শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত আরোপ
পর্ব ৩৯
শামীমা আহমেদ
এক মগ কফি হাতে রাহাত বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শিহাব সাহেবের সাথে কিভাবে কথা শুরু করবে সে বিষয়টি নিয়ে রাহাত গভীরভাবে ভাবছে। যেখানে শায়লা আপুর অনেকখানি আবেগ জড়িত। আপুর ভাললাগার এই অনুভব মনের ভেতর চেপে রেখে আজ তা শরীরেও বাসা বেঁধেছে। বেঁচে থাকাটাই হুমকির মুখে পড়ে গেছে।সেদিনের ঘটনাটা ভাবলে রাহাত আজও শিউরে ওঠে! কিন্তু তাই বলে, সেজন্যতো একেবারে কাঙাল হয়ে শিহাবের দিকে হাত বাড়ানো যাবে না। রাহার ঘরে চলে এলো।রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। রাহাত ঘরে এসে রুমের সোফায় বসে হাতে মোবাইলটা নিলো।
কন্ট্যাক্ট লিস্টে ক্রল করে শিহাব নামে থামল।
নাম্বারে টাচ করে শিহাবকে কল দিল।
এদিকে রাত প্রায় পৌনে দশটার দিকে শিহাব গাজীপুর থেকে বাসায় ফিরলো। সারাদিন ম্যানেজার ফারুখ সাহেবের সাথে ফ্যাক্টরির যাবতীয় হিসেব নিকেশ নিয়ে বসেছিল।আগামীতে শ্রমিকদের দুইটা ঈদ বোনাস দিতে হবে। সে ব্যাপারে আলোচনা করে আর্থিক দিকটা গুছিয়ে রাখতে হলো।এই সকল ব্যাপার মালিক পক্ষের খুব শক্ত হাতেই হ্যান্ডেল করতে নয়।নয়তো শ্রমিকেরা ঈদ বোনাসের দাবীতে কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ ভাংচুর করে, রাস্তাঘাট অবরোধ করে আন্দোলনে নেমে পড়ে। আর সাথে সাথেই তা সংবাদিকদের একটা সংবাদের ইসু হয়ে যায়। তাই আগেভাগেই সব ভেবে রাখতে হচ্ছে।দুপুরে ম্যানেজার ফারুখের বাসায় খাওয়া দাওয়া হলো।শিহাব এ ব্যাপারটিতে কোন আপত্তি করে না।এতে ফারুখ সাহেব ও তার পরিবার তৃপ্ত হয়। শিহাব এ দিকটি খুবই সম্মানের সাথে দেখে। সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে আসতে রাত হয়ে গেলো। গাজীপুর থেকে রওনা দিয়ে উত্তরায় ঢোকার মুখে একটা চায়ের আড্ডায় বন্ধুদের সময় দিয়ে বাসায় পৌছুতে রাত দশটা হয়ে গেলো। ফিরে দ্রুতই ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ থেকে খাবার নামিয়ে আভেনে গরম করে খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে সবকিছু গুছিয়ে রেখে একটু আয়েশী ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরিয়ে যেই বিছানায় বসেছে অম্নি একটি নাম্বার থেকে ফোন কল।শিহাব তাকিয়ে দেখলো। সেই দুপুরের নম্বরটি।বুঝলো এটা শায়লার ভাই রাহাতের নাম্বার।
শিহাব কল রিসিভ করলো। দুজনায় কুশালাদি বিনিময় করে শিহাব খুব স্পষ্টভাবেই শায়লার কথা জানতে চাইল। রাহাত জানালো আপু এখন একটু ভালো তবে আপুর মনে আপনার জন্য বিশাল এক আকাশ ধরে রেখেছে।পালাবদলে তা রোদ বৃষ্টি ঝড় আর এক সুগভীর মহাশূন্য ধরে আছে। আপু আনমনে, জাগরণে আপনাকেই ভেবে চলেছে।
শিহাবের এসব বুঝতে এতটুকু কষ্ট হলোনা। এই কয় মাসে শায়লাকে খুব ভালো করেই বুঝেছে সে। শায়লার ভেতরে শিহাবের জন্য জমিয়েছে এক সমুদ্র ভালবাসা। একটু উত্তাল ঢেউ এলেই তা চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। শিহাবকে এক নজর দেখার জন্য যেভাবে সে আকুল হয়ে উঠে তা ঠিকই টের পায় শিহাব।
রাহাতকে উত্তরের অপেক্ষায় রেখে শিহাব শায়লাকে নিয়ে ভাবনার অতলান্তে হারিয়ে গেছে।
রাহাতের সাড়ায় শিহাবের ঘোর কাটল।
আচ্ছা, আপনাকে আমি ভাইয়া বলে ডাকতে চাই,যদি অনুমতি মিলে
অফ কোর্স, নো প্রবলেমএট অল।
আচ্ছা ভাইয়া আপনার নিজেকে নিয়ে এখন আপনার ভাবনা কী?
শিহাব বুঝতে পারলো রাহাত কী জানতে চাইছে।শিহাব এমনিতেই ভীষণ শার্প ব্রেইনের
শুধু নিজের অজান্তেই জীবনটা এলোমেলো হয়েছে।আমার নিজেকে নিয়ে ভাবনা মানেই তো শায়লাকে নিয়ে আমার ভাবনা।আর ব্যাপারটা যখন শায়লার পরিবারে প্রকাশ পেয়েছে তো তাদের তো এই জিজ্ঞাস্য থাকতেই পারে। যদিও পরিচয়ের শুরুতে অনেক শর্ত আরোপ করে শিহাব শায়লাকে দেখা দিয়েছিল।কথা ছিল শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্কে বাঁধা থাকবে দুজন।কিন্তু শিহাবের দীর্ঘ একার জীবনে শায়লার সাথে পরিচয় পথচলা শিহাবকে নতুন করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখিয়েছে,কল্পনায় শায়লাকে দৃষ্টি সীমায় নিয়ে কতইনা না বলা অনুভুতির ইচ্ছা ধরে রেখেছে।প্রতিনিয়ত শায়লার অমন মায়াভরা মুখচ্ছবিটা মনের পর্দায় ভেসেছে। শায়লা যেন আঁধার ঘন রাতের একাকীত্বের পর হঠাৎ ঝলকে উঠা এক গনগনে সূর্য। শিহাব নিজের এই সত্যগুলোকে যদি অস্বীকার করে তবে তার নিজের সাথে নিজেরই প্রতারণা করা হবে।হ্যাঁ, শায়লার অমনভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়া শিহাবকেও আতংকিত করেছে! শায়লা তাকে এতটাই ভালবেসেছে! শিহাবকে একেবারে চমকে গিয়েছে!আসলে মেয়েদের এই বন্ধনেবাঁধার শক্তিটা ভীষণ মজবুত। শায়লা তার বিবাহিত জীবনটা নিয়ে সুখী নয়, শিহাবেরও সংসারটা শুরু হতে না হতেই তা ভেঙে গিয়েছে।আর এই অপ্রাপ্তির কারনেই আজ একটা সত্যের কিনারায় সে এসে দাঁড়িয়েছে। যতই শায়লাকে বন্ধুত্বের সম্পর্কে রাখতে চাইছে কিন্তু
ভাললাগা ভালবাসার অপ্রতিরোধ্য স্রোত যেন দুজনকে ভাসিয়ে নিচ্ছে দূর দূরান্তে।
রাহাত বলে উঠল, ভাইয়া কি কিছু ভাবছেন ?
শিহাব বেশ স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে জানালো হ্যাঁ শায়লা আর আমার কথা ভাবছি। রাহাত তুমি নিশ্চয়ই আমার অতীতটা জেনেছো।আর তা নিয়ে বহুদিন একটা সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। জীবনে আর কাউকে আপন করবো না ভেবেরেখেছিলাম। কিন্তু শায়লা আমায় একেবারে বদলে দিল।
রাহাত কথা প্রসঙ্গে বললো,আপুর কানাডার যাওয়ার ব্যাপারে তবে কি আমরা আর আগাবো নাকি অন্যকিছু ভাববো?
সে সিদ্ধান্ত শায়লার।
তবে আমি স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছি শায়লা আমায় আপন করলে আমার দিক থেকে সম্পূর্ণ সম্মতি থাকবে।চাইলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি শায়লাকে বিয়ে করতে কোন আপত্তি থাকবে না।
রাহাত এত কথার পরেও কেমন যেনো আশ্বস্ত হতে পারছে না। যদি পরে শিহাব মত পাল্টে ফেলে তবে তো আপুর দুই দিকই হারিয়ে যাবে !
নাহ,রাহাত আর কিছু ভাবতে পারছে না। যেখানে আপু একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির স্ত্রী তার কাছে থেকে ছাড়া পাওয়া কি এতই সহজ হবে ? তবুও রাহাত আপুকে সুখী দেখতে চায়। তবে কি কানাডায় নোমান সাহেবকে আপুর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো ? কেমন করে বা কোন যুক্তিতে সে ডিভোর্স দিবে? তবুও রাহাতের এই ভেবেই ভালো লাগছে যে,শিহাব ভাইয়া কোন ভনিতা না করে স্পষ্ট করেই বলেছে,,যেখানে দুজনার মাঝে এতটাই বোঝাপড়া সেখানে আপুর চেয়ে প্রায় পনের বছরের বড় দুই সন্তানের পিতাকে কী গ্রহন করা যায়? একবার যে ভুল হয়েছে তা আর এগুতে দিবে না রাহাত। তাইতো সিদ্ধান্ত হলো শায়লা নোমান সাহেবকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে। আবার পরক্ষণেই রাহাত উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো,, একজনের মুখের কথায় এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়া কী ঠিক হবে? রাহাত দ্বিধা দ্বন্দের মাঝে ফোন থেকে বিদায় চেয়ে নিলো।অপরপ্রান্তে মনের সব কথা খুলে বলতে পারাতে শিহাবের নিজেকেও বেশ হালকা লাগছে।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much