শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৪৭)
শামীমা আহমেদ
সারাদিনের ছুটোছুটি আর জীবনের পট পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায় শিহাবের একদিকে যেমন বিরাট একটা মানসিক চাপ। অপরদিকে প্রচন্ড ক্লান্তির সাথেও ভালোলাগার এক অনাবিল মোহময়তার মিশ্রণ।শিহাব যেন পুরোপুরি শায়লা অনুভবে একেবারে ডুবে আছে। মনে হলো অনেক অনেকদিন পর শিহাবের আকাশের কালো মেঘ কেটে গেছে, হয়েছে অবাক সূর্যোদয়! আর সেই সূর্যের আড়াল থেকে শায়লার হাসিমাখা মুখের তীব্র এক আকর্ষণ, তাকে বারবার টেনে নেয় মেঘের ওপারে।
শায়লাকে নিয়ে এমনি মনের নানান ভাবনার ভেসে চলায় শিহাব কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও বলতে পারবে না।সেই যে সেই ছোটবেলায় ঈদের দিনের মতন নতুন পোশাক আর নতুন জুতো পরে সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়া। আজ যেন তেমনি মনে হলো।শিহাব ঘুম থেকে জেগে নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিলো।সসন্ধ্যায় শায়লাকে নামিয়ে বাসায় ফেরা, সে ভাবেই, সে পোষাকেই বেশ একঘুম ঘুমিয়ে নেয়া। হাতের মুঠোয় সেভাবেই মোবাইলটা ধরা। লাস্ট কল শায়লার কাছে,রাত আটটা বিশ মিনিটে। এখন ঘড়ির কাটা এগারোটা ছুইছুই। বেশ এক ঘুম ঘুমিয়ে নেয়া হয়েছে।
শিহাব বিছানা ছাড়লো।কাপড় বদলে নিতেই পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা অনুভূত হলো।কি করা!ফ্রিজে বেশ ক'দিনের পুরনো খাবার। সেই একই খাবারের পুনরাবৃত্তি! আর ভালো লাগে না।যদিও এতদিন খাবারের ব্যাপারে এ ধরনের কোন অনিচ্ছা কাজ করেনি।তবে কি অবচেতন মনে শিহাব শায়লার উপস্থিতি কামনা করছে!নিশ্চয়ই শায়লা থাকলে তার এ ব্যাপারগুলো খেয়াল রাখতো।
তক্ষুণি শায়লার মেসেজ! রাতের খাবার খেয়েছো?
শিহাব কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।খেয়েছি বললে মিথ্যা বলা হবে আবার খাইনি বললে শায়লার বকুনি শুনতে হবে।তাইতো বুদ্ধি করে মাঝামাঝি একটা উত্তর জানিয়ে দিলো।এইতো এখুনি খেতে বসবো।
শায়লা ভেবে দেখলো তাদের আজকের এই স্মরণীয় দিনটি শেষ হতে রাতের আর আধা ঘন্টা সময় বাকী! আজ বিকেল সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শায়লাকে ভীষণভাবে আবেগী করে তুলছে।শিহাবকে এতটা কাছে পেয়ে কেমন যেন একটা পূর্ণতা আবার কি যেন পেয়েও হারানোর একটা শূন্যতার হাওয়া বারবার বুকে আঘাত করছে।
কেন যে খাবার খেতে এত রাত করো? শরীর খারাপ করবে তো! শায়লার খবরদারিটা শিহাব বেশ এনজয় করে।মেয়েরা স্ত্রী হওয়ার লাইসেন্স পেলেই রাতারাতি প্রেমিকা থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের মত খবরদারি শুরু করে দেয়া আর এক্সাম হলের মত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে।
----শিহাব শীঘ্রই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।
কিন্তু শিহাবতো নিজেই জানেনা আজ সে কী খাবে।তাইতো কথা ঘুরিয়ে বললো, ঘুম থেকে এইতো জাগলাম।আজ রাতে আর ঘুম হবে না।খেয়ে একটা ইংলিশ মুভি দেখবো।
শায়লা তুমি মুভি দেখোনা?
নাহ! বুঝিনা বলে অতটা আগ্রহ পাইনা।
আচ্ছা, আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিবো।দুজন একসাথে বসে মুভি দেখবো। তুমি আমার খুব কাছে থাকবে তখন।
জানো শায়লা,এখন যেন আরো খুব বেশী করে তোমার কথা মনে পড়ে।
শায়লা নীরব হয়ে আছে।একটু পরেই বলে উঠলো, আচ্ছা তুমি খেয়ে নাও। কথা পরে হবে।
তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।
আচ্ছা,ঠিক আছে।
যদিও শায়লা ঘুমের সম্মতি দিলো কিন্তু আদৌ আজ তার ঘুম হবে কিনা সন্দেহ!
শিহাব কল এন্ড করে মহা ভাবনায় পড়ে গেলো এখন কি খাওয়া যায়!হঠাৎই তার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি এলো,
কোল্ড কফি করে নেয়া যায়।সাথে চকলেট কুকিজ। যাক, আর দেরী না। শিহাব
কফি মেকারে ঠান্ডা পানি, মিল্ক ক্রীম আর কফি ডাস্ট, সামান্য সুগার ছেড়ে দিলো।বাটন প্রেস করতেই ফোমি কফি তৈরি। এক মগ ঢেলে নিয়ে কুকিজ বক্স নিয়ে বসে পড়া।শিহাব চ্যানেল ঘুরিয়ে মুভি চ্যানেলে থামল।"মি বিফোর ইউ",মুভিটি চলছে।যদিও বহুবার দেখা এটা, তবুও বহুল দেখা ছবি প্রতিবার দেখায় আবার যেন একটা নতুন উপলব্ধি বা ফিলিংস বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাজ করে!
শিহাব এই মুভিটাতেই আটকে গেলো।
শিহাবের এই একার জীবনে মুভি আর গান যেন টনিক হয়ে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
মুভি শেষ হতে প্রায় রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেলো। হু, এখন একটু ঘুমাতে হবে।চোখ যেন একটু ক্লান্ত হলো!
ট্রুং করে করে মেসেজ এলো।শায়লার মেসেজ।মুভি শেষ হলো?
হ্যা,এইতো শেষ হলো।কেমন করে বুঝলে?
আমি তোমার চোখের সবটা যে পড়ে নিয়েছি শিহাব।
তা আমি না হয় মুভি দেখেছি,তুমি ঘুমাওনি কেন?
তুমিতো আমায় শুভরাত্রি বলোনি।তাই রাতটা শুভ হয়নি।ঘুম আসেনি।
এটা কোন কথা হলো।এই যে এক্ষন বললাম শুভরাত্রি শুভরাত্রি,, শিগগীর ঘুমাও।
কিন্তু শিহাব, আমার কেমন যেন ভয় করছে।
কিসের ভয়?
এই যে আমাদের মনের এত ভাবনা,এত চাওয়া, এত ইচ্ছা এগুলো সত্যি হবেতো?
কেন হবে না,কিসের ভয়? আমি আছি না? রাহাত আছে আমাদের পাশে,তুমি মনে সাহস রাখো শায়লা।এসব ভেবে শরীর খারাপ করোনা।সামনে আমাদের জন্য শুধু সুখ আর সুখ অপেক্ষা করছে।তুমি আমি এতদিনতো কম পরীক্ষা দেইনি।নিজেদের সংযত রেখেছি।আজ আমরা তার পুরষ্কার পেতে যাচ্ছি।তুমি মনে মিছে কোন ভাবনা এনোনা।
শায়লা, আমি আজ তোমার হাত ধরেছি, সারাজীবনে আর ছাড়বো না।তুমি আমার বুকে ভরসা খুঁজেছো,তা চিরকালের ভরসাস্থল হয়েই থাকবে।
শায়লা কেঁদোনা।তোমার কান্নার দিন শেষ আর আমার একলা থাকার দিনের অবসান হতে যাচ্ছে।জানোতো, শেষ আর অবসান ওরা জমজ ভাই।তাই তোমার আমার বিরহকালের শীঘ্রই সমাপ্তি,, বাজছে সোনালী দিনের আগমনী।
শায়লা,আজ নীল শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছিল।
তোমাকেও ঘিয়া রংটিতে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না।
জানো শায়লা,কত কতবারই না আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম,ভালবাসতে বারণ করলাম কিন্তু জানো একবারও তা মন থেকে বলিনি।বারবারই ভেবেছি, তুমি যেন আমায় একেবারে ছেড়ে না যাও,তাইতো শুধু বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তোমাকে আটকে রাখতে চেয়েছি, শুধু একটা সম্পর্কের বাধনে হলেও তোমাকে যেন কাছে পাই সে চেষ্টায় থেকেছি।তাইতো এত নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছি।শায়লা কিছু বলছো না যে? শায়লা?
আহ! ঘুমিয়ে পড়েছে।
কেমন করে একটা মেয়ে এতটা আকুল হয়ে ভালবাসতে পারে,কিছু কিছু মেয়ে স্বামীর কাছ থেকে শুধু আর্থিক ভোগ বিলাস পেতে চায় কিন্তু শিহাবের জীবনে রিশতিনা, শায়লার মত মেয়েদের আগমন ঘটেছে।রিশতিনার নিঃস্বার্থ ভালবাসায় কেন ঝড় উঠেছিল শিহাব আজো তার উত্তর খুঁজে পায়না।কিন্তু এবার আর শায়লাকে সে হারাতে চায় না। ভাগ্যের সাথে এবার তার বোঝাপড়া হবে।কিছুতেই সে হার মানবে না।যে কোন মূল্যে সে শায়লাকে ধরে রাখবে।শায়লার ও প্রান্ত নীরব।শিহাবও তাই ঘুমের প্রস্তুতি নিলো।
সকালে ঘুম থেকে জেগে,শিহাব অফিসে যাওয়ার আগে শায়লার মোবাইলে শুভ সকাল মেসেজ রাখলো।আর লিখে রাখলো, আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো শায়লা।কোনদিন কোনভাবে আমাকে ভুল বুঝোনা।বাই।
শিহাব নাস্তা ছাড়াই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।অফিসে গিয়ে অফিস এসিস্ট্যান্ট কবির ছেলেটাকে দিয়ে নাস্তা আনিয়ে খেয়ে নিবে। কবে শায়লা তার ঘরে আসবে আর তার কঢতের দিন ফুরাবে! শিহাব অফিসে পৌছে রুমে ঢুকতেই কবির জানালো একটা ছেলে আপনার সাথে দেখা করার জন্য সেই সকাল থেকে বসে আছে।আমি কতবার জানতে চাইলাম আপনি কে, কেন স্যারকে খুজছেন,কে পাঠিয়েছে,একটা প্রশ্নের উত্তর সে দিচ্ছেনা।শুধু বলে, আমি শিহাব স্যারের কাছে সব বলবো। এবার শিহাবের খেয়াল হলো, হ্যা,অফিস রুমে ঢুকার আগে খুবই সাধারন পোষাকের একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে।শিহাবের বেশ কৌতুহল হলো।
শিহাব কবিরকে বললো, ঠিকাছে যাও,ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে আসো।আর হ্যাঁ,কবির,তুমি কিন্তু রুমেই থাকবে। অচেনা এমন একটা লোক কেন কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, সাবধান থাকতে হবে।
কবির ছেলেটিকে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে গেলো। শিহাব গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো,কি জানি কোন চাকরী বা টাকার সাহায্যের জন্যই এসেছে কিনা। শিহাব বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো।টেনশন কমাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলো
কবির ছেলেটিকে নিয়ে রুমে ঢুকলো। শিহাবকে সালাম দিলো।শিহাব উত্তর দিয়ে বসতে বললো।বেশ বিনীতভাবেই জানতে চাইল, আপনিকি বলতে চাইছেন নির্বিঘ্নে বলুন।রাখার মত হলে অবশ্যই রাখবো।কবির রুমে থাকাতে ছেলেটা ইতস্তত করছে।
শিহাব ইশারায় কবিরকে বাইরে যেতে বললো।শিহাবের কৌতুহল বেড়েই চলেছে
এবার ছেলেটি বললো, আমার নাম মিলন। আমার বাবার নাম জয়নাল দেওয়ান।আমার বাবা ঝিগাতলায় জজবাড়ির দারোয়ান ছিল।
শিহাবের এবার মনে পড়লো।এই জয়নালকেই একদিন শিহাবের মোবাইল নাম্বার নেয়ার জন্য রিশতিনা পাঠিয়েছিল! আজ তার ছেলে মিলন কি সেই যোগসূত্রেই কোন সাহায্য চাইতে এসেছে।সাহায্য দিতে শিহাবের কোন আপত্তি নেই।কিন্তু মনে হচ্ছে ছেলেটা আরো কিছু বলতে চায়।
এবার বললো, আমাকে রিশতিনা আপু পাঠিয়েছে।আপু আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আজ দুপুরে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে। মিলন একটা কাগজ এগিয়ে দিলো যেখানে রেস্টুরেন্টের নাম আর সময় লেখা। জিনজিয়ান রেস্টুরেন্টে বেলা আড়াইটায়। শিহাব ঘড়ি দেখলো। সকাল সাড়ে দশটা বাজছে।শিহাব ছেলেটিকে কী বলবে বুঝতে পারছে না।তার সামনে শুধু শায়লার অভিমানী মুখটা ভেসে উঠছে আর রিশতিনার মুখটা অস্পষ্ট লাগছে।শিহাব কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।ছেলেটি আবার বললো, আপু অপেক্ষায় থাকবে।আপনাকে যেতেই হবে।আপনার সাথে অনেক কথা আছে। রিশতিনা দেশে কবে এলো? কেন এলো? আর এলোই যদি তবে আরেকটা দিন আগে কেন এলো না।ল?শিহাবতো তার জন্য অনেক অপেক্ষায় ছিলো। মিলন বিদায় নিলো।শিহাব আনমনা হয়ে রইল।অতীত স্মৃতি সব শায়লার ভাবনাকে ম্লান করে দিতে চাচ্ছে।উফ! আবার জীবন পরীক্ষা! আর কত?
হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো।শিহাব চমকে উঠলো! তাকিয়ে দেখলো মায়ের কল।শিহাব স্বস্তি পেলো।সন্তানের বিপদে মায়েরা ঠিকই টের পায়।শিহাব কল রিসিভ করলো।মা কেমন আছো?
বাবা আমি আরাফ, তুমি কবে আসবে বাবা? আমার জন্য চক্কেত আনবে।
হ্যাঁ,বাবা আনবো।আরাফ তার জীবনের অনেকখানি।সেতো রিশতিনারও সন্তান।তবে কী রিশতিনা আরাফের ভাগ নিতে এসেছে?
প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় শিহাব অন্যমনস্ক হয়ে রইল।আঙুলের ফাঁকে আটকে রাখা সিগারেট কাঠিটি একা একাই পুড়ছে।চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much