২৮ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস "অলিখিত শর্ত" পর্ব ২১

 স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র  নতুন ধারাবাহিক  উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ২১)
   শামীমা আহমেদ 


                                                     জ সারাদিন শিহাবের কোন সাড়া নেই।
না কোন ফোন কল, না মেসেজ! শায়লা কোনভাবেই কাজে মন বসাতে পারছে না। কোন ফোন এলে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেছে কিন্তু না, সেটা শিহাবের কল নয়।তবুও ধরতে হয়, কথা বলতে হয়।
ফোনে কখনো মাছওয়ালা,ইয়া লম্বা বেশ বয়স্ক একজন লোক। সারাক্ষণ আম্মা আম্মা করে কথা বলে।আম্মা ভালো মাছ আছে, আমনে কইলে কাইট্টা পাঠায়ে দেই, আম্মা নদীর মাছ, খাইয়া টাকা দিবেন, এত বয়স হইছে মাছ বেচি কেউ খারাপ কয় নাইক্কা।আবার কখনো মুরগীওয়ালা,সে আবার আন্টি সম্বোধনে মুরগি কেনায় উৎসাহিত করবে।চারটা মুরগির অর্ডার দিলে আটটা দিয়ে যাবে।আন্টি রাইখা দেন। টাকা দেওয়া লাগবো না।আজ রেট কম যাইতাছে।আগামী সপ্তায় দাম বাইরা যাইবো। প্রতিবারই একই কথা।একসাথে আটটা দশটা মুরগী বানিয়ে নিয়ে আসবে। শায়লার আর তা ফিরিয়ে দেয়া হয় না।
কিন্তু শায়লার আজ অন্য কোন ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না।সে একটা কলেরই অপেক্ষায়। মনের ভেতর অস্থিরতা উৎকন্ঠা নিয়ে বিকেল সন্ধ্যা কাটল।কেমন যেন একটা চাপা অভিমানও জমা হচ্ছিল।কি যেন! এক'দিনতো কথাবার্তায় খুব আপন হয়ে উঠেছিল।আজ কেন এই নীরবতা?
শায়লা রাত আটটায় একটা টিভি সিরিয়ালে মন দিতে চাইল।কিন্তু মন বারবার মোবাইলের দিকে চলে যাচ্ছে। বারবার ঘড়ি দেখছে।ঘড়ির কাটা দশটা ছুঁইছুঁই। 
হঠাৎ সব উৎকন্ঠা দূর করে শায়লার মোবাইলের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল!
হু, এমএ ওয়াইএ,,লেখা নামটি ভেসে উঠলো। শায়লা মায়া নামে শিহাবের নাম্বারটি সেভ করেছে।অনেক ভেবে এই নাম দেয়া।সে ভেবে দেখেছে শিহাবের জন্য তার মনের ভেতরে অনেক মায়া জমেছে,সেটা কি তার একাকীত্বের জন্য,নাকি তাকে ভালোবাসার আবেগ,নাকি  নিজের শূন্যস্থানটা পূরণ করার আকুতি।শায়লা তাতে দ্বিধান্বিত।। 
তবে এটা ঠিক, দুজনের  প্রায়ই কেমন যেন বেশ কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। যেমন, যখনি খুব নিবিষ্ট মনে শায়লা শিহাবকে ভাবে তখুনি তার কল চলে আসে। যখনি বিশেষ কিছু রান্না করছে,তখুনি শিহাবের কল, জানাবে এটা তার প্রিয় খাবার।তখুনি শায়লার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
একদিন  চা খাওয়াবে,নিজের সব কথা বলবে,তাও মনে হয় ভুলে বসে আছে।
শায়লা বেশ অভিমান নিয়ে কল রিসিভ করে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি।সারাদিন কেন কল করেন নি, কেমন আছেন,কোন ঝামেলা হয়েছে কিনা,কোন সমস্যা কিনা, আরাফ ভালো আছে তো? এমনি একপ্রস্থ প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করে উত্তর দেয়ার সুযোগ  না দিয়ে শায়লা অঝোরে কেঁদে ফেলে।
শিহাব নিজেকে খুবই অপরাধী ভাবতে থাকে।বুঝে নিল,তার বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে।তার বুঝা উচিত ছিল শায়লা তার কল না পেলে চিন্তায় থাকবে।শিহাব কোন উত্তর দিতে পারে না।সে বুঝে নেয় শায়লার মন কি চাইছে।আর এটার জন্য সে নিজেকেই দায়ী করছে।দিনের পর দিন কল করে  তার প্রতি শায়লার একটা নির্ভরতা এনেছে। জীবনের কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে শায়লা চলে যাচ্ছে। শিহাব নিজের ভেতরেও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।সেও রক্ত মাংসে গড়া একটা মানুষ। তার আবেগ অনুভুতিকে সে আর কত গলা টিপে হত্যা করবে আর কত নিজেকে শৃংখলে বেঁধে বন্দি জীবনে হাসফাস করে মরবে।কিন্তু এব্যাপারে সেতো শায়লাকে কখনো কোন স্বপ্ন দেখায়নি।কখনো একান্তে কোন সময় কাটায়নি। সারারাত কোন আবেগী কথায় ভোর করে দেয়নি। শায়লা যা ভেবেছে সেটা একান্তই তার ভাবনায়।
শায়লা একটু স্বাভাবিক হয়ে জানতে চাইল,কোথায় ছিলেন সারাদিন? অফিসের কোন ঝামেলা?
শিহাব অপরাধীর মত অস্ফুট স্বরে কেবল উত্তর দিলো,
না অফিসের কোন ঝামেলা না,আমি ভালো আছি। কয়েকজন বন্ধু মিলে আজ অনেক দূরে একটা খোলা যায়গায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। তিনটি বাইক নিয়ে নয়জন বন্ধু গিয়েছিলাম।সারা মাস কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।এবার শিহাব একটু হালকা হলো।তার মনেও প্রশ্ন এলো, শায়লা, আপনি কেন আমার কোন খোঁজ নেননি।একটা কল করেননি,এতই যদি চিন্তা করেছেন তো একটা কল দিয়ে খোঁজ নিতেন বেঁচে আছি কিনা?
শায়লা এরপর যা বললো তা আগেই আঁচ করতে পেরেছিল শিহাব।
শিহাব, তোমাকে আমি অনেক আপন করে ফেলেছি।আমি নিজেকে মানাতে পারছিনা।তুমি কি বলবে আমি কোন ভুল করছি কিনা?
শিহাব শায়লাকে জানালো,
আমায় আপন করে তুমি কোন ভুল  করোনি।কিন্তু আমায় 'তুমি' ডেকে ভুল করছো।তুমি শব্দটির অনেক শক্তি।রাতারাতি তা এক সমুদ্র দুরত্ব কমিয়ে দেয়।অনেক অধিকার নিয়ে দাঁড়ায়।অনেক চাওয়া পাওয়ার জন্ম দেয়। বহু আগেই শিহাব শায়লাকে কিছু অলিখিত শর্তের কথা জাবিয়েছিল(পর্ব২)।
শায়লা, আমিও সারাদিন তোমার একটা কলের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।বন্ধুদের সাথে গিয়েছি শুধু বন্ধুত্ব রক্ষার্থে।
আর সারাক্ষণ একটা নামের কলের জন্য বারবার মোবাইল  চেক করেছি।একজন বিশেষ কেউ আমায় কল করবে আর "মায়া"
নামটি ভেসে উঠবে। শায়লা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! এমন কাকতালীয় ভাবে দুজনের নাম মিলে যাবে?
মনে হচ্ছে কে যেন তার সাথে লুকোচুরি খেলছে।আড়াল থেকে শায়লার সাথে দুষ্টুমির ছলে শিহাবের জন্য সে কেমন আকুল হয় সেটা পরীক্ষা করছে।
আমি যে তোমায় কল দেবো কেউ জানতে চাইলে তখন তুমি বিব্রত হতে।
কেন বিব্রত হবো,সাথে তো আমার বন্ধুরা,আমার স্ত্রী তো নয়, যে কিছু লুকাতে হবে।আচ্ছা,কথা হবে।ভীষণ ক্লান্ত।রাখছি বাই।
বলেই ফোনটা কেটে দিলো।
এই এক স্বভাব শিহাবের হুট করেই বিছিন্ন হয়ে যায়।
শায়লা শিহাবকে নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখলো লোকটা ফোনের কথায় বেশ ফরমাল।সামনাসামনি বেশ কেয়ারিং,মেসেঞ্জার কলে বেশ আন্তরিক আর মেসেজে যারপরনাই ভদ্র ও বিনীত ।

শিহাব ফ্রেশ হয়ে আজকের এ টু জেড অল 
পার্টস অফ ড্রেসেস ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিল।বলতে গেলে শিহাবের ফ্ল্যাটটা স্ত্রীবিহীন একটা সংসার। খুঁজলে সবই আছে। তার সবকিছু নিজের হাতে করতেই ভালো লাগে। 
শিহাব টিভি চালিয়ে দিল।আজকের নিউজ দেখা দরকার।দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের খোঁজখবর নেয়া দরকার।তবে যুগ যুগ ধরে সেই একই স্টাইলে খবর পড়া দেখতে একঘেয়েমি লেগে গেছে। অবশ্য এখন অনেক  চ্যানেল হয়েছে।তাদের খুব চেষ্টা খবরকে যত সাজ সজ্জা করে উপস্থাপন করা যায়। কিন্তু পাঠক পাঠিকারা সেই রচনা পড়ার মত করে মুখস্ত খবর পড়ে যায়। নিজেদের কোন স্টাইল যোগ করে না। শুধু মেকাপের বাহারে নায়িকা সাজে হাজির হওয়া।প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত চ্যানেল, তাই মানও তেমনি।
শিহাব একটা সিগারেট  ধরিয়ে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ আগে শায়লার সাথের কথাগুলো নিয়ে ভাবছিল।
না, এভাবে আবেগী হয়ে উঠলে তো চলবে না।শায়লা কোন ভুল করে ফেলতে পারে।
শিহাব আর কোন আবেগি সম্পর্কে জড়াবে না, মনকে আবার তা জানিয়ে দিলো।শায়লাকে কল করা কমিয়ে দিতে হবে।
এরপর থেকে শায়লা যতই দূর্বল হয় শিহাব ততই তাকে তাচ্ছিল্য করে, শায়লা  যতই আবেগী  হয় শিহাব ততই বাস্তববাদী কারণ দেখাতে থাকে।অলিখিত কিছু শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শিহাব শায়লাকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দিতে থাকে।


চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much