ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯৫)
শামীমা আহমেদ
শায়লাদের বাড়ির মুখোমুখি "স্বপ্নবাড়ি" এপার্টমেন্টের সামনে এসে শিহাব তার বাইক থামালো। স্টার্ট বন্ধ করে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শিহাব মোবাইলটা হাতে নিলো। বেশ অনেকটা সময় যাবৎ মোবাইল দেখা হয়নি। অন করতেই, আজ সন্ধ্যা থেকে রাহাত আর শায়লার এতগুলো মিসড কল দেখে সে ভীষণ অবাক হলো ! বিকেল থেকেই তার মোবাইলে একেবারেই চার্জ ছিল না।আর দোতালার হাসান সাহেবের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় চার্জে দিতেও দেরি হয়ে গিয়েছিল। শিহাব এর জন্য ভীষণ আফসোস করতে লাগলো! কি জানি কেন ওরা এত কল করেছিল ? তাহলে বাসায় কি অন্যরকম কিছু ঘটেছে ? শায়লা কি তবে নোমান সাহেবকে মেনে নিতে না পেরে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে ? সে কি তবে আমাকে খুঁজেছে ?শায়লাতো আমার বাসা চেনে সেখানে চলে এলেইতো হতো। বিল্লাল তাকে ঘরে বসাতে পারতো । বিল্লালের কাছে তো ফ্ল্যাটের চাবি দেয়া আছে। তবে কি রাহাতও শায়লার খোঁজ পেতে তাকে এতবার কল করেছিল ? শিহাবের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক হচ্ছে আর পাশাপাশি নিজের উপর ভীষণ রাগ লাগছে। তারই জন্য বারবার শায়লা তার কাছে এসেও ফিরে যাচ্ছে। শিহাব দেখল এতরাতে চারপাশে সুনশান নীরবতা। শিহাব একাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। যে কোন সময় টহল পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জেরার মুখে পড়তে পারে কিন্তু শিহাব তার জন্য একেবারে ভীত নয়। সে ভাবছে শায়লা বা রাহাতকে কি এত রাতে কল ব্যাক করবে ? কিন্তু শায়লা এখন যদি তার বাসায় থাকে। হয়তো তার স্বামীর সাথে থাকবে। আর অন্য কোথাও গেলে সেটাও জানতে হবে।শিহাব ভাবনার কোন কূলকিনারা করতে পারছিল না। একটু পরে শিহাব মোবাইল থেকে মুখ তুলতেই দেখতে পেলো শায়লাদের দোতালা বাড়িটি নানান রঙের বাতিতে লাইটিং করা হয়েছে । সে এতক্ষণ একেবারেই এসব খেয়াল করেনি। শায়লাদের বাড়ির মেইন গেট বিয়ে বাড়ির মত করে সাজানো হয়েছে। শিহাব বুঝে নিলো বর আগমনের জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তুতিই নেয়া হয়েছে।আর হবেই বা না কেন ? বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা ! সবার মাঝে তো আনন্দ থাকা স্বাভাবিক । সুদূর কানাডা থেকে বড় জামাই আসছে। অবশ্যই তাকে সর্বোচ্চ সন্মানিত করা হবে। শিহাব তার সাথে নিজেকে তুলনা করে ভাবলো তার হয়তো এই মূহুর্তে বিদেশ যাবার কোন প্রস্তুতি নেই তবে শায়লাকে আর আরাফকে নিয়ে তারা কোনদিন বিদেশে কোথাও তো বেড়াতে যেতেই পারতো। এমন রঙিন ভাবনা মনের ভেতর খেলে গেলেও শায়লাকে না পাওয়ার উৎকন্ঠায় তা যেন ম্রিয়মাণ হয়ে গেলো। শিহাব এবার মনস্থির করলো, যা-ই হউক না কেন, সে এক্ষুনি শায়লাকে কল দিবে। যদি সে তার স্বামীর সাথেও থাকে তবুও। প্রয়োজনে তার স্বামীকে জানাতে হবে, শায়লা আর সে দুজন দুজনকে ভালবাসে। উনি চাইলেই তাকে কানাডায় নিয়ে যেতে পারেন না। এমনটি ভাবতেই হঠাৎ শিহাব দেখলো একটা ছায়া তার দিয়ে ধেয়ে আসছে। ছায়া থেকে উপরে মুখ তুলতেই শিহাব দেখলো একটা ছেলে রাস্তার ওপাশ থেকে ক্রস করে আসছে।মুখটায় আলো না পড়াতে ঠিক বুঝা যাচ্ছে না কে ওমন করে দৌড়ে আসছে।কিছু পরেই ছায়াটা তার কাছে আসতেই মুখটি স্পষ্ট হলো। শিহাব ভীষণ চমকে গেলো ! আরে এ যে রাহাত! কিন্তু সে এমনভাবে দৌড়ে আসছে কেন ?
কি এমন হয়েছে ? এখনতো তার আপু আর নতুন দুলাভাইকে নিয়ে আনন্দে সময় কাটানোর কথা! রাহাত এখন একেবারেই কাছে চলে এলো। রাহাত শিহাবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ভীষণ ভাবে হাঁপাতে লাগল। কিছুটা সময় নিয়ে বললো, শিহাব ভাইয়া আপনি মোবাইল কল রিসিভ করছে না কেন ? আমি আর আপু আপনাকে সেই সন্ধ্যা থেকে কল করে যাচ্ছি।ফোন বন্ধ রেখেছেন কেন ? কি হয়েছে আপনার ? আরাফ কেমন আছে ? আপু আপনাকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছে । কোথায় ছিলেন সারাদিন ? এখানে কখন এসেছেন ? শিহাব রাহাতের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল। রাহাত উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা না করে একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। শিহাবও যেন উত্তর দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার ভাবনায় সে কিছু বলার মত উত্তর আসছে না। কেবল ভাবছে কেন এত হন্যে হয়ে দুই ভাইবোন তাকে খুঁজছে ? শিহাবের ভেতর থেকে অস্ফুট স্বরে কিছু একটা বেরিয়ে এলো, কেন, কেন তোমরা আমাকে এমন করে খুঁজছো ? শায়লার কি কিছু হয়েছে ? শিহাবের মন অজানা আশংকায় ভীত হয়ে উঠলো ! তবে কি শায়লা আত্মহত্যা ! না,না,ছিঃ এসব কি ভাবছে ?
এবার রাহাত বলে উঠলো, আপুর কি হবে?আপু ভালো আছেন। শিহাব যেন একটু আশ্বস্ত হলো।রাহাত শিহাবকে সহজ করতে বললো, আপনার কোন সাড়া না পেয়ে আপু একেবারে অস্থির হয়ে আছে। নানান দুশ্চিন্তা করছে। শিহাবের ভেতরে একরাশ অভিমান জমা হলো। অনুযোগের সুরে বললো, এখন
তোমার আপু আমাকে নিয়ে কেন ভাববে ? তোমার আপুরতো এখন আর, আমায় নিয়ে, ভাবনায় ডুবে থাকার কথা নয়।
রাহাত খুব বুঝতে পারলো, শিহাব ভাইয়ার এই অভিযোগের তীর তারই প্রতি ছুড়েছে।রাহাত আজ সবই মেনে নিবে। এমন করে শিহাব ভাইয়াকে পেয়ে যাওয়া! এ যে সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়া। রাহাত প্রতিটা ক্ষন অনুশোচনায় পুড়েছে। আজ তার কারণেই ঘটনাটা এত জটিলতায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রাহাত এটা-ই ভীষণ অবাক হয়েছে কেমন করে নোমান সাহেবের কানাডা থেকে না আসা আশ্চর্যজনক ভাবে সবকিছু পালটে দিলো। সে শিহাবকে বললো, শিহাব ভাইয়া, এখানে না, আপনি বাসার ভেতরে চলুন। আপা, আপনার জন্য অপেক্ষায় আছে । শিহাব বুঝতে পারছে না, এখন কেন সে ভেতরে যাবে ? বাড়িতে নতুন জামাই এসেছে। তার সামনে এভাবে তাকে নিয়ে যেতে চাইছে ! নাকি, শায়লা তার জন্য নোমান সাহেবকে গ্রহণ করায় সম্মতি দিচ্ছে না। নাকি, আমি গিয়ে বুঝালে শায়লা তাকে গ্রহণ করে নিবে।আজ রাহাতের এই ভিন্ন আচরণে শিহাব কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যেখানে, এই রাহাত তাকে এড়িয়ে সবকিছু করেছে । আবার আজ কোনো ট্রিকি গেম খেলছে নাতো ? নোমান সাহেবের কাছে নিয়ে তাকে
অপমানিত করবে নাতো? শিহাব নানান ভাবনায় স্থির হয়ে রইল। কিন্তু রাহাতের যেন আর ত্বর সইছে না। পরক্ষনেই সে ভাবলো এখন যদি শিহাব ভাইয়াকে বলা হয় নোমান সাহেব আসেননি এখন আপনার সাথে আপুর বিয়ে হবে। এই কথাটিতে শিহাব ভাইয়া আমাদের অন্যরকম ভাববে। তবে যে করেই হউক, এবার আপু আর শিহাব ভাইয়াকে মিলিয়ে দিতে হবে।মিথ্যে করে কিছু বলে হলেও তাদের চার হাত মিলিয়ে দিতে হবে। রাহাত তাই নোমান সাহেবের বিষয়টি এমনভাবে শিহাবকে জানালো, যেখানে আর কথার মাঝে কোন ফাঁক রইল না।সে এবার মুখ ফস্কে বলেই ফেললো,কানাডা থেকে নোমান ভাইয়া আসেননি,মানে আপু তাকে আসতে নিষেধ করে দিয়েছে। সে জানিয়েছে, আপনাকে সে ভালবাসে, সে আর কাউকে গ্রহন করবে না। কানাডা যাবে না। কথাটিতে শিহাবের কেমন যেন খটকা লাগলো, সে রাহাতকে বললো,কিন্তু আমি তো জানি উনি ফ্লাইটে উঠে গিয়েছিলেন। রাহাত তৎক্ষনাৎ বুদ্ধি বাৎলে বললো,না, বাসার সবাইকে সান্ত্বনা দিতে এটা বলেছিলেন। উনি আসলে ফ্লাইটে উঠেননি।
এবার রাহাত শিহাবকে আর কোন সন্দেহের প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে একেবারে খপ করে শিহাবের হাত ধরে ফেললো, খুবই বিনীতভাবে বললো, শিহাব ভাইয়া আমার জন্যই আপনাদের এত ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।আমি এর জন্য দুঃখিত।আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনি ভেতরে চলুন। আপনার বাইক স্টার্ট দিয়ে বাসার কাছে নিয়ে আসুন। এখন অনেকরাত।এরপর বাইরে থাকলে আপনার আমার অন্য ঝামেলায় পড়তে হবে।
রাহাত এবার ওদের বাসার ছাদের দিকে তাকালো। দেখলো,বুবলী তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখেমুখে বিস্ময়! কি হচ্ছে এসব! দূর থেকে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঐ লোকটি কে ? যার সাথে রাহাত এত কথা বলছে ? আবার তাকে হাত ধরে অনুরোধ করছে ? এবার রাস্তা থেকে বুবলীর ফোনে রাহাতের কল এলো, বুবলী তা রিসিভ করতেই রাহাত যেন খুশির আবেগে কিছুই বলতে পারছিলো না। বুবলী জানতে চাইল, রাহাত ভাইয়া কী হয়েছে ? ঐ লোকটি কে ?
রাহাত এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, আরে এটাই শিহাব ভাইয়া! তুমি শায়লা আপুকে জানাও শিহাব ভাইয়া এসেছে। বাসার সবাইকে জাগিয়ে তোল।আমি এখুনি শিহাব ভাইয়াকে নিয়ে বাসায় আসছি। বুবলী ভাবলো এও কি সম্ভব! তবে অসম্ভবও কিছু নয় ! যেভাবে শায়লা আপু শিহাব ভাইয়ার জন্য ভেঙে পড়েছে আর এত রাতে শায়লা আপুর জন্য যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাদের দুজন দুজনকেই তো পাবে। এ এক দারুণ হৃদয়টান! বুবলীর মনের ভেতর পুলকিত হলো! সে দেখলো, বেশ হ্যান্ডসাম একজন লোক, উনিই তাহলে শিহাব সাহেব ! প্রথম দেখায় যে কেউ এমন লোকের প্রেমে পড়বে। তাইতো শায়লা আপু এত প্রেমে ডুবেছে।লাইটপোস্টের ঝকঝকে আলোতে দেখা যাচ্ছে নেভি ব্লু চেক শার্টে বেশ ক্যাজুয়াল পোষাকে কিন্তু বেশ স্মার্ট লুকের একজন মানুষ বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে। রাহাত তার খুব কাছে একেবারে লেপ্টে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কিছুতেই হাতছাড়া হয়ে না যায় ! রাহাতের কান্ড দেখে বুবলীর বেশ হাসি পাচ্ছিল। পরক্ষণেই ভাবলো, হবেই বা না কেন ? রাহাত ভাইয়া তার নিজের ভুলের জন্য যেভাবে বারবার নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল। সেই ভুলের সংশোধনের জন্য এটুকুতো করতেই হবে। যেন সে শায়লার কাছে পণ করেছে, শিহাব ভাইয়াকে পাইয়ে দেয়ার।
বুবলী দোতলায় নামার জন্য পিছন ঘুরতেই দেখতে পেলো শায়লার হলুদের স্টেজটা নানার রঙিন ফুলে যেন হাসছে ! বুবলী কল্পনায় সেখানে শায়লা আর শিহাবকে দেখতে পেলো যেন ! বুবলী নিজের মনের এমন ভাবনায় নিজের মনেই হেসে উঠলো ! সে ভাবলো, শায়লা আপুকে এক্ষুনি খবরটা দিতে হবে। সে মুচকি হেসে , সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে দোতলায় নেমে এলো। সে শায়লার ঘরের দরজায় বেশ অনেকবার নক করেও শায়লার কোন সাড়া না পেয়ে চিন্তিত হলো। বাড়ির সব লোকজন গভীর ঘুমের অতলান্তে। বুবলী বেশ অনেকটা সময় দরজায় নক করে হাতের মোবাইলের দিকে খেয়াল হলো। সে কন্ট্যাক্ট লিস্টে শায়লার নাম্বার খুঁজে নিয়ে শায়লাকে কল করলো। কিন্তু একের পর এক কল বেজেই যাচ্ছে। শায়লা কল রিসিভ করছে না। শায়লা কী ঘুমিয়ে না অন্যকিছু ? বুবলী ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much