিছু ইশারায় বুঝিয়ে দিল।
মাসি শুধু বললো 'ভাত খাবে তো?'
কল্যাণ মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি প্রকাশ করল।
মাসি বললো 'তাহলে কি খাবে?'
'তরকা বানাবো? রুটি খাবে তো?'
কল্যাণ মাথা নাড়লো।
এরমধ্যে কল্যাণের আবার ফোন বাজছে।
ফোনের আর্তনাদে ফোনটা রিসিভ করল বলল¡' হ্যালো'। গরগর আওয়াজ হলো।
'আমি শিখা বলছি।'
'হ্যাঁ বলো। 'আবার গরগর আওয়াজ।
'তোমার গলার অবস্থা তো বুঝতেই পারছি ...।'
'যাচ্ছেতাই।'.
'কিন্তু কি করে তুমি লেকচার দেবে?'
'সেটাই তো ভাবছি।
উপায়ও নেই।'
'ডাক্তার দেখাবে না?'
'ফিরে এসে দেখাবো।'
'ঠিক আছে টেক কেয়ার।'
'তুমিও নিজের যত্ন নিও।'
'কখন বেরোবে?'
'এই তো দশটায়।'
''ok'
'ফিরে আমাকে ফোন ক'রো।'
''ok'
ফোনটা কেটে দিলো। সারারাতের অবসন্ন ক্লান্ত মনে একটা বিষণ্ণতার ছাপ ফেলেছিল প্রভা। হঠাৎ করে শিখার ফোনটা আসাতে , সঙ্গে যেন একটা মিষ্টি গন্ধ হৃদয় বীণার চারিদিকে ভরে গেল। মন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল।
মাসি আর একবার গারগিল করার জল দিয়ে গেল। কল্যাণ ইশারায় মাসির কাছে আর এক কাপ চায়ের বায়না ধরল।
মাসি একগাল হেসে বলল 'দিচ্ছি।'
কল্যাণ একটা বাংলা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিল। হঠাৎই চোখ ফ্রেমবন্দি হয়ে যায় সম্পাদকীয় কলমটাতে। অন্যমনে পাতা উল্টাতে উল্টাতে এই সম্পাদকীয় কলমটা পড়ে বলল
'বাহ ,বেশ ভালো লিখেছেন
তো ?সেন্সেবল লেখা। যথেষ্ট সংযত আর ঝরঝরে ।সারও আছে ,তাতে আবার ধারও আছে।
মাসি এসে চায়ের কাপটা আবার ধরিয়ে দিল। চা খেতে খেতে লেখালেখির পাতার কবিতাংশে কবি দেবব্রত সরকার, কবি স্বপ্নীল ভট্টাচার্য, কবি রেখা চৌধুরী র কলমে চোখ নিবদ্ধ হয়ে গেল।
বসন্ত সংখ্যায় কবি দেবব্রত সরকার এ কবিতাটা বেশ সুন্দর
'বসন্ত হাঁত রাই'
"তোমার চোখে রাঙানো ফুল আদরে আদখান,
আমার চোখে লাগলো ছোঁয়া রুপেরই আখ্যান।
তোমার চোখে কামনার ডাকে চুপ সাগরে ডুব,
আমার বুকে কৌতূহলের প্রশ্ন ওঠে খুব।
তোমার চুলে উঠল ভেসে আমার হিয়া চোখ,
তাকিয়ে আছি দেখছে দেখ ইচ্ছে ছবি লোক।
তোমার গালে চুপ্টি করে ঠোঁট চলে যায় একা,
পায়ের থেকে কপাল জুড়ে চুমুতে আধ ক্ষ্যাপা।
নরম সুরে শরীর ভিজে হারিয়ে গেছে হৃদি,
শরীর এত নরম হলো জানেন নিরবিধি।
কৃষ্ণচূড়ায় রাধার খোঁপা ঢেকেছেএকলাই,
আবির ফুলে মেখেছে মন বসন্ত হাঁতরাই।"
মন ছুঁয়ে গেল কবিতাখানি। আর দেখার সময় নেই এবার ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে হবে ।তারপর বেরোনো আছে খেয়ে দেয়ে।
ডাইনিং টেবিলে বসে কল্যাণ প্লেটে চামচের আওয়াজ করতে লাগল। মাসি হাসতে হাসতে এসে বলল' একদম বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছ।'
ডিস বাজাতে হবে না । এই নাও তোমার খাবার।
ইশারায় বললো 'এতগুলো রুটি?'
মাসি বলল 'এতগুলো! দুটো রুটি খাবে না?
না, না খেয়ে নাও।'
ইশারায় মাসিকে বোঝাতে চাইল কিছু একটা।
মাসি বললো'একটু দাঁড়াও রান্নাঘর থেকে ছুটে নিয়ে আসছি,কাঁচা লঙ্কা ,পেঁয়াজ।'
যতদূর সম্ভব কম কথা বলছে গলার উপর খুব প্রেসার পরছে। তরকা টা দারুন বানিয়েছে মাসি।
হাতের ইশারায় বাহবা দিল মাসিকে।
মাসিও খুব খুশি হলো। আর বলল
'তোমার ভালো লাগলে আমারও ভালো লাগে। রান্না করেও সুখ।'
কল্যান বলল 'আমি সিরিয়াসলি বলছি মাসি তুমি ছোটখাটো একটা দোকান খুলতে পারো, মানে রেস্টুরেন্ট।'
মাসি তো একেবারে প্রসন্নতায় একগাল হেসে বলল 'আমাদের অত টাকা পয়সা কোথায় বাবা।'
কল্যান বলল'-হ্যাঁ আরো কিছু তোমাকে অবশ্য আধুনিক অনেক রান্না শিখতে হবে।
তবে এটা অবশ্য করতে পারো যদি শুধু ট্রাডিশনাল রান্নায় থাক আবদ্ধ সেটাও করতে পারো।'
ওটা আমার স্বপ্ন হয়েই থাকবে বাবা। মাসি এঁটো বাসন গোছাতে গোছাতে বলল '
'আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমরা কি আর সেই স্বপ্ন দেখতে পারি?'
কল্যান চেয়ারটা টেবিলের একটু ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে দিলো।
তারপর বলল বেশিনে হাত ধুতে ' না মাসি কার কখন স্টার ঘুরে যাবে কেউ কি কিছু বলতে
পারে ?তবে স্বপ্নটাকে মরতে দিলে তো হবে
না ।স্বপ্ন তোমাকে দেখতেই হবে।'
মাসি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
কল্যান নিজের রুমে গিয়ে ড্রেস পড়ে নিল বেরোতে হবে।
'মাসি তোমাকে আর সন্ধ্যেতে আসতে হবে না আমি কখন ফিরবো না ফিরব।'
'তা বেশ।
তাহলে তুমি কি খাবে?'
'আরে এক বেলা তো ,দরকার হলে কিছু কিনে নিয়ে এসে খেয়ে নেবো ।তোমাকে অত ভাবতে হবে না।
কালকে আবার সকাল সকাল চলে এসো কেমন?'
'ঠিক আছে। কি খাবে না খাবে একটা চিন্তা থেকে যাবে।'
"আরে না মাসি, কোন চিন্তা নেই ।আমার মা এখানে নেই তুমি এখন আমার মায়ের মত তাই এত চিন্তা করছ?'
মাসি বেরিয়ে গেল কল্যাণ বেরিয়ে পরলো।
কল্যাণ ট্রেন ধরল কৃষ্ণনগর লোকাল।
কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে আবার কিছুতে উঠতে হবে। নবদ্বীপ কলেজে পড়েছে। একটা সেমিনার আছে।
ট্রেনে উঠে প্রথমদিকে জায়গা পায়নি ।তারপর ঠিক মদনপুর ছাড়িয়ে জায়গাটা পেল।
ট্রেনে যেতে যেতে ভাবল মনে মনে কালকে লেখাটা নিয়ে ভাবতে থাকবে কিভাবে উপস্থাপন করবে ?পরিবেশনটা কতটা সুন্দর ভাবে করা যায় এসব আর কি।
তারপর কখন কৃষ্ণনগর স্টেশনে এসে থেমেছে বুঝতেই পারেনি চোখটা লেগে গেছিল।
সবাই যখন হন্তদন্ত হয়ে নামতে শুরু
করেছে ।তখন নির্মেদ স্মার্ট কল্যাণ নামলো। তারপর হাঁটতে শুরু করল ।যথারীতি অটোওপেয়ে গেল। বাপরে অটোতে যা ভিড়। কিন্তু চাপতেই হলো ।এদিকে টাইমও হয়ে যাচ্ছে।
যথারীতি নবদ্দীপ কলেজে পৌঁছালো ওখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্তৃপক্ষ উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভরিয়ে তুলল। প্রথমেই ব্রিফকেস খুলে নিজের ল্যাবটপ বের করে চোখ বুলিয়ে নিতে থাকলো। এরইমধ্যে এসে গেল কফি।
কফিটা গলায় বেশ আরাম দিল। কি সুন্দর সুখানুভূতি। একটা বাতানুকূল ঘরে বসতে দেয়া হয়েছিল। হলঘরটার শীতলতা যেমন নিজের শরীরটাকে প্রশান্তি দিয়েছে তেমনি ভেতরের প্রশান্তি দিয়েছে উষ্ণতায় ভরে কফি।
বিভিন্ন কলেজ থেকে বিভিন্ন লেকচারাররা এসেছেন। গলার জন্য কল্যাণ একটু কেমন যেন ভেতরে ভেতরে একটু দুর্বল হয়ে পড়ছিল।
ঠিকঠাক তথ্য পরিবেশন করতে পারবে কিনা ইন একটা সংশয় ছিল।
গুরুর নাম করে নেমে পড়তেই হলো।
গলার স্বর এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে নিলো তারপর তার বক্তব্য শুরু করলো।
বক্তব্য শুনে সকলে অভিভূত, আপ্লুত।
প্রত্যেকের ভেতরে যে একটা উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছে তাতে কল্যাণও ভেতরে ভেতরে ভীষণভাবে অভিভূত হয়ে গেছিল।
তারপর মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল আজকে ডাক্তার দেখাতেই হবে। ব্রেক এর সময় ডাক্তারের সাথে কনসাল্ট করে নিয়েছে।
কিন্তু আজকে কি ডাক্তার দেখাতে পারবে কটায় ছাড়া পাবে সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছে না দেখা যাক।
এরমধ্যে লাঞ্চ এসে গেছে। লাঞ্চে বিরিয়ানি ,মটন কষা দেয়া হয়েছে। লঞ্চের প্যাকেট খুলে কল্যান
মনে মনে খুব খুশি হয়েছে।
মাঝে টুক করে মনে হল শিখাকে ফোনটা করলে কেমন হয়।
আমার গলাটা জন্য ও চিন্তিত । ভাবতেই রিসিভ করলো তারপর বললো বলো।
'যেন মনে হল ফোনের অপেক্ষাতেই বসে ছিল 'অনেকটা অধীর আগ্রহে।'
"তোমার প্রোগ্রাম শেষ হয়েছে?"
'না গো ,এখন লাঞ্চ করছি। এখন ব্রেক।'
'ও আচ্ছা তোমার গলার অবস্থা কি?'
'কি মনে হচ্ছে?'
সকালে যে খারাপ অবস্থা ছিল তার থেকে একটু বেটার মনে হচ্ছে ওষুধ খেয়েছো নাকি?
এটা বোধহয় জানো ,ঈশ্বরের অসীম লীলা ।খুব টেন্সড ছিলাম আ'মি।'
'"তুমি কি করছ?
'তোমার কথাই চিন্তা করছিলাম। ঠিকঠাক গলা কাজ করছে কিনা?'
'তোমার লেকচার হয়ে গেছে?'
"হ্যাঁ ,হয়ে গেছে।'
"তাহলে কখন ফিরবে?'
'সেমিনার শেষ হোক তবে তো?'
'ঠিক আছে টেক কেয়ার।'
'সেম টু ইউ।'
'/অ্যাই শিখা একটা গান শুনিয়ে দাও না খুব ইচ্ছে করছে তোমার কন্ঠে গান শুনতে। প্লিজ।"
"এখন! মাথাটাও গেছে।"
"প্লিজ একটু শুনিয়ে দাও না'
"মান্নাদের একটা গান গাইছি বেশি কিন্তু করবো না?"
"Ok"
"মিষ্টি একটা গন্ধ রয়েছে ঘরটা জুড়ে,... এলোমেলো করে ছড়ানো ছিল যা, কার দুটি হাত সাজিয়ে দিলো তা। চিনি নাকি চিনি না। কাছে না দূরে..।'
ওদিকে কর্তৃপক্ষ কল্যাণকে ডাকলেন
' স্যার আসুন সেমিনার শুরু হয়ে গেছে।'
'হ্যাঁ যাচ্ছি,।'
"এখন ছাড়ছি কিন্তু মিষ্টি একটা গন্ধ প্রাণের ভেতরে ছড়িয়ে দিলে তুমি।"
শিখা প্রসন্নতায় হো হো করে হেসে উঠলো।