শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৩৮)
শামীমা আহমেদ
----এসির ঠাণ্ডা পরিবেশে শায়লা দুপুরে বেশ একটা ঘুম দিলো। যদিও রাহাত বারবারই শায়লাকে রুমে একা রেখে এসে বেশ চিন্তিত
হচ্ছিল । আর এর মাঝেই নিজের রুমে রাহাতও একটু ঘুমিয়ে নিলো। মায়ের ঘরেও মা ঘুমাচ্ছে।এক'দিন সবাই ভীষণ একটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে।সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় সময় কেটেছে।আজ বাসায় একটু স্বাভাবিক পরিবেশ লাগছে। সন্ধ্যার একটু আগে আগে শায়লার ঘুম ভাঙল। খুব আরামদায়ক একটা ফিলিংস অনুভুত হচ্ছে। রাহাত আপুর দরজায় নক করলো। আপু,এসো একসাথে নাস্তা করবো। শায়লা খুব আস্তে করেই বললো, আসছি। এইতো একটু ঘুমিয়েছিলাম। দাঁতব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি। রাহাত অনলাইনে পিজ্জার অর্ডার দিয়ে রেখেছিল।
শায়লাকে চমকে দিতে! ডাইনিংএ এসে সত্যিই শায়লা অবাক হলো! মাকে নিয়ে ভাই বোন মনে হচ্ছে অনেকদিন পর আজ একসাথে নাস্তা করা হচ্ছে। নাস্তা পর্ব শেষ করে রাহাতই চা বানিয়ে আনলো।মা বোনকে আর রান্নাঘরে যেতেই দিলো না।যদিও মাকে আটকে রাখা খুব কষ্টকরই হচ্ছিল। তবুও রাহাত কিছুতেই মাকে রান্নাঘরে প্রবেশের অনুমতি দিলোনা।
তিনকাপ চা নিয়ে বসতেই নীচতলার রুহি খালা এলো।রাহাত দ্রুতই আরেককাপ চা বানিয়ে এনে মা আর রুহি খালাকে আলাপে বসিয়ে দিলো।আর শায়লাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিলো।নয়তো নানান প্রশ্নে শায়লা জর্জরিত করতে পারে।
রাহাত শায়লার দিকে তাকিয়ে বললো, আপু চায়ের কাপ নিয়ে চলো ছাদে যাই।অনেকদিন ছাদে যাওয়া হয়না।
রাহাত যখন যা যেভাবে বলছে শায়লা সেভাবেই রাজী হচ্ছে।অনেকদিন পর ভাইবোনের এমন সুন্দর সময় কাটানো। ছাদের ঐ উত্তর কোণটিতে নীচ থেকে উঠা আসা একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালায় ছেয়ে গেছে।দিনের বেলা লালসবুজের মিশেল দেখতে খুবই চমৎকার লাগে।ভাইবোন সেখানটাতে গিয়ে দাঁড়ালো।রাহাত খুব বুঝতে পারছে,আপু নিশ্চয়ই এখন শিহাব সাহেবের কথা ভাবছে।আমি না হয়ে এখানে এখন যদি শিহাব ভাইয়া থাকতেন নিশ্চয়ই আপুর খুব সুন্দর সময় কাটতো! রাহাত বুঝতে পেরে তাই শায়লাকে বলেই বসলো, আচ্ছা আপু এখন এখানে শিহাব ভাইয়া এলে তোমার খুব ভাললাগত।তাই না? আমরা একসাথে চা খেতাম, গল্প করতাম। অবশ্য যদি উনি আসতে রাজী হতেন তবেই!
শিহাবের প্রসঙ্গে শায়লা বরাবরই একটু কাতর হয়ে পড়ে।শিহাবের উপস্থিতিটা বেশ অনুভব করে। শিহাবের গোছানো কথাগুলোতে কোন দোষ খুঁজে পাওয়া যায়না।স্বচ্ছ পরিপাটি বাক্যবলয় কেমন যেন সম্মোহনের মত টেনে নেয়।
রাহাত খুব বুঝতে পারল আপু শিহাব সাহেবের ভাবনায় ডুবে গেছে। তাইতো এমন শীতল নীরব। রাহাত ভালো করেই জানে চোখ থেকে মন আর মন থেকে ভাললাগাটা রক্ত প্রবাহে মিশে যায় যা ভীষণভাবে অনুভব অনুভুতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
রাহাত নীরবতা ভাঙল। চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, আপু তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শায়লা ভাবছে সে একটা ট্রেনের কামরায় বসে আছে চলন্ত ট্রেনটি যে কোন স্টেশনে থামলেই আচমকা শিহাব উঠবে! আর শায়লাকে দেখে ভীষণ অবাক হবে! আর শায়লার চোখে মুখে অপ্রত্যাশিত একটা প্রাপ্তির আনন্দ খেলে যাবে!
রাহাত শায়লার ভাবনায় ছেদ ঘটালো। সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, আচ্ছা আপু শিহাব সাহেব কি দেখতে খুব সুন্দর!
শায়লার তৎক্ষনাৎ উত্তর,হ্যাঁ, শিহাব দেখতে খুব হ্যান্ডসাম।
নোমান ভাইয়ার চেয়েও?
সেভাবে তুলনা করে দেখিনি কখনো।শায়লা নোমানের নামটি এড়িয়ে যেতে চাইছে।রাহাত খুব বুঝতে পারছে, যদি আপাকে এখন অপশন দেয়া হয়,আপু এখন শিহাব ভাইয়াকেই বেছে নিবে।
রাহাত একে একে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আসলে এটা একধরনের মনোচিকিৎসা। সাইকোথেরাপি।
কেউ যখন কারো ভাবনায় ভীষণভাবে ডুবে থাকে, সে তখন শুধু তার কথাই বলতে বা অপরপ্রান্ত থেকে শুনতেই পছন্দ করে।রাহাত চাইছে আপুর মনে শিহাব ভাইয়াকে নিয়ে যত কল্পনা ভাবনা স্বপ্ন ভাললাগা জমেছে সেগুলো শুনতে চেয়ে চেয়ে মন থেকে তা বের করে আনতে হবে।তবেই আপুর মন হাল্কা হবে। মনের কথাগুলো বলে নিযেকে ভারমুক্ত করবে।
রাহাত ভেবে নিলো, এভাবেই আপুকে প্রতিদিন একটু একটু করে স্বাভাবিকে নিয়ে আসতে হবে। আর মনে মনে ঠিক করে নিলো, আজ রাতেই শিহাব সাহেবের সাথে কথা বলতে হবে।তারওতো কিছু বলবার থাকতে পারে।আর তা যদি আপুর ভাবনার সাথে মিলে যায় তবে রাহাত আপুর ব্যাপারে ভিন্ন কিছু ভাববে। যে যাই বলুক, রাহাতের কাছে আপুর সুখটা সবচেয়ে বড়।আপুর মুখে হাসিটাই তার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।
একঘন্টা পর ভাইবোন নীচে নেমে এলো।
ড্রইং রুমে সোফায় বসে একসাথে টিভি দেখলো! আপু মাঝে মাঝে কেমন যেন গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে যাচ্ছে। শায়লাকে সহজ করতে রাহাত টিভিতে নিউজ রিডারটিকে দেখিয়ে বললো, আচ্ছা আপু শিহাব সাহেব কি এই লোকটির মত দেখতে! শায়লা একঝলক চোখ বিস্ফারিত করে টিভি স্ক্রিনে তাকালো!অবচেতন মনেই ভেবে নিলো, নাহ,তাই কি আর হয়! পরক্ষণেই বুঝলো, রাহাত আসলে তার সাথে দুষ্টুমি করছে। এবার শায়লা বেশ জোরেই একটা হাসি দিয়ে উঠলো! শায়লা রাহাতের চালাকিটা বুঝতে পারলো। সাথে সাথে তার চোখ দুটো জলে ভরে গেলো! রাহাত বুঝতে পেরে আপুকে হাত দিয়ে বেড়িয়ে ধরলো। শায়লাও ছোট্ট বোনটির মত, কিছু বায়না করার ছলে রাহাতের কাঁধে মাথা রাখলো।রাহাত খুব বুঝতে পারলো তার প্রতি এটা আপুর কিছু একটা নীরব চাওয়া। রাহাত মনস্থির করে ফেললো,যদি আপু আর শিহাব সাহেবের ভাবনা একহয় তবে যত বাধাই থাকুক আমি আপুর ইচ্ছে চাওয়ার পূর্ণতা দিবো।
রাহাত আজ রাতের খাবার খাওয়া পর্যন্ত শায়লার সাথে রইল।সবশেষে আপুকে তার রুমে দিয়ে এলো আর আপুর হাত ধরে বললো, আপু আমি চাইছি তোমার মোবাইলটা কিছুদিন আমার কাছে থাকুক। তুমি পুরোপুরি সুস্থ হলে তখন দিবো। শায়লা মাথা কাত করে লক্ষী মেয়ের মত সম্মতি জানালো।শায়লার ঔষধগুলো আর পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। শায়লার পাশে রাহাত বসে রইল। এসির পয়েন্ট সেট করে দিয়ে আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।ছোট ভাইটার এতটা ভালবাসায় শায়লার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। হঠাৎ চোখের কোন বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো।রাহাত বুঝতে পারলো এ কান্না কার জন্য।এ অনুভব কাকে ঘিরে,এ কান্নায় কোন চাওয়াটা লুকিয়ে আছে।খুব শীঘ্রই ঘুমের ঔষধের প্রভাবে শায়লা ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো।রাহাত রুম থেকে বেরিয়ে এলো।আপুর রুম লক করা নিষেধ করা আছে। আপু যেভাবে শিহাব সাহেব ভদ্রলোকটিকে ভেবে এত কাতর হয়ে যাচ্ছে, উনার কী তা জানা আছে? উনিও কী এতটা গভীরে নিয়ে আপুকে ভাবে?
আজ ফোন করে কথা বলে তা জেনে নিতে হবে।রাহাত নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই অজান্তেই তার মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much