ধারাবাহিক গল্প
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৬৮)
শামীমা আহমেদ
বিকেলে শিহাবের চায়ের দাওয়াত পেয়ে শায়লার মনে অন্যরকম একটা ভালো লাগার অনুভুতি হলো। যেন এক পশলা বাতাস ছুঁয়ে গেলো ! শিহাবের সাথে কথা হওয়ার পর থেকে শায়লার দু'চোখের পাতা আর এক হয়নি। বাকী সময়টা সে জেগে জেগেই ঘুমালো।আর বারবার দেয়ালে বড় ঘড়িটার দিকে তার চোখ পড়ছিল।সেকেন্ডের কাঁটার একটা একটা করে ঘরের চলন আর তার ভেতরে শিহাবকে দেখার আনন্দে একটু একটু করে এগিয়ে চলা। হঠাৎ করে এমন প্রাপ্তি ভেতরটায় কেমন যেন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো! শায়লা ভেবে নিলো,সে আজ চিকন জরি পাড়ের সেই কালো কোটা শাড়িটি পরবে।শাড়িটার বুনন খুবই হালকা।পরলে মনে হয় পাখির পালকের মত অনুভুতি। আর শাড়িটায় শায়লাকে বেশ উজ্জ্বলও দেখায়।যদিও শিহাবের পাশে তাকে একটু অনুজ্জ্বলই লাগে। অবশ্য এ কথা শুনলে শিহাব ভীষণ রেগে যায়। যদিও শায়লা নিজেকে বুঝে কিন্তু তবুও শায়লা লক্ষ্য করেছে শাড়ি পরলেই তার দিকে শিহাবের যেন সপ্রতিভ একটা দৃষ্টি !
চারটার দিকে শায়লা বিছানা ছাড়লো। একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে চুল আঁচড়ে নিলো। মন চাইছে চুলটা খোলাই রাখবে আজ। শাড়িটা বের করতেই মনে পড়ে গেলো রাহাত চাকরীর প্রথম বেতন পেয়ে শায়লার জন্য শাড়িটা কিনে এনেছিল ! সেদিন শায়লার আনন্দে চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সে ভাবলো,রাহাত এখন যেমন আচরণই করুক না কেন তার জন্য রাহাতের ভেতরে এক গভীর ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। সেটা ভাইবোনের অজানা নয়।শায়লা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে চট করে শাড়িটা পরে নিলো। কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ বসিয়ে আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে নিলো।আসলে সে নিজেকে না, শিহাবের চোখে যেন নিজেকে দেখছিল।আজ তাকে দেখে শিহাবের ভালো লাগবে তো? শায়লাকে দেখে সে কি চমকে উঠবে! শিহাব কি আজো বলবে, শায়লা তোমাকে আমি একদমই চিনতে পারিনি আজ! কালো শাড়িতে তোমার এমন মুগ্ধ করা সাজ, আমার চোখ ফেরানো দায়! এখন তোমায় একগোছা দোলনচাঁপা উপহার দিতে
মন চাইছে বলেই শিহাব তার বাইক থামিয়ে ফুল খুঁজতে থাকবে।
শায়লা ভাবনার অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এলো। সবকিছু ঠিকঠাক মত গুছিয়ে নিলো। মায়ের প্রেসক্রিপশন আর টাকা। সাথে ঘরের কিছু টুকটাক কেনাকাটাও আছে। ওষুধ কিনে একটা সুপার শপে ঢুকতে হবে। শায়লা ঘরের চাবি হাতে নিয়ে নিলো।শিহাবকে মেসেযে জানিয়ে দিলো।আমি বেরুচ্ছি।তবে কাজ শেষ করে কল দেবো।
শায়লা দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই রুহি খালা তার ঘরের দরজায় দাঁড়ানো।যেই ওৎ পেতেই ছিল।শায়লাকে একেবারে খপ করে ধরবে! শায়লা নামতে গিয়ে একটু ইতস্তত করছিল।এখুনিতো প্রশ্নের জেরার মুখে পড়তে হবে। পরক্ষণেই শায়লা নিজেকে শক্ত করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।
কোথায় যাও শায়লা ?
এইতো খালা কালতো মা আসবে রাহাত বললো মায়ের ওষুধগুলো এনে রাখতে তাই বেরুচ্ছিলাম।
খালা একেবারে দারুন অভিভাবক হয়ে বললেন, নাকি সন্দেহের বশেই বললেন, ওষুধ আনতে তোমার যাইতে হইবো ক্যান? তোমার খালু এখন আছরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাইবো।তারে ট্যাকা আর প্রেসক্রিপশনটা দিয়া দাও ওষুধ আইনা দিবো। শায়লা ভাবলো এতো আসলে সাহায্য না,শায়লাকে গৃহবন্দী রাখার পাঁয়তারা। শায়লাও তার বুদ্ধি খাটিয়ে বললো অবশ্যই খালা এই নেন মায়ের প্রেসক্রিপশন আর এইযে টাকা।শায়লা ব্যাগ থেকে এসব বের করে দিলো।শুধু বললো খালুজি যেন ওষুধের মেয়াদের তারিখ ভালো করে দেখে আনেন। শায়লাকে ফেরাতে পেরে রুহি খালা এক তৃপ্তির হাসি দিতেই শায়লা বললো, তবে খালা আমার নিজের কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা আছে।আমাকে যেতেই হবে।বলেই শায়লা গটগট করে বেরিয়ে এলো।রুহি খালা শায়লার কর্মকান্ডে রীতিমতো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো!রুহি খালা ভাবলেন,শায়লার আজকাল অনেক পরিবর্তন। সে আর সেই আগের মত বোকাসোকা মেয়েটি নেই।খুবই চালাক হয়ে গেছে নয়তো কেমন করে সে তাকে বোকা বানালো !
শায়লা মেইনগেটের বাইরে এসে একটা রিকশা ডাকলো আর ভেবে নিলো সময় যখন পাওয়া গেলো আজ শিহাবের জন্য একটা উপহার কিনবে।শায়লা ভাবলো যেহেতু সে আজ শিহাবের বাসার অতিথি তাই সে কিছুতেই খালি হাতে যাবে না।সে ট্রাস্ট ফ্যামিলি নীডস'এর দিকে রিকশাওয়ালাকে এগিয়ে যেতে বললো।
শিহাব খুব দ্রুতই হাতের কাজগুলো সেরে নিলো। অফিস এসিস্ট্যান্ট ছেলেটা, কবিরকে
সব বুঝিয়ে দিয়ে বেরুনোর জন্য নিজেকে তৈরি করে নিলো। শায়লাকে নিয়ে আজ খুব সুন্দর একটা বিকেল কাটতে যাচ্ছে ! শিহাবের মন আনন্দে নেচে উঠলো!সে শায়লার ফোন কলের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো।বারবার মোবাইল স্ক্রিনে চোখ যাচ্ছিল। এইটুকু সময়ের ব্যবধান তবুও খুবি দীর্ঘ লাগছে। ওয়াশরুমের আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিলো।আয়নায় চোখ পড়তেই নিজের দিকে যেন নিজেই প্রশ্ন রাখল।শিহাব তুমি যা করছো তা কি ঠিক হচ্ছে ? কেন নিজের মনকে শায়লার দিকে এতটা নিয়ে যাচ্ছো ? শিহাব এর কোন উত্তর দিতে পারছিল না।হঠাৎই শায়লার মুখচ্ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। শিহাব তার কাছেই প্রশ্নটা রাখলো।
শায়লা বলতে পারো আসলেই আমাদের গন্তব্য কোথায় ? শায়লা যেন কথা বলে উঠলো, তোমার আমার গন্তব্য এক। দুজনেরই এক ঠিকানার দিকে যাত্রা।আর সেটা ভালোবাসার ছোট্ট নীড়ের দরজায় প্রবেশের অপেক্ষায়। শিহাব যেন একটু আশ্বস্ত হলো।অফিস ওয়াশরুমে রাখা 'পয়জন'স্প্রে সারা গায়ে স্প্রে করে নিলো।এটা তার খুবই প্রিয় সুগন্ধি। অপূর্ব সুবাসের মোহময়তায় মনে হলো যেন শায়লার হাতের ছোঁয়া পেলো!শিহাব মনে মনে ভাবলো শায়লা আজ তার বাসায় প্রথমবারের মত আসছে। শায়লার জন্য একটা উপহার কিনে নিতে হবে। বলেই শিহাব ঘড়ি দেখলো। শিহাব ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই শায়লার মেসেজ এলো।শায়লা বেরুচ্ছে। শিহাব নিজেও মানসিকভাবে তৈরি হয়ে নিলো। মোবাইলে একটা উপহারের অর্ডার প্লেস করলো। বাসার এডড্রেস জানিয়ে দিলো। বিকাশ পেমেন্ট করে বাইকের চাবি আর সানগ্লাস নিয়ে বেরুনোর জন্য উদ্যত হলো। কবির সালাম দিতেই তাকে একশত টাকাত একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বললোতুমি বিকেলে নাস্তা করে নিও। আর ভালো মত সবকিছু গুছিয়ে লকআপ করে রাখবে। কাল সকালে চলে আসবে।
মোবাইলে শায়লার মেসেজ এলো,আমি কোথায় দাঁড়াবো ?
শিহাবেরভেখন মেসেজ লেখার ইচ্ছে নেই।সে শায়লাকে কল দিলো,তুমি কোথায় আছো ?
এইতো বাসার কাছেই।
শিহাব হিসেব করে নিলো,তবে কাবাব ফ্যাক্টরির অপজিটে ফুলের দোকানগুলোর কাছে দাঁড়ালে শিহাব সহজেই তাকে বাইকে তুলে নিতে পারবে।
শায়লা শিহাবের কথামত ফ্যামিলি নীডস থেকে বেরিয়ে ফুলের দোকানগুলোর কাছে রিকশা থামালো। আহ! চত্ত্বরটা যেন ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে! শায়লা শিহাবের অপেক্ষায় রইল।হাতে উপহারের ব্যাগটিকে পরম ভালবাসার আগলে রইল।
দুমিনিটের মধ্যেই শিহাবের বাইক শায়লার কাছে এসে থামল।যদিও হেলমেট থাকায় বুঝা যাচ্ছিল না আসলে বাইকের চালকটি কে? সানগ্লাস চোখে একটা লাল সাদা প্রিন্টেড শার্টে শিহাবকে খুব সুন্দর লাগছিল।হেলমেট খুলতেই শায়লার চোখ আনন্দে নেচে উঠলো! বাইক স্টার্ট রেখেই শিহাব বললো চলে আসো শায়লা।আজ আর শায়লার মনে কোন বাধাই কাজ করলো না।সে দ্রুতই উঠে শিহাবের পিছনে বেসে নিলো।শিহাব হেলমেট ঠিক করে একটু দূর এগিয়ে গিয়ে বাইক থামালো। "টেইস্টি ট্রিট" ফাস্ট ফুডের শপে বাইক থামিয়ে শায়লা রেখে শিহাব নিজেই শপে ঢুকলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাতে কিছু খাবার নিয়ে বেরিয়ে এলো।সরি শায়লা তোমাকে অপেক্ষায় রাখলাম।
কিছু হবে না,আমি ঠিক আছি।
চায়ের সাথে একটু টা নিয়ে এলাম।বলেই শিহাব দারুণ মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো
শায়লা অবাক হয়ে সেই হাসির মাঝে হারিয়ে গেলো!
শিহাব বাইক স্টার্ট দিলো।সেক্টর তের নম্বর এর ব্রীজ পেরিয়ে সোজা এগিয়ে বাইক যেন হাওয়ায় ভেসে চললো।শায়লার বহু চেনা পথ
আজ শিহাবের সংস্পর্শে অন্যরকম ভালোলাগায় আবেশিত করলো।
বাইক লুবানা হাসপাতালের পিছনের রোডে ঢুকে একটু এগিতেই শিহাবের বাইক থামলো। দারোয়ান গেইট খুলতেই বাইক গ্যারাজে ঢুকল।দুজনে নামতেই সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে একটা লোক এগিয়ে
এলো।হাতে বিশাল এক ফ্লাওয়ার বু'কে!
শিহাব সেট এগিয়ে নিয়ে শায়লার হাতে দিলো।শায়লা ভীষণভাবে চমকে গেলো!
শিহাব বললো,শায়লা তোমাকে আমি ভালবাসি।আমাদের গৃহে তোমার আগমনে স্বাগতম জানাই।শায়লা ফুলের বু'কেটি হাতে নিয়ে একদৃষ্টে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল।চোখে মুখে বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন খেলে গেলো।
শিহাব তা ভালোভাবেই বুঝে নিলো। শায়লাকে আশ্বস্ত করে বললো,হ্যা, ঠিকই শুনেছো। শিহাব শায়লাকে নিয়ে লিফটের কাছে এগিয়ে গেলো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much