১৮ মার্চ ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৭০



ধারাবাহিক উপন্যাস

শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ৭০)
শামীমা আহমেদ 


শিহাব, সন্ধ্যে হয়ে এলো। এবার বাসায় ফিরতে হবে, বলেই শায়লা উঠে দাঁড়ালো। 
শিহাব কথাটিতে শতভাগ সম্মতি জানিয়ে সেও উঠে দাঁড়ালো। 
হ্যাঁ,শায়লা চলো তোমাকে এগিয়ে দেই।
যদিও ইচ্ছে করছে জীবনের বাকী সময়টা তোমার সাথেই কাটিয়ে দেই। 
শায়লা আমার আর ভালো লাগছে না তোমাকে ছেড়ে থাকতে? এইতো তুমি চলে গেলে আমার আবার সেই একাকী থাকা।এই দীর্ঘরাত একাকী পাড়ি দেয়া। তোমার জন্য আমি সবসময় অপেক্ষায় থাকবো।
শিহাবের কথায়  শায়লার চোখে জল ভরে এলো। সে এই কথা টিতে সায় দিয়ে শিহাবকেজানালো,আমি সব বাধা পিছনে ফেলে তোমার কাছে আসবো শিহাব। তুমি শুধু আমার অপেক্ষায় থেকো।
শায়লা তার পার্সটা নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে এলো।  শিহাব দরজা খুলে  দেখলো লিফট নিচে নামছে  এবং ভেতরে লোকজনও আছে। তাই এবার দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। কেয়ারটেকার বেলালকে শিহাব একটা রিকশা ডেকে দিতে বললো।শায়লাকে বিদায় জানিয়ে শিহাব বললো, পৌঁছে অবশ্যই  জানিও। বেলালকে কিছু বখশিশ দিয়ে শিহাব ঘরে ফিরে এলো।

বাসার গেটে রিকশা থামতেই শায়লার রুহি খালা আতংকে ধরলো। ভাগ্য সহায়  হলো,খালার ফ্ল্যাটের  দরজা বন্ধ এখন। শায়লা প্রায় নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলো। 
শায়লা বাসায় পৌঁছে সবার আগে শিহাবকে জানিয়ে দিলো। 
কিছুক্ষণ পর রাহাত অফিস থেকে ফিরলো হাতে মায়ের জন্য কেনা ঔষধের প্যাকেটটি দেখিয়ে রাহাত জানতে চাইলো, আপু তুমি নিজে ওষুধ কিনতে যাওনি? রুহি খালার বাসা থেকে ঔষধ আনতে হলো। তবে তুমিতো বাইরে গিয়েছিলে রুহি খালা ফোনে আমাকে জানালো। 
শায়লা বুঝে নিলো, রুহি খালা তবে রাহাতকে কল দিয়ে সব জানিয়েছে।
রাহাতের কথায় শায়লা নিরুত্তরই রইল।
আপু, তবে কোথায় গিয়েছিলে?
শায়লা ভাবলো, অন্য সময় হলে রাহাত এই প্রশ্নটা করার সাহস দেখাতো না।কিন্তু রুহি খালা রাহাতকে একেবারে বদলে দিয়েছে।
-তবে কি তুমি শিহাব ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে। শায়লার উত্তর না নিয়ে রাহাত বেশ বিরক্তির সুরে বললো, আপু এসব একেবারেই ঠিক হচ্ছে না।আর মাত্র কয়েকদিন পর নোমান ভাইয়া আসছেন। এ সময় তোমার শিহাব ভাইয়ার সাথে যোগাযোগটা কমিয়ে দেয়া উচিত।
রাহাতের মুখে এই প্রথম নোমান ভাইয়া নামটা শুনে শায়লা চমকে উঠলো!  এতদিন
ধরে নোমান সাহেবই বলে আসছিল। 
রাহাত বেশ বিরক্তিকর মনোভাব নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। মনে হলো শায়লাদের কোন উত্তর শোনার জন্য সে মোটেই আগ্রহী নয়।

রাতে নোমান সাহেবের কল এলে শায়লাকে তার সাথে কথার অভিনয় চালিয়ে যেতে হলো।শায়লাকে নিয়ে তার কতশত ভাবনা!
শায়লা নীরবে তা হজম করে গেলো।

শিহাব আজ একটু তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলো। কাল সকালে একটু গাজীপুর ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। কিছু বিদেশি বায়াররা আসবে।ওরা ফ্যাক্টরির যাবতীয় বিষয় দেখে তবে অর্ডার করবে।ওয়ার্কাদের নিরাপত্তা, হেলথ ইসু, স্যানিটেশন, চাইল্ড  কেয়ার,ম্যাটারনিটির ছুটিছাটা,প্রোপার স্যালারি, ওয়ার্কিং টাইম,ওভারটাইম, তার পেমেন্ট যথাযথ কিনা তা খতিয়ে দেখবে। প্রোডাক্ট এর চেয়ে ওদের কাছে এগুলোর প্রায়োরিটি বেশি। আর এসব ওরা  শ্রমিকিদের কাছ থেকে নিজ মুখে শুনবে। ওরা যে একটা ভদ্র জাতি তা এতেই প্রমাণিত হয়।আর আমরা ? জাতিগতভাবেই শ্রমিকদের রক্তচোষা মালিকপক্ষ। শিহাব ভাবলো আমাদের নৈতিক চরিত্রের উন্নতি হওয়া জরুরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির চেয়ে।
শিহাব একা বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে এইসব নানান ভাবনার ডালপালা মেলছিল।
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। শিহাবের ধ্যান ভাঙল। ফোন হাতে তুলে নিতেই দেখলো মায়ের কল। শিহাব উঠে বসলো।
মা কেমন আছো ? জিজ্ঞেস করতেই মায়ের অনুযোগ, কিরে মাকে একেবারে ভুলেই গেছিস। কোন ফোন করিসনা, খোঁজ খবর নিস না,
এইতো মা খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে।
বুঝলাম,শায়লা কেমন আছে ? মেয়েটা এসে মায়া বাড়িয়ে গেছে। আরেকদিন নিয়ে আসিস।
আচ্ছা আনবো মা।
কিছু খাবার পাঠিয়েছি।কাল কুরিয়ারে গিয়ে নিয়ে আসিস।
শিহাবের কাল গাজীপুর যেতে হবে। এ কথাতো মাকে বলা যাবে না আর তাছাড়া খাবারও প্রায় শেষ। আনতেই হবে।
ঠিক আছে মা, আমি কাল গিয়ে নিয়ে আসবো।
আরাফ কেমন আছে মা ?
এইতো ভালোই আছে। আলহামদুলিল্লাহ। আজ অনেক খেলেছে ভাই বোনদের সাথে।
ঠিক আছে মা, আমি সময় পেলেই আসবো।
আচ্ছা বাবা ভালো থাকিস।পথঘাটে সাবধানে চলিস।
তুমি দোয়া রেখো মা।আচ্ছা রাখি।আল্লাহ হাফেজ।
শিহাব ঘড়িতে সময় দেখলো।রাত সাড়ে দশটা বাজছে।হ্যাঁ,কবিরকে  কল করা যায়।
শিহাব কবিরকে কল করে কাল কুরিয়ার থেকে খাবারগুলো রিসিভ করে বাসায় ফ্রিজে রেখে যেও।আমার কেয়ারটেকার বেলালের কাছে চাবি থাকে।তুমি তোমার নাম বলে রেখে যেও।
কবির খুবই অনুগতভাবে দ্বায়িত্ব বুঝে নিলো।
সকাল নয়টায় শিহাবের ঘুম ভাঙল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে শিহাব বারান্দায় যেতেই গত সন্ধ্যার কফি মগ দুটি শায়লাকে ভীষণভাবে মনে করিয়ে দিলো। শিহাব উদাস ভাবনায় নিচের রোডের গাড়ি চলাচল দেখতে লাগল। ভেবে নিলো তাকেও বেরুতে হবে।শিহাব  শাওয়ার নিয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে বের
হয়ে গেলো। কিছুদুর গিয়ে একটা চেনা রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে নিয়ে গাজীপুরের উদ্দেশ্য  বাইকের স্পীড বাড়িয়ে ছুটে চললো।
রাহাত নাস্তা সেরে অফিসের জন্য বেরুবে।শায়লাকে জানালো, আপু আমি লাঞ্চের পর বের হয়ে মাকে নিয়ে বাসায় চলে আসবো।
অফিস শেষ করে যেতে গেলে বেশ রাত হয়ে যাবে। বিকেল নাগাদ মা পৌঁছে যাবে বাসায় সেটাই ভাল। রাত করলে আবার কতক্ষণ জ্যামে পড়তে হয় কে জানে ? তুমি এদিকটা গুছিয়ে রেখো।শায়লা আচ্ছা বলে বাসার দরজা লাগিয়ে দিলো। 
শিহাবের অফিস এসিস্ট্যান্ট কবির যাত্রা বাড়ি থেকে বাসে একেবারে উত্তরার হাউজবিল্ডিং এ এসে নামল।নয় নম্বর সেক্টরে সুন্দরবন কুরিয়র গিয়ে শিহাবকে কল করলো।শিহাব বাইক থামিয়ে  কুরিয়ারের লোকদের সাথে কথা বলে  কবিরকে পার্সেলটি দিতে অনুরোধ করলো। কবির খাবারের ব্যাগটি নিয়ে তকশায় শিহাবের বাসা সেক্টর তের এর দিকে এহিয়ে গেলো।এর আগেও বেশ কয়েকবার কবির শিহাবের নানান কাজে এই বাসায় এসেছে।কেয়ার টেকার বিল্লাল তাকে ভালোভাবেই চিনে। বাসায় ঢুকতেই বললো,উপরে যান,সারের বাসায় নিয়া কাম করতাছে,দরজা খোলাই আছে। কবির লিফটে উপরে উঠে গেলো।দরজা খোলাই পেলো। বুয়া ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে।কবির খাবারের ব্যাগ থেকে বক্সগুলো বের করে সব ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে গেলো।নিচে এসে রিকশা নিয়ে অফিসের দিকে এগিয়ে গেলো। এর পরপর
হঠাৎ বাসার গেটে একটা উবার এসে থামলো। গাড়ির ভেতর থেকে একটি মেয়ে বাসার নাম্বার প্লেটের সাথে ঠিকানা মিলিয়ে নিচ্ছল।আর তা মিলে যাওয়াতে উবার  ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটি গাড়ি থেকে নামলো। বাসার গেটে উঁকিঝুকি দিচ্ছে। বিল্লাল এগিয়ে গেলো। দেখলো খুবই সুন্দরী  একজন মেয়ে! মনে হচ্ছে বিদেশি। চোখে সানগ্লাস, পায়ে হাইহিল জুতা।খুব সুন্দর পোষাক পরা। হাতে একটা চাক্কাওয়ালা সুটকেস,তার গায়ের রঙ এক্কেবারে বিদেশিদের লাহান,ধবধবা ফসসা। এই সুন্দর মেয়েছেলেকেতো সে কোনদিন দেখে নাই ! তার ভিতরে ভীষণ কৌতুহল হলেও বিল্লাল তার ডিউটিতে ব্যস্ত হলো,ম্যাডাম, কাউরে খুঁজতাছেন ?
মেয়েটি খুব হালকা কন্ঠে বললো,হ্যাঁ,  এটা কি শিহাব সাহেবের বাসা,মানে উনি কি এখানে থাকেন ? 
বিল্লাল বিস্ময়ে যেন নির্বাক হয়ে গেলো। এত সুন্দরী মাইয়া সারকে খুঁজতাছে? অবশ্য সারওতো সুন্দর মানুষ। 
কি ভাবছেন? বলছেন নাতো ?
জ্বী ম্যাডাম,শিহাব সার এই বাসায় থাকেন, চারতলায়।
মেয়েটি লিফটের দিকে এগুতে চাইলে,বিল্লাল বলে উঠলো, সারতো বাসায় নাই,সকালেই বাহির হইয়া গেছে। গাজীপুর গেছে।আমারে বইলা গেছে। তয় সারের ঘর খোলা আছে,বুয়া কাজ করতাছে।
বিল্লালের মুখ দিয়ে কথাটা ফস করে বেরিয়ে গেলো !
তা,আপনি কে ম্যাডাম ? সারের কি হন ?
আমার নাম রিশতিনা।আমি আপনার সারের স্ত্রী।এতদিন বিদেশে ছিলাম।আজ দেখা করতে এসেছি ।
বিল্লাল বেশ অবাক হইল,মনের ভেতর তার প্রশ্ন,তবে কাইল বিকালে যে ম্যাডাম আসলো সে তবে কে ? সারের বউ আছে তাতো কোনদিন জানতাম না ! তয় বউ তার সাথে থাকে না ক্যান ?
আমি একটু তোমার সারের বাসায় যেতে চাই। উনি কোন পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন ?
না, না ম্যাডাম,সারের অনুমতি ছাড়া তার বাসায় আপনারে যাইতে দিতে পারিনা।
ঠিক আছে, তোমার স্যারকে কল করে যেনে নাও।আমি অপেক্ষা করছি।
বিল্লাল কল করতে ফোন হাতে নিলো।
রিশতিনা চারপাশে তাকিয়ে দেখছে।শিহাব বহুদিন হলো ঝিগাতলায় আর থাকছে না।ইংল্যান্ডে তার চলে যাওয়ার পরপরই এখানে চলে এসেছে।রিশতিনা মনে মনে তার উত্তরার কাজিন, শিহাবের বন্ধু রোমেল ভাইয়াকে অনেক থ্যাংক্স জানালো। রোমেল ভাইয়া হেল্প না করলে শিহাবের ঠিকানা জানা হতো না। অবশ্য ইংল্যান্ডে থাকতে শিহাবের সব খবর রিশতিনা তার কাছ থেকেই জানতো।
বিল্লাল শিহাবকে কল করেই যাচ্ছে। শিহাব চলন্ত বাইকে তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে না। এদিকে রিশতিনা উপরে যেতে চাইছে।কি যন্ত্রণায় পড়লো সে ভাবতেই নিচতলার অপুর আম্মু বেরিয়ে এলেন ছেলেকে স্কুল থেকে  নিয়ে আসতে। বিল্লাল এক দৌড়ে তার কাছে ছুটে গেলেন।এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব কিছু গরগর করে ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে গেলো।
অপুর মাতো সব শুনে চোখ কপালে তুললেন। কি ! শিহাব সাহেব বিবাহিত? তার স্ত্রী আছে। কই কোনদিনতো বলেননি।
রিশতিনা একটা সমাধানের জন্য তার দিকে এগিয়ে গেলো।
প্লিজ হেল্প মি।আই এম মিসেস শিহাব।আই এম হিজ ওয়াইফ।
আপনি তার বউ, তা এইটা আমরা কেমনে বুঝবো ? 
ইয়েস,আই হেভ প্রুফ। শিহাব ইজ মাই হাজবেন্ড।আই হেভ ফটোগ্রাফস অফ আস,ইউ সি,  বলে সে মোবাইল গ্যালারি থেকে ছবি দেখাতে চাইলো। অপুর আম্মু ভাবলো,বিষয়টি কেমন দেখায় ? সে বললো,বিল্লাল তোমার সার রে ফোন দাও, জিজ্ঞেস করো।
শিহাব গাজীপুরে পৌছেই দেখলো বিল্লালের অনেকগুলো কল। শিহাব ভাবলো,কবির কুরিয়রের খাবার রেখে গেছে সেটা জানাতেই  এত কল। উফ ! এ বিল্ললাকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না।বেশি মাত্রায় ওবিডিয়েন্ট ! 
শিহাব ফোন রিসিভ না করেই ফ্যাক্টরিতে ঢুকে গেলো ম্যানেজার সাহেব এগিয়ে এলেন।অপুর আম্মু অনেকক্ষন অপেক্ষায় থেকে রিশতিনাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন।রিশতিনা একে একে তার আর শিহাবের বিয়ের আগের পরের সব ছবি দেখালো। খুব সংক্ষিপ্ত করে নিজেদের দূর্ভাগ্যের কথা বললো। অপুর আম্মু ভাবলেন স্বামী স্ত্রীর মাঝে বোধহয় মান অভিমান চলছে। তিনি রিশতিনাকে চারতলায় শিহাবের ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে দিলো। আর তার ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে হবে এটা বলে রিশতিনার কাছ থেকে বিদায় নিলো।রিশতিনা কলিং বেল পুশ করলো।তার ভেতরে প্রচন্ড  এক ভাললাগা আবার শিহাবের প্রতি তার পরিবারের এত অন্যায় আচরণের জন্য তার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। 


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much