কানন রায় এর অণুগল্প






অনি তনুর কথা



 দুটি ছেলেমেয়ে প্রতি দিন এই রাস্তা দিয়ে কলেজে যায়।মাঝে মাঝে ওরা আমার দোকানে আসে।কখনো পেন কেনে কখনো খাতা।কখনও বা বই আবার কখনো ফাইল কভার।দুটিতে খুব ভাব।কখনো নির্জন দুপুরে পথে পথিক তেমন একটা নেই।দুটিতে রোদে তেতে পুড়ে আমার দোকানে চলে আসে।কখনো বলে-
"কাকিমা একটু জল দাওনা। বাপরে কি রোদ"।
আবার কখনো বলে-
"একটু বসবো কাকিমা? হাপিয়ে গেছি।হেঁটে হেঁটে এলাম তো, রিক্সা চাপার পয়সা নেই"।এভাবে ওদের আসা যাওয়ার মধ্যে আমিও কখন ওদের একজন হয়ে গেলাম জানি না । ওরা কবে যেন আমার আপনজন হয়ে গেল।তাই তো ওদের কথা বলতে বসে গেলাম।
       মেয়েটির ডাক নাম অনি ভালো নাম অনিন্দিতা রাহা।ছেলেটি তনু ,তনুময় সরকার।ওরা এক কলেজে পড়ে।একে অপরকে ভলোবাসে।স্বপ্ন দেখে একটা ভালো বাসা বাঁধার।মেয়েটির মা নেই।সৎমায়ের অবহেলায় বেড়ে ওঠা একটা জীব মাত্র।মেয়ের বাঁচাবাড়া নিয়ে বাবার কোন হেলদোল নেই।এই যা হয় আর কি।দু তিনটে টিউশন করে পড়ার খরচটা চালিয়ে নেয়।আর এর সঙে আছে অদম্য ইচ্ছে নিজের পায়েও দাঁড়াবেই।
ছেলেটির দুর্গতি আরও ।মা দিনের বেলায় লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করে।আর সন্ধ্যের পরে ঘরে বসে ঠোঙা বানায়।দিনের বেলায় তনুর মায়ের সঙে দেখা কম হয়।কলেজ থেকে ফিরে এসে।সন্ধ্যের পর খেয়ে দেয়ে মা ছেলে মিলে ঠোঙা বানায় ,সুখ দুঃখের গল্প করে।জীবনের স্বপ্ন গুলি তুলে ধরে মায়ের কাছে।মা ই তো ওর সব।সেই ছেলে বেলায় বাবা ওদের ছেড় চলে গেছে ।আর কোনদিন ফিরে আসেনি।
এক সময় কলেজ শেষ হয়।এখন আর ওরা প্রতি দিন আসে না।মাঝে মাঝে আসে চাকরির ফর্ম ফিলাপ করতে।বেকার ছেলে মেয়েদুটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিল।এক সময় ওদের খুব ক্লান্ত লাগতো।তনুকে খুব হতাশ লাগতো।ধীরে ধীরে তনুকে ক্ষয় রোগে গ্রাস করলো। অনি পাগলের মতো ছুটলো ডাক্তারের কাছে।অনেক দৌড় ঝাপ করে একটা হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরে আসে।বাড়ি ফিরে দেখে তার চাকরির appointment letter এসেছে।সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি।এক দিকে আনন্দ অন্যদিকে আতঙ্ক।খুব সকালে হাসপাতালে চলে যায়।তনুময়ের হাত দুটি ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল।Appointment letterটা  তানুর হাতে দিয়ে বলেছিলো "আর ভয় নেই এবার আমার মাইনের টাকায় তোমার চিকিৎসা করাব"।
            তনু ম্লান হেসেছিল।ও বোধহয় টের পেয়েছিল ,ভেতরটা ওর সবই ক্ষয় হয়ে গেছে।----
          প্রথম মাসের মাইনে নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে থমকে দাঁড়ায় তনুর বেডের পাশে। একি? 
সাদা কাপড়ে ঢাকা কেন?ধীরে ধীরে অনির হাত থেকে খসে পরলো প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে,প্রথম যৌবনের প্রথম আশা,হৃদয় নিঙরাণো প্রথম ভালোবাসা।
       তারপর অনির কি হয়েছিল কেউই জানেনা।এপথে তাকে আর কেউ কোনদিন হাঁটতে দেখেনি।

      

মন্তব্যসমূহ

সুন্দর ভিউজ নজর করুন

কবি সানি সরকারের কবিতা "দগ্ধ - মৃত - গাছ"

কবি আইরিন মনীষা এর কবিতা "বেদনার বালুচরে"

রীনা ঘোষ