ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৬৪)
শামীমা আহমেদ
শায়লার ফোন ব্যস্ত পেয়ে শিহাবের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।।যেন সাজানো বাগানে আচমকা কালবৈশাখীর তান্ডব। শিহাব বুঝতে পারছে না সে এখন কি করবে? শায়লার নাম্বারে কি কল দেবে বা দেয়া উচিত হবে? কিন্তু এমনতো হতে পারে শায়লা তার অনিচ্ছাতেই কানাডায় কথা বলছে।পরক্ষণেই শিহাব ভাবলো, না,শায়লাতো কথা বলতেই পারে। শিহাবের মন কেমন যেন দোদুল্যমান হয়ে যাচ্ছে।তবে কি শায়লা অন্য কিছু ভাবছে? তবে যে আজ সারাদিন আমাদের সাথে সময় কাটালো? যদিও রেস্টুরেন্টে তাকে বেশ চিন্তিত লাগছিলো।তবে কি নোমান সাহেব শায়লার সাথে যোগাযোগে আছে? কই শায়লাতো কিছু বললো না?আর এতদিন নীরব থেকে এখন সে কেন শায়লার খোঁজ করছে।কিন্তু শায়লাতো বলেছে সে আমাকেই ভালবাসে। শায়লাতো বারবার এটাই বুঝিয়েছে।আরাফকে আপন করে নিয়েছে। আরাফও শায়লাকে খুব পছন্দ করেছে।তাহলে কেন এতটা কাছে আসা? তার জন্য এতটা আকুল হওয়া? আবার কি তবে তার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটতে যাচ্ছে? শিহাবের
বিছানায় আর ভালো লাগছে না। মোবাইল নামিয়ে রেখে সে উঠে বসলো। এক চাপা উত্তেজনায় ঘরময় হেঁটে চললো।এমন টেনশনের সময় সিগারেট দরকার টেনশন কমাতে।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে শায়লার ভাবনায় ডুবে থেকে একে একে সব স্টিক শেষ হয়েছে।এখন কি করা ? এত রাতেতো সিগারেটের দোকান খোলা নেই। শিহাবের ভেতর কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার আশংকা!
নোমান সাহেব আজ কিছুতেই ফোন কল ছাড়ছেন না।মনে হচ্ছে গত দেড়বছরের কথা সে আজ বলবে। অবিরত বলেই চলেছে,
সুইট হার্ট শাআলা।আই এম ভেরি সরি ফর মাই ডিলে।ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।ইন ফ্যাক্ট,আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইউর রেস্পন্স!
শায়লা বুঝে নিলো,আসলে উনি ভেবেছিলেন আমি বিদেশ যাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে করে আছি।উনি ভেবেছেন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের মত বিদেশের পাত্রের জন্য আমি লোভী হয়ে আছি। সে শায়লাকে খুবই সস্তা ভেবেছে।বারবার তার মুখে শায়লাকে শাআলা ডাকটি অসহ্য লাগছে।
শাআলা,আই এম কামিংজাস্ট আফটার টেন ডেজ।প্লিজ, ফরগিভ মি,নাউ আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড, ইটস মাই ফল্ট,
এ প্রান্তে শায়লা একেবারে নীরব পাথর হয়ে আছে।শিহাবকে কি উত্তর দিবে সে? কি করবে এখন?
শাআলা,মাই চিল্ড্রেন লাইক ইউ ভেরি মাচ! ইউ আর দেয়ার মম। দে আর আলঅয়েজ আস্কিং এবাউট ইউ।প্লিজ,জাস্ট থিংক অফ দেম।
শাআলা,প্লিজ টক টু মি, প্লিজ রিপ্লাই মি,,প্লিজ ইউ গেট রেডি।ইউ প্যাক আপ ইউর এভরিথিং। আই উইল টেক ইউ উইথ মি হিয়ার ইন কানাডা।
প্লিজ, মাই লাভ,ডোন্ট বি স্যাড!
শাআলা,প্লিজ, টক টু মি।প্লিজ রিপ্লাই মি,,
শায়লা এপাশে একেবারেই নিরুত্তর হয়ে রইল। অচেনা একটি কন্ঠে শায়লার নাম উচ্চারিত হচ্ছে শায়লার ভেতরে হু হু করে উঠছে। কিছুতেই তা ভাললাগছে না। সন্ধ্যার ফোনকলের শিহাবের কন্ঠের প্রলেপ এখনো তার কানে লেগে আছে।
নোমান সাহেব কোন সাড়া না পেয়ে অগত্যা বললেন,
ওকে,ডিয়ার,আই এম বিজি নাউ।টক টু ইউ লেটার।প্লিজ,গেট ইওর মাইন্ড রেডি টু কাম টু কানাডা।আই এম ইন এ হারি নাউ,,,
সো,বাই ফর দিস মোমেন্ট! লাভ ইউ শাআলা।
শাআলা,ডু ইউ লাভ মি? বাই হানি!
নোমান সাহেবের এই বিরতিহীন কথা শায়লার ভেতরে এঁফোড় ওফোঁড় হয়ে বেরিয়ে গেলো! বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণায় রক্তক্ষরণ হতে লাগলো।তার রক্তের ভেতর একটাই স্পন্দনের পুনরাবৃত্তি ,শিহাব, শিহাব, শিহাব!শায়লা একেবারে নীরব নিথর হয়ে ঘরের দেয়ালে দৃষ্টি নিয়ে মন ভাবনায় ডুবে রইল। অপলক দৃষ্টিতে শুধু শিহাবের মুখটিই ভেসে উঠছে!
শিহাব বুঝতে পারছে না কি করবে? আইনি জটিলতা পার করে শায়লাকে তার কাছে আনা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এখুনি শায়লার সাথে কথা বলতে হবে তার।শিহাব এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলো।শায়লাকে ছোট্ট করে একটা মেসেজ লিখলো।
শায়লা ঘুমিয়েছ?
মেসেজের শব্দে শায়লা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এলো।শিহাবের নাম দেখে দ্রুতই মেসেজটি দেখে নিলো। সাথে সাথে রিপ্লাই দিলো,না জেগে আছি। রিপ্লাইটি পৌঁছাতে এক দন্ড সময়ের মধ্যেই শিহাবের কল চলে এলো, শায়লা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই, জানার প্রবল আগ্রহ আর উত্তর শোনার উৎকন্ঠায় জানতে চাইল, শায়লা তোমার ফোন বিজি পাচ্ছিলাম কেন?
শায়লা একটু সময়ও নষ্ট না করে উত্তর দিলো,কানাডা থেকে কল এসেছিল।
কি বললেন উনি?
বললেন, উনি দশদিন পর বাংলাদেশে আসছেন আমাকে নিয়ে ফিরবেন।
শিহাব কথাটি শুনে শিহাবের শরীরের ভেতর দিয়ে মনে হলো একটি শীতল অনুভুতি বয়ে গেলো।যা শায়লাকে নিয়ে তার মনের ভেতর জ্বলে উঠা শত আশা আকাঙ্ক্ষার বাতিটি যেন ধপ করে নিভিয়ে দিলো।
শিহাব হালকা করে বললো,তুমি কি বললে?
শায়লা নীরব হয়ে রইল।
শায়লার নিরুত্তরে শিহাব যেন ভেঙে পড়লো।
শায়লা,কিছু বলো।তুমি কি বললে? তুমি কি তার সাথে চলে যাবে? শায়লা কথা বলো।উত্তর দাও। শিহাবের আবেগী কন্ঠে শায়লার চোখ দিয়ে কান্নার ধারা নেমে আসছে। শায়লা কোন কথাই বলতে পারছে না।সে শিহাবকে এই বলেও আশ্বস্ত করতে পারছে না, শিহাব তুমি ভয় পেও না। কিছুক্ষন পর শিহাবের উৎকন্ঠাকে দমাতে শায়লা বলে উঠলো,,শিহাব নোমান সাহেবের কথার আমি কোন উত্তর দেইনি।কারণ,আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না। আমি তোমার কাছেই থাকতে চাই।তুমি আমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না শিহাব? আমি তোমার সাথেই জীবন কাটাতে চাই।
শায়লার কথাগুলো শিহাবের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনলো। শায়লা তাকে ছেড়ে যাবে না, শায়লা তার হয়েই থাকবে! শিহাব মনকে আনন্দের খবরটি জানিয়ে দিয়ে, একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। শায়লাকে কাছে নেয়ার আবেগে শিহাব বেশ আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো,শায়লা তুমি আমার খুব কাছে আসো। আমার বুকের মাঝে তোমার আবাস গড়ে নাও।আমি সকাল বিকাল রাত সারাটাক্ষন শুধু তোমাকেই দেখতে চাই।
শায়লা তুমি আমাকে কাছে টেনে নিবে না?
এবার শায়লা অনেকটা স্বাভাবিকে ফিরে এলো।সন্ধ্যা থেকে ঘটে যাওয়া সবকিছুকে তুচ্ছ করে শায়লা শিহাবের মাঝে ডুবে গেলো।খুবই মোলায়েম কন্ঠে, মাদকতায় পূর্ণ কন্ঠে শায়লা বললো,হু, এসো আমার খুব কাছে।
ফোনের দু'প্রান্তে দুজন যেন দুজনের পরশ অনুভব করছে। দুজন দুজনার নিঃশ্বাসের দুরত্বে খুব কাছাকাছি অনুভবে একেবারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে যেনো!
কিছুক্ষন পর শিহাব বলে উঠলো, শায়লা তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমারও মন চাইছে তোমাকে দেখার,তোমার একটা ছবি পাঠাবে?
এ কথা বলতেই, শিহাব ভিডিও কলে চলে এলো। দুজন দুজনকে দেখে যেন শান্তি পেলো।
কি আজ ঘুমাতে হবে না? শায়লার প্রশ্নে শিহাব বলে উঠলো, কেন এক রাত কি আমার জন্য না ঘুমিয়ে কাটানো যায় না?
বেশ যায়,
তবে থাকো জেগে।জানো শায়লা তোমার ফোন বিজি পেয়ে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
কেন আমার হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে?
হ্যাঁ, তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলি এই জীবনে আর আমি কাউকে বিশ্বাস করবো না জেনে রাখো।
না, আমি হারাবো না।আর তোমাকেও একা থাকতে হবে না।
কিন্তু কিভাবে শায়লা? কিভাবে তা সম্ভব করবে?
ভালোবাসায় সব সম্ভব শিহাব।ভালোবাসায় সব জয় করে নেয়া যায়।শুধু অধিকারে সব পাওয়া যায় না।
শায়লা, তুমি আমাকে অভয় দিচ্ছো।
হ্যাঁ, শিহাব মনে রেখো, তুমি না, আমিই তোমাকে আগে ভালবেসেছি।তাই তোমাকে পাওয়ার আকুলতা আমার বেশি।আর তুমি আমার ভালোবাসায় সাড়া দিয়েছো তাই তোমাকে পূর্ণ করা আমার ভালোবাসার শপথ।
শায়লার কথায় শিহাব আজ যেন অন্য শায়লাকে দেখছে।কথায় আর দৃষ্টিতে বেশ দৃঢ়তা। শিহাব নিজেকে একজন সুখী মানুষ ভাবছে যেখানে শায়লা তাকে এমনিভাবে ভালোবেসেছে।এই ভেবে শায়লাকে হারানোর ভয় থেকে একটু যেন সাহস ফিরে এলো।
বেশ অনেক রাত হয়েছে।শায়লা মন থেকে নোমান সাহেবের কথাগুলো মুছে ফেওলতে চাইছে। হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন মনের ভেতর সাহস জমা হলো।নিজেকে বেশ হালকা মনে করেছে।
শিহাবকে জানালো,এখন তার বেশ ঘুম পাচ্ছে।সে ঘুমাতে চায়।শিহাবও যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।শায়লা শিহাবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নিলো।
কল শেষ করলেও আজ শিহাবের চোখে যেন ঘুম নেই। সন্ধ্যা থেকে শায়লার ভাবনায় ডুবে থেকে হঠাৎই হারানোর ভয়ে শিহাবের চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে।তার শায়লাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।শিহাব ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় রইল।
খুব সকালে শিহাবের ফোন কলে শায়লার ঘুম ভাঙলো।ঘুম জড়ানো চোখে শায়লা হ্যালো বলতেই, শিহাবের কন্ঠ ভেসে এলো,
শায়লা তোমার বারান্দায় এসে একটু দাঁড়াবে? তোমাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
চলবে.....