উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৩৩
পরতে পরতে ভালোবাসা
মমতা রায়চৌধুরী
কল্যাণের কথা ভাবতে ভাবতেই শিখার অনেক রাত হয়ে গেল । বেড সুইচ টিপে এক ঝলক হলুদ আলোর মধ্যে চোখমুখ কুঁচকে উঠে বসলো শিখা। বিকেলবেলা কল্যাণের সঙ্গে ঘুরে ফিরে আসার পর ওই যে শুয়েছে, মাধুর অনুরোধে খেতেও গেল না। সারা শরীর মন জুড়ে যেন সেই উষ্ণতার স্পর্শ রয়ে গেছে ।না কোনকিছুই আজকে আর ভালো লাগছে না আর কোন কিছু নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না।
কল্যাণকে যে একটা ফোন দেবে সেটাও সাহসে কুলাচ্ছে না আসলে কল্যান কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস ।হয়তো যে বিষয়টা নিয়ে লিখছে সেই বিষয়টা কমপ্লিট না হলে কল্যান রেগে ও যেতে
পারে। মাঝখানে ফোনটা করলে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। ঘুম আসছেনা অপরিসীম একটা ক্লান্তি লাগছে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করছে অথচ কোন চোখে ঘুম নেই। শিখা এক সময় উঠে টেবিলের কাছে গেল কাগজপত্র বইপত্রের একটা অসামঞ্জস্য ভাবে পড়ে আছে যেন দেয়াল চাপা পড়ে গেছে । তারপর একসময় ড্রয়ার খুলে লম্বা একটা খাম বের করলো এরকম আমি ব্যক্তিগত চিঠি পত্র লেখে না। অ্যাপ্লিকেশন লিখে পাঠায়। নীল কালিতে লেখা পরিষ্কার করে একটা কোনায় তারিখ। আরো অনেকখানি শূন্যতা উপরে নিচে বাঁ দিকে চাপ বেঁধে আছে। উল্টেপাল্টে দেখল খামটা। তারপর দেখতে পেল এক একটা কাগজে আঁকা একটা তারিখ দেওয়া।
শিখার বুঝতে অসুবিধা হয় না চিঠিটা কার?
দিব্যেন্দুর কথায় আর লেখায় অনেক আসমান জমিন তফাৎ থাকতো।
তবু একটা চিঠি রেখে দিয়েছে শিখা। কেন যে অতীত স্মৃতি আঁকড়ে বসে আছে সেটা বুঝতে পারে না। আজ কল্যাণের থেকে যে ভালোবাসা যে সম্মান পেয়েছে সেখানে তো সবকিছু ভুলে যাবার কথা। তার পরেও সেই স্মৃতি আঁকড়ে চিঠি থাকে কেন কাছে রেখেছে। মনেরি অজান্তে বারবার চিঠির অক্ষরগুলি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
একটা চিঠি ছিল এরকম
১২/২
আর যেন মন কেমন করছে। তোমার জন্য মনটা ছটফটিয়ে রয়ে গেছে। আচ্ছা বলতো কেন এমন হচ্ছে? বসন্ত তো দোরগোড়ায় এসে গেছে। বাসন্তী রং তুমি সেজেছো কি অপরূপ লাগছে। কৃষ্ণচূড়া পলাশের রঙে আজ তুমি সেজেছো। তোমাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। তোমার সুমিষ্ট কুহুতান প্রানো মনে ভরে নিতে ইচ্ছে করছে। আগামীকাল তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে ।শুনতে পাচ্ছ?'
কোথায় গেল সেই টান কোথায় গেল সেই ভালোবাসা নাকি সেটা পুরোটাই ছিল একটা
মোহ , সাময়িক ক্রাশ। নইলে কি করে পারে শিখাকে ছেড়ে অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে।
চিঠিটা পড়ে যেটুকু ভালোলাগা মনের ভেতরে ছিল আবার এক রাশ বিরক্তি তিক্ততায় মনটা ভরে উঠলো।
চিঠিটা হাতে নিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে শিখার।
হঠাৎ মনে হলেও একবার কি করলেন কে ফোন করবে গলাটা কেমন আছে কে জানে নাকি এখনো ল্যাপটপে বসে তার লেকচার রেডী করছে।
ওটাকে ঘুরিয়ে নেবার জন্য কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করল আর ভাবলো একবার করেই দেখি না কি হয়।
শিখা ফোন করলো। কল্যাণের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল' মনের হদিস কে বা জানে….,.।'
ফোন বেজে গেল। শিখা ভাবলো না থাক বিরক্ত করে লাভ নেই কাজের ব্যাপারে কল্যান ভীষণ সিরিয়াস।
এবার শিখার ফোন বেজে উঠলো'শিখা রিংটোন বাজতে শুরু করলো'আমার পরান যাহা চায় ,তুমি তাই….,.,.।'
শিখা ভাবল কি হলো রে বাবা তাড়াতাড়ি এসে ফোনটা রিসিভ করল বলল' হ্যালো'।
"হ্যাঁ ,কল্যান বলছি।'
হ্যাঁ আমি ফোন করলাম তোমায়।
আসলেই এই মাত্র লেখাটা কমপ্লিট করলাম তো তাই ফোনটা তখন ধরতে পারিনি
বাবা এতক্ষণ ধরে লিখলে?
হ্যাঁগো কোথাও গিয়ে লেকচার দিতে হলে একটু ভেবেচিন্তেই লিখতে হয় ।
তাহলে তোমার তো আমি ডিস্টার্ব করলাম।
না না আর ডিস্টার্ব করতে আমার লেখা তো কমপ্লিট।
থ্যাংকস গড।
নাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো।
শোনো না কিছু খেলে?
না বৌদি ডেকেছিল খাইনি কিছু।।তুমি কি খাবে এখন?
মাসি ডিম টোস্ট করে রেখে গেছে।
এত রাত্রে খাবে ডিম টোস্ট?
তাছাড়া উপায় কী বলো?j
আর একটা জিনিস অবশ্য আছে খেলে হয়।
কি বলতো?
ওটস.।
তা বেশ যেটা ভালো লাগে খাও।
তোমার মন ঠিক হয়েছে?
শিখা বললো' ওই আছে '।
কেন ?কেন?
মনটা খারাপ?
কি জন্য আমায় বলো।
শিখার যেন মনে হলো তার মনের ভেতরে একটা আকাশ অখণ্ডতার বৃষ্টিতে কি বিপুলতা কি অবকাশ। হঠাৎ মনে হল যেন কল্যাণের কথায় একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো যদিও ঝরঝর দুর্গন্ধ আছে বাতাসে বিশাল সাদা আকাশে এমন ফ্যাটফেটে জ্যোৎস্নায় গদগদ চাঁদপাড়া মুখ। পূর্ণিমা যেন তাকে ভাসিয়ে রেখে রেখেছে
হঠাৎ কল্যাণ বললো কি ব্যাপার চুপ করে গেলে যে।
হ্যাঁ বলো।
আসলে তুমি চুপ করে গেলে তো তাই?
তোমার গলাটা এখন কেমন?
নাগো তেমন সুবিধার মনে করছি না।
দেখো কালকে আবার তোমার লেকচার আছে কি যে হবে। গারগিল করে নাও।
হ্যাঁ,করব।
ঠিক আছে ঘুমিয়ে পড়ো।
শুভরাত্রি।
শুভরাত্রি শিখা বলল।
শিখা চেয়েছিল আর একটু কথা বলতে। কিন্তু কি কথা বলবে কল্যাণের সঙ্গে যখন কথা বলে তখন আর থৈ পায় না কি কথা বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।
আসলে সংলাপ এমন একটা প্রবাহ সে তার ছন্দ নিয়ে এগিয়ে চলে হঠাৎ ছন্দপতন হলে কথাগুলো সব থেমে যায় আবার নতুন করে শুরু করতে
হয় । আবার কাঠ খড় পোড়াতে হয়।
এবার শিখা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ভাবতে লাগলো সে আছে সব সময় তার ভালোবাসার আঙ্গিনায় এ কথাটা যেন সে মনে রাখে। ভালোবাসার স্বপ্নচূড়ায় সেই ভাবনা গুলোকে শিখা জমিয়ে রেখেছে। যেদিন তাদের এই ভালোবাসার পরিণতি লাভ করবে সেদিন সে তার জমানো যত টুকরো টুকরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস সবগুলোকে সে সঙ্গে উপহার দেবে। শুধু এটুকু জেনে রাখ যেন।
আজ শিখার মনে লেগেছে বসন্ত স্পর্শ। তাই কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে
': এই না হলে বসন্ত কিসের
দোলা চাই অভ্যন্তরে,
মনের ভিতর জুড়ে
আরো এক মনের মর্মর।'
সত্যিই তাই আজ শিখার মনের মর্মরে লেগেছে দোলা কল্যান বসন্তে।"
আজ গানের সুরে তাই বলতে ইচ্ছে করছে 'তুমি পাহাড় হলে/ ,আমি
সবুজ ।তুমি অরণ্য হলে, /আমি
পাখি ।আকাশ হলে/আমি শঙ্খচিল। তুমি শ্রাবণ হলে/আমি শ্রাবণ ঢল।
তুমি বন্যা হলে /আমি সুনীল…'
আজকের দুমুঠো বিকেল এর ভালোবাসার স্পর্শ পরতে পরতে জড়িয়ে শিখা চলে যায় ঘুমের দেশে।
ও কল্যাণের হাতির সঙ্গে শিকার হাত যখন স্পর্শ করেছিল সেখানে নিজের মধ্যে ছিল না যেন বুকের রক্ত ছলকে উঠেছিল। উষ্ণতার পারদ চরছিল দ্রুত হারে।
কল্যাণ এক হাত দিয়ে শিখাকে কাছে টেনে নেয় একেবারে বুকের কাছে। এই প্রথম কোনো পুরুষের বুকে মাথা রেখে ছিল শিখা। হয় হয় পরিণতিটা শেষ পর্যন্ত যেন পায় ভালোবাসার স্পর্শ পরতে পরতে নিয়ে সে বাকি জীবনটা কাটিয়ে যেতে চায়। আর দিব্যেন্দুর বেখেয়ালি ভাবনাগুলোকে সে পানিতে ভাসিয়ে দিতে চাই নদীর দুরন্ত স্রোতে।