২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২২

মমতা রায়চৌধুরীর পত্রিকা





উপন্যাস




 টানাপোড়েন ১১৫
থাকো জাজ্জ্বল্যমান হয়ে

মমতা রায়চৌধুরী

টানা তিন দিন ধরে বৃষ্টির পর শীত প্রভাতের কাঁচা সোনালী রোদ্দুর যেন নতুন করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে ।পথের ধারে নির্জীব গাছগুলোর শিশির
চাকচিক্যে ভরিয়ে দিয়েছে ।তবে বাতাস একটু 
কড়া আছে ।বেলা বাড়ছে রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া ,যাতায়াত ,পথিক সংখ্যাও বেড়ে 
চলেছে ।শীতকালে কাশ্মীরি কোম্পানির নানা রঙের শাল , রেপার এবং নানা রংয়ের বালাপোষ পথচারীরা শরীর ঢাকাতে  রবির ছটা যেন আরো বেশি বর্ণ বহুল হয়ে উঠেছে।
রেখা অনেকদিন পর ছাদের অনুচ্চ আলিশার ধারে দাঁড়িয়ে এই সব দৃশ্যগুলো দেখছিল। এখনও ঠিক করে উঠতে পারেনি আজ স্কুলে যাবে কিনা। তবে শরীরটা তো সাথ দিচ্ছে না  রান্না তো এখনো বসায় নি। না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।মাসি এসে কাজ করছে। এই মাসিকে বেশি কিছু দেখানোর নেই। মাসিকে একবার বুঝিয়ে দেয়াতে , সব বুঝে গেছে।
এমন সময় রেখার ভাবনা পাশের বাড়ির 
দিকে ।নজরে আসলো শূন্য বাড়িটার বাইরের দিকে তাকিয়ে ,একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।' বেশ কয়েকদিন হল চৈতির মা নেই। রেখা শুনেছি মেয়ের বাড়ি থেকে একটু বাবার বাড়ি হয়ে আসবে কেমন শূন্যতা ঘিরে আছে যেনো বাড়িটাকে অথচ এই ছাদে উঠলে চৈতির মা ও ছাদ থেকে কত কথা বলে। কখনো বা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কখনো বা রান্নাঘরের থেকে কত কথাই না 
হয়েছে ।যখন কোন মানুষই দূরে থাকে তখন বোঝা যায় তার শূন্যতা।কাছে থাকলে বোঝা যায় না। দূরে গেলে তার অভাব ততটাই প্রকট হয়ে ওঠে। এই শূন্য বাড়িটার সঙ্গে একটা মর্মান্তিক বেদনার স্মৃতি যেন জড়িয়ে গেল।
হঠাৎ মনোজ নিচ থেকে ডাকছে'রেখা, রেখা,রেখা
আ. আ আ…
এরপর মাসি ডাকলো ও বৌমা বৌমা বৌমা।
রেখা ছাদের থেকে উত্তর দিল ডাকছো মাসি?
'আরে ছেলে ডাকছে তোমায় একবার নিচে এসো তো।
ও আচ্ছা যাচ্ছি
মনোজ যে রেখাকে ডাকবে কল্পনার অতীত ছিল।
বাচ্চাগুলোর অসুস্থতার সময় দু এক কথা ওর সঙ্গে হত ।আজকাল যেন কথাটাও বড় প্রয়োজন মাফিক। তাই মনোজ ডাকছে শুনে একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো , পরক্ষনেই মনটা নিষ্প্রভ হয়ে গেল কারণ প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে এজন্যই মনোজ ডেকেছে এই ভেবে । তার স্বচ্ছ আনন্দময় দর্পণএর  মত উজ্জল প্রাণের উপরে ধুলোর পর্দা যে পড়ে গেছে। তবুও রেখার ইচ্ছে হয় ধুলোকণাকে  সরিয়ে ,দর্পণে আবার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে। দেখতে ইচ্ছে করে তার প্রিয় মানুষগুলোর  প্রতিচ্ছবিও। যত অভিমান ক্ষোভ সব দূরে সরিয়ে ভেসে যেতে চায়, চলে যেতে চায় কাছের মানুষের টানে। রেখা বড্ড ভালবাসার কাঙ্গাল। তাই মনোজের ডাক শোনা মাত্রই ছাদের থেকে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামতে থাকে ।যত দ্রুত এসে পৌঁছানো যায় কিন্তু একি হচ্ছে তার শরীর আগের মত কেন সাড়া দেয় না ,নামতে গিয়ে ও সে দ্রুত নামতে পারে না। একটু নামতে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। ওদিকে মনোজের ক্রুদ্ধ স্বর শোনা যায়"এতক্ষণ আসতে লাগে ?একটা কাজের জন্যই তো ডেকেছি, গল্প করার জন্য তো নয়?'
সব কথাগুলো শুনতে পায় রেখা। মনের ভেতরে যে খুশির হাওয়া  পাল তুলে দিয়েছিল, আস্তে আস্তে সেটা যেন চুপসে যেতে থাকে। তবুও আস্তে আস্তে আসে ।তারপর জিজ্ঞেস করে 'কি হয়েছে?'
'তোমাকে কখন থেকে ডাকছি। তুমি কি শুনতে পাও না? নাকি শুনেও, না শোনার ভান করো। কেন এরকম করো বলো তো ?এত কথা বলতে ত ইচ্ছে করে না , তবুও বলতেই হয়?'
রেখার বুকের ভেতরে লাগে তবুও শব্দটা ব্যবহার করার জন্য রেখার এতটাই অপ্রয়োজনে হয়ে N  ।,গেছে এতে রেখার কি দোষ আছে ভেবে পায় না ভাবার চেষ্টা করতেও চায়না এখন যত ভাবতে যাবে তত কষ্ট বাড়বে শুধু রেখার দুই চোখ জলে ভরে ওঠে। এসব কথাগুলো শুনতে চায় না। অথচ আজকাল  এসব কথা শুনতে হয় ।কি পেয়েছে এই সংসার থেকে?উপরি পাওনা হিসেবে পেয়েছে অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান।
তবুও মনের কষ্ট গুলোকে পাথরচাপা দিয়ে বলল 'কি হয়েছে বলো?  '
 'ওদিকে' সুরু' ফোন করেছিলো? '
রেখা একটু অবাক হলো' সুরো' দা?
 'ওরা কাজের মানুষ কতক্ষণ ফোন ধরে থাকবে বলো ?তোমার মত তো আর সাতসকালে কেউ ছাদে গিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে বেড়াবে না অত সময় ওদের কাছে নেই তাই না?
ফোনটা কেটে দিলো।'
রেখা শুধু বললো '  তা আমাকে কি জন্য প্রয়োজন তোমার বন্ধু র ?'
'কি অবাক কান্ড আমার বন্ধু কোনদিন তোমার সঙ্গে কথা বলে নি? না  কি কেউ কথা বলে না এমন ভাবে বলছো?'
রেখা একটু চুপ করে থাকলো তারপর ভাবলো 'তাই তো কথা তো বলে ।'
ফলে আর কিছু কথা বাড়ালো না।
"আর শোনো ' মা'  কিন্তু ,দিন তিনেক পরেই আসছে। শুধু এটুকুই বলবো বাড়িতে যেন শান্তি বজায় থাকে।'
রেখা যত মনোজকে দেখছে তত বেশি অবাক হয়ে যাচ্ছে।  বাড়িতে অশান্তির মূল তাহলে কি রেখা? এটাই বোঝাতে চাইল মনোজ।
আজ মনোজ ও একথাটা স্পষ্ট করে বলল।
রেখা বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট ,যেন আর নিতে পারছি না , রেখা আস্তে আস্তে নিজের ঘরে চলে আসে। ওদিকে মাসি কাজ করে দিয়ে যাবার সময় বলল বৌমা ,আসছি মা।'
প্রতিদিনই মাসি চলে যাবার আগে রেখাকে এভাবে সম্মোধন করে যায় । উফফফ একটা কাজের মাসি তার এই মিষ্টি ডাকটা  এত কষ্টের ভেতরের যেন কোথায় একটু যন্ত্রণা উপশমের মলম লাগিয়ে দেয়। 
রেখা শুধু বলে হ্যাঁ, মাসি এসো।'
কতদিন কাকিমার সাথে কথা হয় না। নানা ঝামেলায় জড়িয়ে থাকার জন্য খবর নেওয়া হয়নি।
মা চলে যাবার পর থেকে কাকু কাকিমার কাছ থেকে একটু স্নেহ ভালোবাসা পায়। মাসের মানি অর্ডার টা ঠিক পৌঁছেছে কিনা খবর নেওয়া হয়নি। গতদিনের পেপারে বেরোনোর স্বপ্নীলের ছবিটা ওর কাব্যের অংশটুকু সযত্নে রেখে দিয়েছে রেখা খাটের পাশে রেখে দিয়ে ভাবলে একবার কাকিমার কাছে খবরটা নেয়া দরকার বলেই ফোনটা করলো। রিং হয়ে গেল ।ধরল না।
রেখা আবার ফোন করল। এবার মনে হচ্ছে ফোনটা ধরল। 'হ্যালো'।
রেখা বলল ও কাকিমা?
কাকিমা বললেন 'কে রে ননি?'
রেখা বলল  কাকিমা'।
কেমন আছিস মা গলাটা শুনে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে? কি হয়েছে মা?'
রেখার চোখ তখনো জলে ভেজা। নিজেকে সাম্লে নিয়ে বললো'কই কিছু হয়নি তো।'সবাই ঠিক আছে তো?'
হ্যাঁ আমরা মোটামুটি ঠিকই আছি তবে তুই লুকিয়ে গেলে হবে মা তোর গলাতে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
না না তোমরা সব সময় তো ওটাই ভাবো কিছু না কিছু হয়েছে বলো?
আমরা মা সন্তানের দুঃখ-কষ্ট আমরা ভাল করে বুঝি মা। যাক ভাল থাক এটাই সব সময় চাই।
তোমরা ও'মাসে মানি অর্ডারে টাকাটা পেয়েছো?
হ্যাঁ ,পেয়েছি ।একটু দেরি হয়েছে মা আর আমাদেরও জানানো হয়নি ।জানানো উচিত ছিল। একটু অন্য সমস্যা হয়েছিল?'
রেখা অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল 'কি হয়েছে? কাকু ঠিক আছে? তুমি ঠিক আছো তো?'
কাকিমা বললেন' হ্যাঁ আমরা সবাই ঠিক আছি।তোর কাকুর যা অবস্থা সেরকমই আছে আরে বুলু দির কথা বলছিলাম।'
কি হয়েছে বুলু কাকিমার?
 বুলুদি তো শয্যাশায়ী ।কদিন আর আয়ু আছে পৃথিবীতে কে জানে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রেখা যেন স্পষ্ট শুনতে পেল।
'সেকি কাকিমা? ছোট ছেলে বৌমা দেখছে তো?'
'ঐতো দায়ে পড়ে' পাড়ার লোকে চাপ আছে না?'
তবে বুলু দি মনে হচ্ছে বড় ছেলের জন্যই প্রাণটা ধরে রেখেছেন।'
'নীলুদা তাহলে আর আসলো না। নীলুদাকে কি খবরটা জানানো হয়েছে।'
'কে জানে ওদেরকে তো বলেছি যে খবরটা জানাতে। ওরা জানাচ্ছে কিনা সেটাই তো বুঝতে পারছি না। না হলে বলো না মায়ের এরকম অবস্থা শুনে সে কি না এসে পারে?'
রেখা বলল 'তাই তো?
'খুব দেখতে  ইচ্ছে করছে।'
'চলে আয় না মা ।কতদিন আসিস না ।সেই যে এসেছিলি। ক দিন এসে থেকে যা। আমাদেরও ভালো লাগবে। তোরও মনটা একটু ভালো হবে।
রেখা মনে মনে ভাবল   মা আসলে পরেই যাবে। 
হ্যাঁ দেখছি কাকিমা ।আমারও মনটা ছুটে গেছে তোমাদের 
জন্য ।রোজই তো পাখির মত মন  ছুটে যায়। শুধু দেহটা পড়ে থাকে এখানে।
দেহ থাকে।প্রাণ থাকে না।
ঠিক আছে কাকিমা পরে কথা বলবো ভালো থেকো সবাই। রাখছি ফোন।
'হ্যাঁ মা ।রাখ। ভাল থেকো।'
ফোনটা নামিয়ে  রেখে ভাবে ,কিছু সময়ের জন্য তার মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিল। নইলে এই সংসার তার প্রতি অন্যায় বিচার করে ,তাকেই শুধু দোষী সাব্যস্ত করে। কষ্টগুলো যেন হু হু করে বুকের ভেতরে ছুটে চলে। তবুও স্বপ্নীলের ছবিটাকে আঁকড়ে ধরে  বলতে থাকে 'যেখানেই থাকো ,ভালো 
থেকো ।কবিতা, কাব্য ,উপন্যাস এরমধ্যে তোমার প্রকাশ জাজ্জ্বল্যমান হয়ে থাকুক। শুধু আমি থাকি অন্ধকারে চাইলেও দেয়াল চিরে পারবে না দেখতে।চোখের জল শুধু পড়বে। তবুও তুমি চলো নীল আকাশে দু'চোখ মেলে আর হৃদয় পথে দু 'পা ফেলে। দেখবে হৃদয় আকাশের মত। আজ বলবো কি তোমায় প্লিজ নিজের খেয়াল রেখো।
আমি যেথায় যেখানে থাকি শুধু বলবো তুমি ভালো থেকো ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much