ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৩)
শামীমা আহমেদ
কিছুক্ষণ যাবৎ একটানা কলিং বেল বেজেই চলেছে।শায়লা মায়ের ঘরে মায়ের পাশে চুপচাপ বসে আছে। কলিং বেল শুনছে কিন্তু দরজা ভেতর থেকে লক করা রয়েছে। তাই সে এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। সে একমনে শিহাবকেই ভেবে চলেছে। গতকাল সারাদিন শিহাবের সাথে কাটানো সময়গুলো ভীষণভাবে মনে পড়ছে। শিহাবের প্রতিটি কথা প্রতিটি আশ্বাস শায়লাকে বেঁচে থাকবার প্রেরণা যোগায়। তার খুব করে মনে পড়ছে পরিচয়ের পর থেকে কিভাবে একটু একটু করে দুজনার ভাললাগা আর তা প্রকাশের ছোট্ট ছোট্ট ক্ষণগুলো। এখন তো অন্য এক শিহাব তার সামনে দাঁড়িয়ে। যে কিনা তার জীবনের পিছনের সব কিছু ঝেড়ে ফেলে শুধু শায়লাকেই আপন করে নিয়েছে। শায়লাও তার মনের চাওয়ার বিরুদ্ধে কিছুই করবে না।
কিন্তু আজ দুপুরের ফ্লাইটে নোমান সাহেব দেশে আসবেন। তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় আনার সকল প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। গতকাল বাসায় শায়লার দীর্ঘক্ষণ অনুপস্থিতি আর মায়ের অসুস্থতায় আয়োজনে কিছুটা ভাটা পড়লেও বুঝা যাচ্ছে আজ তারা সবাই আবার পূর্ণ উদ্যমে নামবে। সবই শায়লার মনে বিরুদ্ধে। অবশ্য কেউই আর তার ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য নিয়ে চিন্তিত নয়। দুপুরের মধ্যেই বাসায় আত্মীয় স্বজনেরা চলে আসবে।
কলিং বেল শুনে রাহাত ঘুম থেকে জাগলো।সে দরজা খুললো। বুয়া ঘরে ঢুকলো।রাহাত তাকে মায়ের জন্য দ্রুত নাস্তা বানাতে বললো। শায়লা মায়ের ঘর থেকে সবই শুনলো। বুঝা গেলো, রাহাত সংসারের দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই নিয়েছে। আজ আর কিছুতে শায়লার পরামর্শ বা মতামতের প্রয়োজন মনে করছে না। কেনই বা করবে ? আর ক'দিন পর তো শায়লা আর এ বাড়িতে থাকছে না। তখনতো রাহাতকেই সবকিছু সামলাতে হবে।
মায়ের ঘুম ভাঙলো।শায়লা মাকে খুব যত্ন করে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। যাবতীয় কাজে সহযোগিতা করে মায়ের শাড়িটা বদলে দিলো। মা একেবারেই নীরব হয়ে আছেন। তবে চোখে মুখে তার স্বস্তির প্রকাশ। শায়লা বাসায় ফিরে এসেছে। শায়লা তার প্রথম সন্তান।প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের অন্যরকম ভালবাসা জমানো থাকে আর সাথে থাকে নির্ভরতা। আর শায়লাতো মায়ের পুরোটাই খেয়াল রাখে।
নাস্তা তৈরি হলে শায়লা মাকে ডাইনিং এ নিয়ে এলো। রাহাত তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের শরীরের খোঁজ খবর নিলো।
ভাই বোন মা এক টেবিলে নাস্তা পর্ব চললেও ভাই বোনের আর সেই আগের মত কথা বলে গল্প করে নাস্তা করার চিত্রটি আজ ভীষণভাবে অনুপস্থিত। খুব নীরবেই নাস্তা করা হলো।বুয়া তিন কাপ চা করে আনলো।এবার রাহাত শায়লার দিকে বেশ রিল্যাক্স ভঙ্গিতে কথা বলে উঠলো। গতকালের কোন ঘটনাকেই রাহাত আর আলোচনায় আনলো না। আজ সকাল থেকে আবার সবকিছু যেন সুন্দর করে এগিয়ে চলে।তাছাড়া আজ নোমান সাহেব আসবেন।যে করেই হউক আপুকে শান্ত রাখতে হবে।
আপু, আমরা সবাই দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে নোমান ভাইয়াকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাবো। তুমি তৈরি থেকো। তুমি যেন অবশ্যই এয়ারপোর্টে যাও নোমান ভাইয়া বারবার বলেছে।
রাহাতের কথায় শায়লা বেশ অবাকই হলো! আজকাল নোমান সাহেবের সাথে তাকে নিয়ে রাহাতের এত কথা হয়! যদিও নোমান সাহেব তাকেও লাল শাড়ি পরে এয়ারপোর্টে যেতে বলেছে। শায়লার এইসব কিছুতে ভীষণ বিরক্তি লাগছে। মন থেকে সে কোন রকম আগ্রহবোধ করছে না।রাহাত শায়লার কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে ডাইনিং থেকে নিজের ঘরের ভেতরে গেলো। মুহুর্মুহু আত্মীয়স্বজনের কল আসছে।কে কখন আসবে তা জানাচ্ছে।ছোট কাজিন ভাইবোনেরা আজ সন্ধ্যায় ছাদে গায়ে হলুদের আয়োজন করেছে। শায়লা এবং নোমান সাহেবের একসাথে হলুদ ছোঁয়াবে।
শায়লার ঘরটিকে ফুল দিয়ে বাসর ঘর সাজানো হবে। বাসায় ঝামেলা এড়াতে প্রচুর খাবারের অর্ডার করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ি রীতিমতো সরগরম হয়ে উঠছে।গতকাল শায়লার পার্লারে যাওয়ার কথা থাকলেও সে শিহাবের সাথেই পুরো সময়টা কাটিয়েছে।তাই রাহাত আজ পার্লারে যাওয়ার অন্য ব্যবস্থা করেছে।
শায়লার বড় মামার মেয়ে বুবলী ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া। ধরতে গেলে সিরিয়ালে শায়লার পর তার বিয়ের আয়োজন হওয়ার কথা। পাত্র পক্ষ আংটি দিয়ে রেখে গেছে।মাস্টার্স ফাইনাল হলেই বিয়ে।এছাড়া সিরিয়ালে আরো কয়েকজন কাজিন বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠছে।সে ক্ষেত্রে শায়লার বিয়ের পর্ব,শায়লাকে জামাই বাড়িতে নিজের সংসারে পাঠানো খুবই জরুরী হয়ে গেছে। মুরুব্বিরা যার যার মেয়ে নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু শায়লা কিভাবে বুঝাবে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই আয়োজন তার কাছে অর্থহীন। তার সম্পূর্ণ মন প্রাণ জুড়ে আছে শিহাবের স্পর্শ, শিহাবের ভালোবাসা।
শায়লার ফোনে বুবলীর কল। ইচ্ছে না করলেও কলটা ধরতে হবে। ওদেরতো আর শায়লার এতকিছু জানা নেই।শায়লা কল রিসিভ করতেই বুবলী উচ্ছাসে ফেটে পড়লো!
আপু, তুমি অপেক্ষা করো।এইতো কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি চলে আসছি। তোমাকে নিয়ে পার্লারে যাবো। তোমাকে একটু ফ্রেশ হতে হবে। বাসার কাছে কোন পার্লার আছে আমাকে জানিও। শায়লা আচ্ছা বলে কল রেখে দিলো। সে বুঝতে পারলো কেন বুবলী এত উচ্ছ্বসিত! কারণ শায়লার পরপরই তার আয়োজন এগিয়ে আসছে। চট করে শায়লার মনে একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। তাহলে পার্লারের কথা বলে এয়ারপোর্টে যাওয়াটা এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
শায়লা তার মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে এলো।শিহাবকে মেসেজে জানালো, সেক্টর ছয় এ আগোরার উপরে আটতলায় পারসোনা পার্লারে এক ঘন্টার মধ্যেই সে যাচ্ছে। শিহাব যেন তার জন্য সেখানে অপেক্ষা করে। শিহাব মেসেজ দেখে নিলো।মনে মনে জায়গাটা ভেবে নিলো। সে দ্রুতই নাস্তা সেরে গতকালের কাপড় পালটে শায়লার কলের অপেক্ষাতেই ছিল। শায়লার সাড়া পেয়ে তার মন আনন্দে নেচে উঠলো! মনে মনে ভেবে নিলো,
এবার আর সে শায়লাকে হারাতে চায়না। দেখামাত্রই বাইকে তুলে নিবে। যদি উত্তরাতে থাকতে ওরা ঝামেলা করে তবে আজই ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যাবে।
বাসায় রুহি খালা এসেছে।ডাইনিং এ বসে মায়ের সাথে কথা বলছে। শেষ মূহুর্তের সকল প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা চলছে।যদিও তার চোখ সারাক্ষণ শায়লাকেই খুঁজছে।তাকে কাছে পেলে হয়তো কিছু জ্ঞান ঝাড়তেন।কিভাবে স্বামী সংসার নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে হয় তার একশ একটি তরিকা বাৎলে দিবেন।
রুহি খালার চোখে মুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে।অবশেষে সে শায়লাকে কানাডা পাঠানোর সব ব্যবস্থা করতে পেরেছে। তিনি নিজে নিজেই আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলছেন!
শায়লা দূর থেকেই সবকিছু দেখছে।সে আর কাছে গিয়ে আলোচনার টেবিলে যোগ দেয়নি। রাহাতের ফোন সারাক্ষণই ব্যস্ত থাকছে। কল আসছে,কল যাচ্ছে।কিন্তু শায়লাকে সময় দেয়ার,শায়লার কথা শোনার এতটুকুও আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বাসার ভেতরের সামগ্রিক পরিস্থিতি জানিয়ে শায়লা শিহাবকে মেসেজ করেই যাচ্ছে।শিহাব সবকিছুতেই শায়লাকে শান্ত থাকতে বলছে।
শিহাব শায়লার জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে আছে।সে একবার তার ঘরের চারিদিকে তাকালো। শিহাব এই ভেবে পুলকিত হলো যে, আর কিছুক্ষন পরেই শায়লা আমার এই ঘরে চলে আসবে। আমার শূন্য ঘরটা শায়লার চলাচলে প্রাণ ফিরে পাবে। আমি আর কোনদিন শায়লাকে হারিয়ে যেতে দিবো না। শিহাব চোখ বন্ধ করে শায়লাকে এক নিঃশ্বাসে ছুঁয়ে নিলো !
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বুবলী চলে এলো। একটা সবুজ চুন্দ্রী প্রিন্টের শাড়িতে বুবলীকে খুব সুন্দর লাগছে। যেন বুবলীরই বিয়ের ফুল ফুটেছে ! অবশ্য একসময় রাহাতের প্রতি বুবলী কিছুটা দূর্বল ছিল। ছোটবেলায় স্কুল কলেজে পড়ার সময় যখন আসতো তখন শুধু রাহাতের পিছনে ঘুরঘুর করতো। বুবলীর মায়ের কড়া নির্দেশ আর ভীষণ আপত্তিতে বুবলী এ সম্পর্ক খুব বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেনি।
অবশ্য বর্তমানে রাহাতের অবস্থানে বড়মামীর ভীষণ আফসোস চোখে মুখে একেবারে স্পষ্ট! তবে বুবলী ভেতরে সেই ভালো লাগাটা আজো পুষে রেখেছে। ঘরে ঢুকেই সে আড় চোখে রাহাতকে একটু দেখে নিলো। রাহাত বুবলীকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তার গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে বুবলীর দিকে তাকালো। যদি এই তাকানোতা বুবলী ঠিকই এক নজর দেখে নিলো। তারও কিছু ভালোলাগা ছিল।তবে আজ আর এসব ভেবে লাভ নেই।বুবলীর এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে।
কেমন আছো রাহাত ভাইয়া ? বুবলীর সেই স্বভাবসুলভ চটপটে বাচনভঙ্গি!
আমি ভাল আছি।তা তোমরা কখন বেরুবে ?
এইতো এখুনি ভাইয়া।
ঠিক আছে দ্রুত চলে যাও।নীচে একটা সিলভার কালারের প্রাইভেট কার আছে। আমার বন্ধুর।আজ সারাদিনের জন্য দিয়েছে।আমাদের সাথে থাকবে।তোমরা গাড়িটা নিয়ে পার্লারে যেও।
শায়লা সবই বুঝতে পারলো।রাহাতের কেন এত কর্ম তৎপরতা! কেন এত নিরাপত্তা ? প্রহরী দিয়ে দেহের নজরদারি রাখা যায় কিন্তু মনকে তো আর কেউ ফেরাতে পারেনা। মনতো পুরোপুরি শিহাবের দখলে। শায়লা আজীবনই শিহাবকে ভালোবাসবে।শিহাবের সাথেই বাকী জীবন কাটাবে।
রাহাত বুবলীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। আমরা সবাই মিলে এয়ারপোর্টে যাবো।
জ্বি আচ্ছা ভাইয়া। যদিও বুবলী রাহাতের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রাহাতের প্রতি সলজ্জ চাহনী আজো যে তার মনে রাহাতকে ভালো লাগার রেশ রয়ে গেছে তা স্পষ্ট!
শায়লা মাকে সালাম করে ঘর থেকে বেরুলো। মনে মনে সে মায়ের কাছ থেকে শিহাবকে পাওয়ার দোয়া চেয়ে নিলো।যদিও মায়ের তা বুঝা হলো না। মায়ের চোখে পানি টলমল করছে। তিনি শায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দিলেন। আজ তার মেয়ের স্বামী কানাডা থেকে আসছেন। মেয়েটা দশদিন পর কানাডা চলে যাবে।কোন দূরদেশে থাকবে। ভাবতেই মায়ের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। তাদের পাঁচজনের সুখী সংসারটা থেকে একেএকে তিনজন চলে যাচ্ছে। ঘর খালি হয়ে যাচ্ছে। শায়লার চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।কাজের বুয়া শায়লার মাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলো।
কি আর করবেন খালাম্মা। মাইয়াগো এইটাইতো জীবন। বাপ মা লাইলা পাইলা অন্যের বাড়িত পাঠাইয়া দেয়। আপনি আমিও বাপের ঘর ছাইড়া আইসা পরের ঘর করতাছি। চিন্তা কইরেন না, আমগো রাহাত ভাইজানরে বিয়া করাইলে আবার আপনার গড় নাতিপুতিতে ভইরা যাইবো।
মায়ের এত উৎকন্ঠায় শায়লা তাইতো মনে মনে ভাবছে,শিহাবের কাছে থাকলে তো মা তুমি আমায় প্রতিদিনই দেখতে পাবে।আমি তো প্রতিদিনই তোমার কাছে আসতে পারবো। এমনি করে ভাবলেও শায়লার মনের কথাটি মনের ভেতরেই রয়ে গেলো।
চলো আপু দেরী হয়ে যাচ্ছে।বুবলী তাড়া দিতেই রাহাত বলে উঠলো চলো আমি তোমাদের পার্লারে নামিয়ে দিয়ে আসি। গাড়িটা অযথা ওখানে বসিয়ে না রেখে আমি একটু বেরুবো। তোমাদের হয়ে গেলে আমাকে জানাবে।আমি গাড়ি নিয়ে চলে আসবো।
রাহাতের এমন কথায় শায়লা ঠিকই বুঝে নিলো কেন রাহাত তাদের সঙ্গী হতে চাইছে।
ভালোই হবে।শিহাব ওখানে থাকবে। রাহাতকে জানিয়েই সে শিহাবের সাথে চলে যেতে পারবে।
গাড়ি পারসোনা পার্লারের নিচে থামতেই শায়লার উৎসুক চোখ গাড়ির ভেতর থেকে শিহাবকে দেখতে পেলো। মেরুন রঙা শার্টে সেই সানগ্লাস সেটে দেয়া কাঙ্খিত মুখখানি বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শায়লাকেই খুঁজছে যেন! রাহাতও শিহাবকে দেখতে পেলো।
গাড়ির ভেতর রাহাত আর শায়লার দৃষ্টি বিনিময় হলো।রাহাত শিহাবকে দেখে ভীষণ চমকে গেলো ! বুবলী গাড়ি থেকে নেমেই শায়লাকে বের হওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলো। শায়লা বেরিয়ে এলেও তার মন বারবার শিহাবের দিকেই ফিরছিল যেন!
চলবে....