শায়লা-শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ২২)
শামীমা আহমেদ
শায়লার সাথে পরিচয়ের পর থেকেই শিহাবের মনে কেমন যেন একটা পরিবর্তন হয়ে যায়।কোলাহল হৈ চৈ বন্ধু আড্ডা পার্টি কিছুতেই আর ভাললাগাটা আসেনা। নীরবতাই বেশি উপভোগ করে। কেমন যেন সঙ্গীহীন জীবনে একাকীত্বের কষ্টটা পেয়ে বসেছে।একটা না পাওয়া বোধের অনুভুতি সারাক্ষন ভেতরে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। শিহাব বুঝতে পারছে না কেন এমন হচ্ছে।হঠাৎ করে শায়লা যেন তার হৃদয়ের শান্ত দীঘিতে কিসের আলোড়ন তুলে দিলো! ঘুমন্ত মনটাকে জাগিয়ে তুললো। সে তো ছিল একরকম।সব স্মৃতি ঢেকে রেখে স্বাভাবিক জীবনে চলছিল। কিন্তু আজকাল ইচ্ছে অনিচ্ছেগুলোও মনের অনুমতির কাছে ঘুরপাক খেতে থাকে।কতদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপনে কেমন যেন পাল্টে যাওয়ার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। দিনরাত্রি অন্যরকম একটাভাবনায় ডুবে থাকা। যেখানে বারবার শায়লার মুখটাই ভেসে উঠে!
ঘুরে ফিরে শায়লার কথাগুলোই কানে বাজে। রিশতিনার সাথে হাতে গোনা কিছু দিনের জীবনযাপন। রিশতিনার সবটুকু বুঝে উঠার আগেই সে হারিয়ে যায়।তারপর বহুদিন আর কোন মেয়েই তার ভাবনায় আসেনি।জীবনের উপর এমন ঝড় বয়ে যাবে তা কখনো শিহাব ভাবেনি।মা, ভাবীর শত চেষ্টাও তার মনকে ভুলাতে পারেনি।কিন্তু শায়লার মত এমন সহজ সরল অচেনা একটি মেয়ে কেমন করে এতটা ভাবনার গভীরে চলে এলো? সে প্রশ্ন শিহাব নিজেকে বারবার করেও তার কোন উত্তর পায় না।তবে কি কেউ কারো শুন্যতাটা পূরণ করতে পারে? তবে কি শায়লাকে রিশতিনার জায়গায় ভাববে শিহাব?শায়লা কি রিশতিনার ভিন্নরূপে এসেছে?
শিহাবের এলোমেলো ভাবনায় আজ মনটা অস্থিরতায়।আজ আর অফিসে যেতে মন চাইছে না আর তেমন কোন জরুরী কাজও রেখে আসেনি।যদিও প্রতিক্ষণই যোগাযোগে থাকতে হচ্ছে। শিহাব অফিস এসিস্ট্যান্টকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলো সে আজ অফিসে যাচ্ছে না। কোন জরুরী প্রয়োজন হলে যেন কল করে। তাছাড়া বাইকটারও একটি সারভিসিং দরকার।কমতো ডিউটি দিচ্ছে না।আজ দুপুরের পরে বেরিয়ে ওয়ার্কশপে দিয়ে আসবে।আর বিকেলটা বন্ধুদের সাথে কাটিয়ে দিবে।মাঝে মাঝে রুটিনের বাইরে যেতে শিহাবের ভালোই লাগে।তবে এটা মনে হয় সবার জন্যই প্রয়োজন।
শিহাব চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারান্দার টবে বেশ ফুল ফুটেছে! একেবারেই খেয়াল করা হয়নি।সেই সকালে বেরিয়ে গিয়ে রাতে ফেরা।সে খুব শখ করে টবের গাছগুলো লাগিয়েছে। শিহাব চারতলায় সিঙ্গেল ফ্ল্যাটে থাকে।উপরে বা পাশেও আর কোন ভাড়াটিয়া নেই।বেশ নিরিবিলি থাকা যায়।অবশ্য এগুলো দেখেই বাসাটা তার ভালো লেগে যায়।
মোবাইলটা ঘরে বিছানায় ছিল।হঠাৎ মোবাইলের রিং টোন কানে এলো। শিহাব ঘরে এসে মোবাইল হাতে তুলে নিলো। শায়লার কল। শায়লাকেই ভাবছিল এতক্ষন।তবে ভাবনার শায়লা একরকম আর বাস্তবে অন্যরকম।কারন ভাবনায় শায়লাকে শিহাব অনেকখানি ভেবে নিয়েছে, বাস্তবের শায়লার তা অজানা।
কেমন আছেন?
শায়লার প্রশ্নে শিহাব সঠিক করে বলতে পারছে না আসলে সে কেমন আছে।শায়লার ভাবনায় কতখানি ডুবে আছে।
এইতো ভালো আছি।
অফিসে কখন এলেন?
শিহাব দেখলো দুপুর একটা বাজছে।শায়লাকে জানালো, নাহ! আজ অফিসে যাইনি।
কেন শরীরটা খারাপ করেছে কি? শায়লার উদ্বিগ্নতায় জিজ্ঞাসা।
না না তেমন কিছু না।আজ তেমন একটা কাজ নেই।তাছাড়া মাঝে মাঝে একা থাকতে ভালোই লাগে।কিছু বলবেন?
না, সকাল থেকে কোন মেসেজ পাইনি, তাই ভাবলাম কেমন আছেন জেনে নেই।
শিহাবের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে,এই জানতে চাওয়াটা কি এমনিতেই নাকি আমাকে ভাবনাটা মন থেকে চাওয়া।অবশ্য তা আর জানা হয়না।
শিহাব বলে উঠলো, আপনি আর আমি একদিন কোন একটা খোলা জায়গায় ঘুরতে যাবো।আপনার কোন আপত্তি নেইতো?
শায়লা প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখে।খুব দূরে খোলা একটা যায়গায় সে আর একটি ছেলে হাঁটছে।স্বপ্নে শায়লার খুব চেষ্টা থাকতে সে মুখটি দেখবার।কিন্তু তা কখনোই স্পস্ট হয়না।তবে কি সেখানে শিহাবই থাকে?
কি হলো বললেন না? যাবেন একদিন ঐ খোলা যায়গাটায়।যেখানে আমি একা একা প্রায়ই যাই।
শায়লা আনমনা হয়ে যায়।কল্পনায় বহু দূর চলে যায়। সে আর শিহাব হাত ধরে একটা ছোট্ট নদীর তীরে দুজনে বসে আছে।নদীটার পানি তীর ছুইছুই করছে। মাঝে মাঝে শায়লা শিহাবের কাঁধে মাথা রাখছে। শিহাব তার চমৎকার কন্ঠে একটা গানের কলি গাইছে।কিন্তু ঘুম ভেঙে শায়লা আর কখনোই সেই গানটির কতজা মনে করতে পারে না।কাজের ফাঁকে কিংবা অবসরে খুব চেষ্টা থাকে গানটি স্মরণে আনবার।
শিহাবের ডাকে শায়লার সম্বিৎ ফিরে এলো।আর কিছু না ভেবেই বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই যাবো। কবে যাবেন বলেন?
আমি জানাবো। আপনার মায়ের অনুমুতি নিয়ে রাখবেন।আর সেদিন আমি আপনাকে আমার জীবনের সব কথা খুলে বলবো।
যদি চোখে জল ধরে রাখতে পারেন তবে বুঝবো আপনি খুব কঠিন মনের একজন মানুষ। আর যদি আমার দিকটা ভাবেন তবে দেখবেন কেমন করে একটা মানুষের সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েও বেঁচে থাকতে হয়।
শায়লা কথাগুলো শুনছিল আর এক অজানা আশংকায় চিন্তিত হয়ে উঠছিল।মনে মনে বলে উঠলো, না শিহাব আমি তোমার কোন অতীত শুনতে চাইনা।অতীতের তুমিটা অন্যকারো হয়েছিলে কিন্তু বর্তমানের এই তুমিটাকেই আমার ভালো লাগে। এই তুমিটাই আমার কাঙ্খিত।
শায়লা চোখ বন্ধ করে শিহাবের মুখটা ভেবে নিল।
শিহাব ওপ্রান্তে শায়লার সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায়।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much