১০ ডিসেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ 






শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ২৭)
শামীমা আহমেদ 



                                             জ ক'দিন যাবৎ শায়লার খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। একটা সুখবরে তাদের পরিবারে আনন্দের ঢেউ বইছে! অনেকদিন পর শায়লা তার মাকে যেন সেই আগের রূপে দেখতে পাচ্ছে। সেই যে স্কুলে যাবার দিনগুলোতে যেমন করে মা হাসত, মায়ের চোখটা সুন্দর আগামীর স্বপ্ন বুনতো, তেমনি করে মা যেন হাসছে, তার কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। প্রতিদিনই নানান আবদার বায়না আর দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে শায়লার কাছে নানান কিছুর চাহিদা বেড়েই চলেছে। শায়লা খুশি মনেই তা গ্রহন করছে।
গত সোমবার রাতে শায়লার ছোট বোন নায়লা সেই সুখবরটি শুনিয়েছে। মাত্রই তখন নায়লা আর মোর্শেদ  ডাক্তারের কাছে থেকে বাসায় ফিরেছে। খবরটি অবশ্য নায়লার শ্বাশুড়ি, শায়লার মা অর্থাৎ বিয়াইনকে জানিয়েছে।
সুখবর বিয়াইন,আপনি নানী আর আমি দাদী হতে যাচ্ছি!! দুজনের সেকি আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের কথোপকথন!!অনেকদিন পর যেন  মায়ের মাঝে প্রাণ ফিরে এলো।

এরপর থেকেই চলছে তার নানান প্রস্তুতি।
শায়লা কাগজে লিস্টিতে একে একে সব লিখে রাখছে। ইতিমধ্যেই দুই পাতার লিস্টি হয়ে গেছে। শায়লা লিখছে আর সাথে নিজের মাতৃত্বের আবেশ আবেগ অনুভব করছে।এ এক অপার আনন্দ,দূর্লভ প্রাপ্তি!

এমন আনন্দের ঢেউয়ের ব্যস্ততায় বেশ ক'দিন হলো শিহাবের কোন খোঁজ  নেয়া হচ্ছে না।শিহাবের দিক থেকেও কোন সাড়া মিলছে না। শায়লা রাতের খাবারের পর সব গুছিয়ে প্রায় রাত এগারোটায় ঘরে এলো। 
ভীষণ ক্লান্তিতে শায়লা ঘুমের কোলে  ঢলে পড়লো। 

উত্তাল সাগরে প্রচন্ড ঢেউয়ের দাপটের মাঝে সাদা ধবধবে একটা বিশাল জাহাজ এগিয়ে চলছে।রাতের আলো আঁধারিতে ঢেউয়ের সাদা ফেনাগুলো যেন ফুঁসে উঠছে! শায়লা জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে। তাকে ঘেষে খুব কাছে শিহাব দাঁড়িয়ে। বাতাসে এলোমেলো চুলে বারবার শায়লার মুখটি ঢেকে যাচ্ছিল।জাহাজের দুলুনিতে শায়লা ভীষণ ভয় পাচ্ছিল! ক্রমশই জাহাজটি প্রচন্ড বেগে চলতে থাকে।শায়লা শিহাবকে খাঁমচে ধরে আছে।কিন্তু শিহাব শায়লার দিকে একেবারেই তাকাচ্ছে না। 
এমন একটি ভয়ার্ত স্বপ্ন দেখে শায়লার ঘুম ভেঙে গেলো!জেগে দেখলো সে ঘেমে নেয়ে একাকার।আজ ফ্যান না চালিয়েই  ঘুমিয়ে পড়েছিল।শায়লা বালিশের পাশে রাখা  মোবাইলটি তুলে নিলো।রাত একটা বাজছে। শায়লা শিহাবকে মেসেজ পাঠালো?
কেমন আছেন? আমি খোঁজ নেইনি বলে কী আমার একটা খোঁজ নেয়া যায় না? 

পাঁচ মিনিট  দশ মিনিট চলে গেলো, শায়লা বারবার মোবাইল স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। কোন সাড়া নেই। এভাবে প্রায় তিরিশ মিনিট চলে গেলো। শায়লা বুঝতে পারছে না শিহাব কি কোন কাজে ব্যস্ত নাকি খাবার খাচ্ছে, নাকি ঘুমিয়ে গেছে।যে ক্লান্ত থাকে! একা একা খাবার নিয়ে খেতেও চায়না মাঝে মাঝে ।শায়লার মন মানছে না। এতদিন এভাবে কোন কথা বলা ছাড়া থাকা হয়নি।এবার শায়লা কল  দিল। শিহাব কল রিসিভ করলো।
কিন্তু কন্ঠটা কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। 
শায়লার উৎকন্ঠিত জিজ্ঞাসায় উত্তর এলো, আমি খুব অসুস্থ।আজ দুপুর থেকে বেশ জ্বর। গত দুদিন অল্প অল্প ছিল কিন্তু আজ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।ঘরে শুধু আমি একা শুয়ে আছি।কিছুই ভালো লাগছে না। আমি সারাক্ষন আপনার একটা কলের অপেক্ষায় ছিলাম।
শায়লার ভেতরে অস্থিরতা খেলে গেলো!  আর বাইরে কপট রাগতঃ স্বরে শিহাবকে শাসনের সুরে বলে চললো, এভাবে ভাবলে কি চলবে? অসুস্থ হলে একটুতো জানাতে হবে,,আমি কি  দৈবক্রমে,টেলিপ্যাথিতে তা জেনে যাবো? শায়লা অভিমানের সুরে বললো, তাছাড়া আমি আপনার কে এমন, যে এতোখানি ভাববো?
শায়লার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়।

শিহাবের কন্ঠে যত অনুযোগের সুর ঝরে পড়লো।
কেন শায়লা, আপনি মনের ভেতরে টের পাননি যে আমি অসুস্থ? আপনার অনুভুতিতে কেউ বলেনি,প্রচন্ড তাপমাত্রা আমায় পুড়িয়ে দিচ্ছে,আর ভেতরে ভেতরে আপনার জন্য আমার দহন কয়লার আগুনের মত  জ্বলছে।যার জন্য আপনি এত আকুল হয়ে থাকেন, যাকে দেখার জন্য লোকচক্ষু উপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন, যাকে এক নজর দেখার জন্য কান্নায় ভেঙে পড়েন,যে মাইলের পর মাইল  পথ পাড়ি দিয়ে শত ক্লান্তিতেও আপনাকে দেখার জন্য ছুটে আসে। যে আপনাকে বারান্দায় গ্রীলের ফাঁক দিয়ে শুধু একটু দেখার জন্য নানান বাহানায় সেই চেনা পথটা পেরিয়ে যায়,যে খাবার সামনে রেখে  আপনার উপস্থিতি দেখতে পায়, আপন মনে একা ঘরে অদৃশ্য আপনার সাথে কথা বলে চলে, চোখ বুঁজে কল্পনায় গানের সুরে যে আপনাকে ভেবে চলে,আপনাকে না ছুঁয়েও যে ছুঁয়ে যাওয়ার স্পর্শ টের পায়, যার শূন্য জায়গাটা আপনি পূর্ন করতে চেয়েছিলেন,সেই আপনিই তো বলেছিলেন আমাকে আপনি সম্পূর্ণ বুঝতে পারেন।তাহলে কেন বুঝলেন না আমি একা কেমন আছি।কেন এতদিন নীরব রইলেন।কেন খোঁজ নিলেন না বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি?শায়লা কেন এমন নীরব রইলেন?
শায়লা,,,আমি সারাক্ষন ভেবেছি আমার দরজায় তুমি এসেছো।  বিছানার পাশে বসে আমার কপালে তোমার হাত রাখছো।শায়লা আমি তোমাকে কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি। আমার মাথায় তুমি জল ঢালছো আর আমি একদৃষ্টে তোমার মায়াভরা মুখটায় তাকিয়ে আছি।
জানো শায়লা, অনেকদিন হলো কেউ আমায় খুব যত্ন করে মুখে খাবার তুলে খাওয়ায় না,কেউ আমার গোসলের পর টাওয়েল এগিয়ে দেয় না,মাথার ভেজা চুল মুছিয়ে দেয় না, খুব আবেগে কাছে টেনে নেয় না,কিছু চাওয়া পাওয়ার আবদারে অস্ফুট স্বরে অভিমান গলে পড়ে না,কেউ আমার জন্য না খেয়ে দরজার কলিংবেলের  অপেক্ষায় থাকে না,কেউ আমাকে শার্টের সাথে প্যান্টের কালার ম্যাচ করিয়ে দেয় না,কেউ বলেনা আজ তোমার প্রিয় প্রিয় খাবারগুলো রেঁধেছি, তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসো,কেউ আমাকে গরম স্যুপ ফুঁ দিয়ে খাইয়ে দেয়না, টিসু দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়না।কেউ বলেনা আজ তুমি আমার কাছে থাকবে অফিসে যাবে না,কেউ বলে না তোমাকে ছেড়ে একা থাকতে আমার একটুও ভালো লাগেনা, কেউ বলেনা শুধু তোমাকে পেলেই আমার সব পাওয়া হয়,,শায়লা,
তুমিও আমাকে বুঝলে না।তুমিও আমাকে খুঁজলে না।তোমার মনে সাড়া এলোনা, আমার কষ্ট তুমি টের পেলে না?তবে কি আমার আপন বলে কেউ নেই? তবে কি ভেবে নিবো যার সাথেই হৃদয়ের টান থাকে সেই একসময় স্বার্থপর হয়ে যায়।আমায় ফেলে চলে যায়। কথাগুলো বলতে বলতে শিহাব একেবারে হাঁপিয়ে উঠলো। কিছুতেই থামছিল না।
শায়লা নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবছে।জ্বরের ঘোরে শিহাব এলোমেলো বলছে।
বিরাট একটা ভুল হয়ে গেলো। শায়লা নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে। আসলেই সে স্বার্থপর হয়ে গেছে।শুধু নিযের উৎকন্ঠার দিনে শিহাবকে দেখতে চাওয়া। শিহাবের কলের জন্য অপেক্ষায় থাকা।শিহাবের কন্ঠ শুনে শিহরিত হওয়া।কখনো তার মনের দিকটা সে  ভেবে দেখেনি।শায়লা বুঝতেও পারছেনা,কবে থেকে শিহাব শায়লার জন্য এতটা আকুল হয়ে উঠলো।সেতো সবসময় নিজের আবেগকে আড়াল করে রাখে।
আজ শিহাব বুঝবে কাউকে আপন করে পেতে চাইলে সেটা তাকে বুঝতে দিতে হয় নয়তো অপর প্রান্তে, না বুঝা মনে কেবল দূরত্বই বাড়তে থাকে। শায়লা খুবই অনুশোচনায় পড়ে গেলো।একদিন অবসরে খোঁজ নেয়া উচিত ছিল।শায়লা দেখেছে  যখনই সে একটু অনত্র ব্যস্ত হয়েছে তখনি শিহাবের একটা ঝামেলা হয়েছে।শায়লার ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি  ছুটে শিহাবের বাসায়  যেতে।  ওর পাশে বসে কপালের জলপট্টি বদলে দিয়ে  জ্বরকে বুঝিয়ে দিতে তুমি যতই আবাস নিতে চাও না কেন আমার জাগয়াটা কখনোই ছাড়বো না। পৃথিবীতে পুরুষরা শুধু বদনামেরই ভাগীদার হয়। নারীরা পুরুষের  সহিংসতার শিকার হয়।কিন্তু কত কতজন যে সমাজ সংসারে সম্মান রক্ষার্থে নিজেকে নীরবে নিভৃতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে তিলে তিলে  শেষ করে দেয়,তাবৎ পুরুষকুলেরই তা অজানা রয়ে যায়। আবার নিন্দার কালিমা নিয়েও কত জন  উদ্ধত আচরণে নির্লজ্জের মত চলে। কিন্তু শিহাবের ভেতরে যেন একটা নিষ্পাপ শিশুর বাস। শায়লা টের পেলো শিহাব খুব শক্ত করে শায়লার হাতটি ধরে আছে। যেন বলতে চাইছে তোমাকে আমি  কোনভাবেই আর যেতে দিবো না। শায়লার  চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে।জ্বরের ঘোরে, গভীর ঘুমের শিহাবের দিকে তাকিয়ে শায়লার খুব মায়া হতে লাগল।ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, শিহাব, তোমাকে ছেড়ে আমি কোনদিনই যাবো না। আজীবন আমি তোমার হয়েই থাকবো।খুব আলতো করে শায়লা ঘুমন্ত শিহাবের বুকে মাথা রাখল।পরক্ষণেই আচমকা শিহাব দুহাতে শক্ত করে শায়লাকে তার বুকের সাথে বেঁধে রাখল।



চলবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much