২৭ মে ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৭৩





উপন্যাস 

টানাপোড়েন   ১৭৩

মাতলা নদীর ঢেউ

মমতা রায় চৌধুরী




ছোট মামা শ্বশুরের জন্য রেখার খুব কষ্ট হয়। এতটা বছর শুধু এক নদীর জল আগুন করে রেখে দিয়েছেন মনের ভেতরে। ডাকনাম বুড়ো ওরফে বনমালী। এই বনমালী মামা যৌবনে নাকি এক মেয়ে মানুষের মনে ধরে যান। মামাদের অবস্থা তখন ভাল ছিলনা। ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। আর এখন সেই মামা মস্ত বড় আড়তদার হয়ে গেছেন। কয়েক বছর আগেও এই মামাকে রাত ভোরে ক্যানিং বাজারের আড় তে লাইন দিয়ে মাল কিনতে হত। এখন নিজেই একজন মস্ত আড়তদার। এখন মামার আড়তেই কত ছেলে কাজ করে। ইচ্ছে করলেই মামা ভালো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যেতে পারেন  কিন্তু না যার উষ্ণতা ভাগ করে নিয়েছলেন ,তার বুকের  সুমিষ্ট গোলাপের সুবাস নেবার জন্য। সেই গন্ধ আজও হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে। ভুলতে কিছুতেই পারেন  না। ভাবেন ভুলে যাবেন কিন্তু মনের ভেতর আছো যে আঁচড় কেটে চলে।
যে বিশ্বাসঘাতকতা মেয়ে মানুষটি করেছিল তার উপযুক্ত জবাব না দেয়া পর্যন্ত বনমালী মামার শান্তি নেই।
মামার এই ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হয় কয়েক বছর আগে।।
মামার পুরুষ্ট দেহে তখন যৌবন টগবগ করে ফুটছে।
ওই দেখো মেয়ে মানুষটার নামের সাথে পরিচয় করানো হলো না। মেয়েটির নাম ছিল অভিষিক্তা।
এমন ভাবে  অভিষেক করেছে বনমালী মামার হৃদয় প্রাণ জুড়ে যে অন্য কারোর অভিষেক আজ পর্যন্ত আর হলো না। অথচ বনমালী মামার মনে কিন্তু ঘৃণা আছে ,তবুও পারলেন না মনের হৃদয়ের সিংহাসনে অন্য আর একজনকে বসাতে।
শোনা যায় মামার চেয়ে রোজগেরে ভালপাত্র সঙ্গে তাই খুব সহজেই বিয়ে করে নিতে পেরেছে।
সেদিন বিয়ের খবরটি শুনতে পেয়ে মামা নাকি ছুটে গেছিলেন অভিষিক্তাদের বাড়ি ।
কিন্তু অভিষিক্তা মুখের উপর না করে দিয়েছিল উল্টে আরও বলেছিল "আমার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার প্রচুর টাকা আছে? তোমার কাছে কি আছে? সারা জীবন তোমার অভাবের সংসারে আমার জীবন কাটাব ভাবলে কি করে?'তাছাড়া অভাবের সংসারে ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালাবে' পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি 'মনে হবে।'
সেদিন বনমালী মামা খুব অবাক হয়ে গেছিলেন যার মুখে এত ভালোবাসার কথা শুনেছেন আজ তার মুখে কি শুনছেন? তবু বিশ্বাস করতেই চান নি ।প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারেন নি। পরে ভেবেছেন যে বাড়ির চাপ এই জন্য হয়তো অভিষিক্তা মামার সাথে এরূপ ব্যবহার করছে।
বনমালী মামা বলেছিলেন' তুই আমার সাথে মশকরা করছিস ।আমি জানি তুই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস। আমার পরীক্ষা নিচ্ছিস ধৈর্যের,?"
অভিষিক্তা বলেছিল'কোন ঠাট্টা আমি করছি না বাস্তবে দেখো তাকিয়ে কাল আমার বিয়ে। বাড়িতে আলোর রোশনাই দেখে বুঝতে পারছ না?
 বনমালী মামা কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর হতবাক হয়ে পড়েছিলেন।
পরে মামার এক বন্ধু মামাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসেন।
সেদিন নাকি মামা বাড়িতে এসে ভীষন কান্নাকাটি করেছিলেন ।আসলে মন থেকে ভালোবেসে ছিলেন, কখনো ভাবতেই পারেননি অভিষিক্তা মামার জীবনটা নিয়ে এরকম ছিনিমিনি খেলবে এইজন্য আজকাল মামার নাকি সব মেয়ে মানুষকে ওই একই মনে হয় ,স্বার্থপর মনে হয় আসলে অভিষিক্তা তখন কিছু কিছু চাহিদা পূরণের জন্যই নাকি মামাকে ইউজ করেছিল। তাই মামা আজও কোন মেয়ে মানুষকে মনের কোণে জায়গা দিতে পারলেন না।
শুধু রোজগার করে টাকার পাহাড় গড়তে চাইছেন আর অভিষিক্তাকে দেখাতে চাইছেন টাকাতে মানুষ কত সুখী হয়।
মনের ভেতরে সেই নদীর জলটাকে আগুনের স্রোত করে রেখে দিয়েছেন।
মামা নাকি পণ করেছেন কোন একদিন অভিষিক্তা নিশ্চয়ই তার কাছে ফিরে আসবে সেই দিনটার অপেক্ষায় আছেন।
তবে সেই দিনটায় ফিরে আসলে আদপেও মামা তাকে গ্রহণ করবেন কিনা সেটা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন রয়েছে।
আজই রেখা, মামা চলে যাবার পর সেই সব কথাই ভেবে যাচ্ছে আর খাতা দেখছে। যদিও খাতা সেরকমভাবে দেখা হয়ে ওঠেনি ,অত স্পিডই ওঠে নি।
স্পিড আসবে কোথা থেকে একে তো মনে ছিল বিরক্তি তারপর বনমালী মামাকে দেখে মনের ভিতর উথাল পাথাল করছে মামার সেই করুণ অবস্থা ভেবে। রেখা ভাবছে বনমালী মামা আর অভিষিক্তা যে খেলায় মেতে ছিলেন মাতলা নদীর গভীরতার মত। এ যেন একে অপরের পরিপূরক কেউ কাউকে ছেড়ে যেতেই পারেন না।
তাদের মনের ভিতর যে আগুন ছিল তা ছড়িয়ে গিয়েছিল অনেকটা দূর শরীর-মন ঘিরে।, স্বপ্ন দেখেছিল দুটি হৃদয়, একসঙ্গে হবে একাকার। অথচ সেই হৃদয় ভেঙে দিয়ে, হৃদয়ের তার ছিঁড়ে ফেলে শুধু আগুন জ্বেলে রেখে দিয়ে চলে গেছে।
রেখা মনে মনে ভাবছে কেন যে রকম হয়।
সব ভালোবাসাগুলো কেন পরিপূর্ণতা পায় না।
কেন সারাটা জীবন সে অতৃপ্ত ভালোবাসাগুলো ডুকরে ডুকরে কেঁদে মরে।
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে 'কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে যেন আমায় কি ডাকে আয় চলে
 আয় .. "।
রেখা ফোনটা প্রথমে ধরে না ,ফোনটা একটু দূরেই 
ছিল। ভাবছে মামার কথা ভেবে ভেবে তো খাতা দেখছে ,খাতাগুলো  আর একবার চেক করতে হবে । কোথাও ভুল ভ্রান্তি হলো কিনা। খাতাটা হাতে আছে সে কটা শেষ না করে ফোন তুলবে না।
রেখা দ্রুত খাতা কাউন্টিং করছে ঠিক সেই সময় আবার ফোন বেজে উঠলো  "কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে…।"
রেখার খাতাটা প্রায় চেক করা হয়েই এসেছে খাতা চেক করতে করতে বলল" দাঁড়া বাবা ধরছি।"
এই মাত্র 50 পেল।
রেখা উঠে খাতাটা রাখল। তারপর ফোনের দিকে এগোলো কল লিস্ট চেক করলো।
এ তো ছোট মামারই ফোন।
রেখা ঘুরিয়ে ফোন করলো।।
ফোন বেজে গেল কেউ তুললেন না।
আবার ফোন করে।, এবার গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন 'হ্যালো।'
রেখা বলল "মামা আমি রেখা বলছি আপনারা ঠিক টাইমে পৌঁছে গিয়েছিলেন তো? পথে কোন বিপদ-আপদ হয়নি তো?'
ছোট মামা বললেন 'না না কোন বিপদের ঝুঁকি ছিলনা আর আমরা নির্বিঘ্নে পৌঁছে গেছি '।
রেখা হেসে বলল যাক খুব ভালো কথা।"
মামা হেসে আবার বললেন 'রেখা ,পরেরবার তোমার হাতে ইলিশ ভাপা খাব।'
রেখা বলল" একদম মামা।'
মামা বললেন "থাকতে পারলে ভালো হতো।'
"আপনাদের থেকে যেতে বললাম চলে গেলেন।"
আসলে কি বল তো উপায় ছিল না। আমরা তো কোনো প্রস্তুতি নিয়ে যায়নি।'
রেখা বলল' ঠিক আছে ।পরের বার প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন।'
'একদম।'
"ঠিক আছে মামা রাখছি। প্রণাম নেবেন ভালো থাকবেন।"
কথা বলতে বলতে ওদিকে কলিংবেলের আওয়াজ "ওম জয় লক্সমি মাতা।"।
রেখা ফোনটা রেখে দ্রুত ছোটে ।
দরজা খুলতেই মনোজ বলল কখন থেকে কলিং বেল বাজাচ্ছি।
'কি করবো বলো?'
"কি করবো মানে?"
আসলে এত টাই নস্টালজিক হয়ে গেছে যে ,সুখের কিছু মুহূর্ত রোমন্থন করছে।
রেখা বলল "কিছু স্মৃতি আছে যেগুলো ভোলা যায় না ।শুধু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।'
মনোজ বলল 'কে ফোন করেছিল?'
'বনমালী মামা।'
'কেন?'
'কি ভাবে পৌঁছেছেন তার কথাই বলছিলেন।'
আবার অন্য একদিন আসবেন,.।'
মনোজ বলল 'আসলে বনমালী মামার জন্য কষ্ট হয় ,ওপরটা এরকম হাসিখুশি নিয়ে থাকেন অথচ ভেতরটা না জানি কতটা যন্ত্রনা।'
রেখা বলল "আমরা জানি বলেই হয়তো ,মামার ভেতর দিয়ে….।'
এ যেন গানের কথা তুমি বলতে ইচ্ছে করে'মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে। কৃষ্ণচূড়ার বন্যায় চৈতালি ভেসে গেছে।'
"দারুন বললে তো 'মনোজ বলল।
রেখা বলল' এরকমই হয় জান তো বিরহী মন সব সময় রয়ে যায় ,মনের দুয়ারে দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরের দুয়ারে এসে জায়গা নিতে। এ এক অন্তবিহীন যাত্রা।
আজ বনমালী মামার ভেতরে যে টানাপোড়েন চলছে তা মাতলা নদীর ঢেউয়ের থেকে কম নয়।'