মমতা রায়চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১৫৭





উপন্যাস 


টানাপোড়েন ১৫৭
ওয়ার্কশপে রেখার নাম
মমতা রায়চৌধুরী



মনের ভেতরে একটা কেমন গোপন যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছিল রেখা ভেবে পাচ্ছিল না আসলে সেই যন্ত্রণাটা কি ?
আসলে কিছু কিছু যন্ত্রণা থাকে যেগুলো বোধের অতীত, শুধু নস্টালজিক হয়ে ফিরে আসে, ভাবায় কষ্ট দেয় ,কখনও বা সেই যন্ত্রণাগুলো সুখের স্বর্ণালী স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে।
বড়দি ফোন করেছিল অনিন্দিতা ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে খুব মানসিক কষ্টে আছে। কথাটা শুনে রেখার ভেতরে কেমন যেন একটা কষ্টের বোধগুলো দানা বেঁধে উঠেছে অথচ অনেক দিন অকারণে রেখার সাথে কত মনে দাগা দিয়ে কথা বলেছে। আজকে সে সব কষ্ট মনেই হচ্ছে না।  মনে হচ্ছে  এখানে একজন মায়ের কষ্ট অনেক বেশি।শুধু  একজন মা তার সন্তানকে ভালো দেখে তার যে মানসিক শান্তি হয়, সেই শান্তিটুকু ফিরে পাব অনন্দিতা। ঈশ্বর করুন ওর বাচ্চার যেন সব স্বাভাবিক থাকে ,ভালো থাকে, সমাজের উপযোগী হয়ে ওঠে। 
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল' স্বপ্নীল কেমন আছে কে জানে? কার থেকেই বা খবর পাবে?'
এত ভাবনা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঘুম কিছুতেই আসতে চাইছে না ।অথচ কখন যে একসময় ঘুমিয়ে পরেছে বুঝতেও পারেনি।  ঘুম ভাঙ্গলো  অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজে।
উঠতে ইচ্ছে করছে না ।শরীর ক্লান্ত ।ঘড়িটা দেখে নিয়ে এলার্ম টা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়লো।
শুয়ে থাকতে থাকতে মনে হল যে 'সে ঘুমায় নি অথচ ঘুমিয়ে পড়েছে ।এবার ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। "ওম জয় লক্ষ্মী মাতা,, মাইয়া জয় লক্ষ্মী মাতা...।'এটা আবার কাদের বাড়ির কলিংবেলের আওয়াজ।  ভালো করে কান খাড়া করে শুনল। কাদের বাড়ির কলিংবেলের আওয়াজ এটা তো রেখার বাড়িরই । যা বাবা এটা আবার কবে হলো।
এবার না উঠে পারা যাচ্ছে না। উঠতে তো হবেই। স্কুলে  যেতে হবে। মাসি এসেছে নিশ্চয়ই।
ঘুমের জড়তা কাটিয়ে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলল। রেখা অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে
"ও মা মাসি কোথায়?'
পার্থ খুব হেসে হেসে বলল
'কি বৌদি অবাক হয়ে গেলেন?'
রেখা চোখ দুটো ভালো করে হাত দিয়ে রগড়ে  নিয়ে বললো  'না মানে ,আমি ভেবেছি মাসি ..।
এত সকালে তুমি আসবে বুঝতে পারি নি।'
"আরে আমি কি জানতাম?
ঠিক আছে ভেতরে এসো পার্থ ।
'ভেতরে যাবো না বাড়িতে গিয়ে এগুলো দিই।'হাতে ধরে থাকা শাক গুলোকে দেখিয়ে।
পার্থর হাতে দুই আঁটি পাটশাক।
আরে সকালবেলায় টাটকা পেলাম নিয়ে যাচ্ছিল এক মাসি। পরতা হল তাই নিয়ে নিলাম।
একদিন বলেছিলে যে পাটশাক খেতে ইচ্ছে করছে।তাই…।'
"বাববা ,পার্থ তোমার মনেও থাকে " একগাল হেসে রেখা বলল।
"'কেন মনে থাকবে না বৌদি?"
'ঠিক আছে ,এসো ভেতরে।  চা খেয়ে যাও।'
'না বৌদি, যাই ।আমাদের বাড়িতে কাজের মেয়েটা আসলো কিনা দেখি।'
"ঠিক আছে, তাহলে এসো।"
"অন্য দিন এসে চা খেয়ে যাব।"
"তাই হবে।"
দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় মাসী বললো 'ও বৌমা দরজা বন্ধ ক'রো না, এসে গেছি।'
"হাতে কি ওগুলো বৌ মা।"
"পাটশাক গো পার্থ দিয়ে গেল।"
"মাসি শাকগুলো নিয়ে যাও তো একটু কেটে দিও তো।"
ঘাড় নেড়ে পাট শাকের আঁটি  নিয়ে চলে গেল।
ওই দেখো ভুলে গেলাম?
মাসি বললো' কি ভুলে গেলে বৌমা?'
আরে সেদিন ইলিশ মাছ এনেছিল ।ওকে তো টাকা দেয়া হয়নি ।টাকাটা তো দিতে হবে ।কাজের কথা কিছুই বলতে পারলাম না।
মাসি বললো 'দেবে পরে।'
'আসলে ও আসলে এত হুটোপাটি করে না ,সবকিছুই ভুলে যাই।'
বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গোপালকে ভোগ চাপিয়ে নিচে নেমে আসলো চা করতে। যা হয়ে গেলে একে একে ফ্রিজ থেকে কাটা সবজি গুলো বের করে রান্না চাপিয়ে দিল। রুটি হলো তারপর মিলিদের খাবার হল ।তারপর নিজেদের খাবার রেডি করল। এরই মাঝে মাসিকে চা জলখাবার দিয়ে দিল। আজকে মাসি খুব তাড়াতাড়ি কাজ করে চলে গেল। কোথায় যাবে তাড়া আছে।
এবাবা  মনোজ এখনো ঘুম থেকে উঠলো না।
কি কুম্ভকর্ণের ঘুম রে বাবা?
আজকে অফিস যাবে না, নাকি?
বলেই রেখা শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। বাইরে মিলিদের চিৎকার শোনা গেল। আপন মনেই রেখা বললো সবুর কর। খাবার আনছি রে বাবা। চেঁচাস না।'
রেখা ঘরে গিয়ে দেখে নাক ডেকে বিন্দাস ঘুমোচ্ছে।
রেখার দুই গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসল বিছানার উপর তারপর শেষে জোরে একটা ধাক্কা দিলো নাম ধরে ডেকে 
মানুষতো ঘুমের থেকে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো বড় বড় চোখ করে তারপর বলল 'কি হচ্ছে ?কি করছো?'
"তুমি উঠবে না আজকে?'
'হ্যাঁ, উঠব তো বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।'
"তাহলে তুমি আজকে অফিস যাচ্ছ না?'
মনোজের কানে কথাটা গেল তারপর ধরফর করে বিছানার উপর উঠে বসে বলল মানেটা কি অফিসে যাব না মানে?
মনোজ  দিকে তাকিয়ে রেখা  মাথা নেড়ে বলল' সে তো বটেই ।কখন অফিসে
 যাবে ?ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো?'
মনোজ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে ছুটল , আর বলতে লাগল বলতে গেল'তুমি আমাকে ডেকে দাও নি।'
'কতদিন বলেছি আমাকে ঠিক টাইমে ডেকে দেবে?'
রেখা বলে এটাই কপাল বুঝলে তুমি ঘুমোবে আর দোষ চাপাবে আমার ওপর?'
অন্যদিকে মিলিদের চিৎকারে আর টিকতে পারছে না দরজা মনে হচ্ছে ভেঙে ফেলবে।
রেখা বললো 'না  আগে ওদের খাবারটা দিয়ে আসি।'
ঈদের খাবার টা দিয়ে এসে বিছানাপত্র ছেড়ে নিয়ে মনোজের ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলল তারপর ওয়ারড্রব খুলে মনোজের ড্রেস বের করে রাখল সোফার ওপর।
মনোজ বাথরুম থেকে বেরিয়েই বলল 'আমার ড্রেসটা বের করো রেখা তাড়াতাড়ি আর ব্রেকফাস্ট টা দাও।"
রেখা বললো' তুমি যত তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আস্ তে  পারবে ,তত তাড়াতাড়ি তোমার ব্রেকফাস্ট দেবো।'
"আমি রেডি হয়ে গেছি।"
"আমিও তোমার খাবার নিয়ে বসে আছি।"
মনোজ তাড়াতাড়ি এসে খাবার টেবিলেই বসল আর এত তাড়াতাড়ি খেতে লাগল তাই দেখে রেখা বলল" এত তাড়াহুড়া করছো কেন তুমি ?"
মনোজ বলল' আমাকে এই ট্রেন পেতেই হবে।'
রেখা বললো "ঠিক পাবে ।এমন কিছু সময় নষ্ট হয় নি।"
মনোজ বলল 'পেলেই ভালো বুঝলে?"
রেখা নিজে ব্রেকফাস্ট না খেয়ে টিফিন বক্সে নিয়ে নিল আর সঙ্গে সঙ্গে টিফিন ভরতে ভরতে মনোজকে বলল' তুমি লাঞ্চে কি খাবে আজকে ?তোমাকে কি দিয়ে দেবো বাড়ির খাবার?"
মনোজ বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে বলল", না না ,না ।আমি আজকে বাইরে খেয়ে নেব।"
মনোজ রেখাকে টাটা করে বেরিয়ে গেল।
রেখাও রেডি হয়ে সেন্টুদাকে মিলিদের খাবার বুঝিয়ে দিয়ে, ঘরগুলোতে তালা লাগিয়ে দিয়ে শুধু গেটের চাবিটা সেন্টু দার হাতে দিয়ে অটো ধরবে বলে ওয়েট করতে লাগলো।
অটো পেয়েও গেল ।যথারীতি নির্দিষ্ট টাইম স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনে উঠে বসলো।
ট্রেনে উঠে যথেষ্ট ভিড় থাকায় বড়দিকে ফোন করতে পারলো না।
রেখা মনে মনে ভাবল' ভিড়টা কমলে জায়গা পেলে, দিদির কাছ থেকে জেনে নিতে হবে কোথায় ওয়র্কসপ টা হচ্ছে?'
কালকে বড়দি এত কথা বললেন অথচ ওয়ার্কশপ কোথায় হচ্ছে সেটা বলতেই ভুলে গেছেন আর আমারও জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠলো না।'
এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেনের ভিড় ঠেলে ঠেলে সিটের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করল এর মধ্যে একজন মহিলা এমন ধাক্কা মারলো রেখা প্রায় একটা ছোট বাচ্চার উপর উল্টে পড়ে যাবার উপক্রম হল।
 রেখা বলল' দিদি, একটু ঠিক করে দাঁড়াতে পারেন না। কেউ এইভাবে ঠেলা মারে বলুন তো?'
তবে যাই হোক রেখা এতসব কথা বলার পরেও ভদ্রমহিলা একটা কথাও বলল 
না।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে সামনের কয়েকটা স্টেশন আসার পরই ফাঁকা হয়ে গেল।
অন্তত ঠিক করে দাঁড়াতে পারল রেখা তারপর জিজ্ঞেস করতে লাগল কে কোথায় নামবে?
জিজ্ঞেস করতে করতেই সিটে বসে থাকা প্রথম ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন বললেন "আপনি এখানে বসুন আমি সামনেই নামবো।"
এ যেন রেখার কাছে মেঘ না চাইতে জল।
রেখা এখন মনে মনে ভাবছে বসে একটু জল খেয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেই বড়দিকে ফোনটা করবে এমন সময় রেখার ফোন বেজে উঠলো। রেখা ফোনটা রিসিভ করতে গিয়ে দেখল 'বড়দির ফোন?'
"হ্যালো দিদি,'
', হ্যাঁ, রেখা আমি বড়দি বলছি।"
"বুঝতে পেরেছি বলুন।'
আজকে ওয়ার্কশপটা কোথায় হচ্ছে সেটা তো তোমাকে বলা হয়নি ,তুমি যাবে কি করে ওখানে? এইজন্য ফোন করলাম।"
"আমিও ঠিক একই কথা ভাবছিলাম যে আপনাকে ফোন করে জানবো।তার
আগে আপনি ফোনটা করে ফেললেন।"
বড়দি হেসে বললেন' তাই কি টেলিপ্যাথি দেখো?'
'শোনো তুমি ডন বক্স স্কুলে চলে আসবে।'
'ঠিক আছে দিদি।
ওখানে গিয়ে অনিন্দিতার নামটা কাটিয়ে তোমার নামটা লিখে নিতে বলবে কেমন? 'Ok দিদি।'
"যে কটা দিন ওয়ার্কশপ হবে তুমিই যাবেi'
Ok
বড়দি হেসে ফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন' বেস্ট অফ লাক।'
'থ্যাংক ইউ দিদি'।

মন্তব্যসমূহ

সুন্দর ভিউজ নজর করুন

কবি সানি সরকারের কবিতা "দগ্ধ - মৃত - গাছ"

কবি আইরিন মনীষা এর কবিতা "বেদনার বালুচরে"

কবি দেবব্রত সরকার এর কবিতা "নির্মোক"