২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২

শামীমা আহমেদ  এর ধারাবাহিক উপন্যাস পার্ব ৬৩





শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৬৩)
শামীমা আহমেদ 

সন্ধ্যার চা পর্ব শেষ করে গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে শায়লা নিজের ঘরে চলে এলো।নানান রকম খবরে কেমন যেন  মন বিষন্ন করা অনুভবে বিছানায় বসলো। ভাবনায় দুই বিপরীতমুখী মনের চলন! সারাদিন যেমন একটা অনন্য সুখের আবেশে ভেসেছিল এখন যেন ঠিক ততটাই  বেদনার সাগরে ভেসে চলা।সে জানে না এই ভেসে যাওয়া তাকে কতদূর নিবে।প্রতিটা মূহুর্তে শিহাবের অনুভুতি অনুভব তাকে আবেগী করে তুলছে আবার নোমান সাহেবের পিছুটান আশংকা হয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কেন জীবন আজ দুই দিকে দাঁড় করালো।নোমান সাহেব কেন এতদিন নীরব রইলেন?কেনইবা শায়লাকে আপন করে নেয়ার কোন আগ্রহই দেখাননি? শায়লাতো বয়সের ব্যবধানকে তুচ্ছ করেছিল।ভেবে ছিল মনটাই আসল। যদি তার সাথে মনের বন্ধন হয়ে যায় তবে আর বয়স কোন বাধা হবে না। তবে শায়লাকে নোমান সাহেবের বিয়ে করার প্রকৃত কারন যখন সে জেনেছে তখন তার প্রতি একরাশ ঘৃনাই জন্মেছে।মিথ্যে দিয়ে ঢেকেছে তার উদ্দেশ্য। দুজনার জীবনের শুরুটাই যদি এমন হয় তবে সেখানে আর কোন বিশ্বাস অবশিষ্ট থাকে না। বিয়ের পর তিনটি রাত তাদের একসাথে কাটলেও নোমান সাহেব কোন কিছুতেই এগিয়ে আসেননি। শায়লা বিছানার এক কোনায় একপাশ হয়ে নানান ভাবনায় থেকেছে।অজানা অচেনা ভিনদেশী মানুষ কোন অধিকার খাটায় নি বলে শায়লা তাকে বেশ ভদ্রলোকই ভেবেছিল।কিন্তু এখন মনে বারবার প্রশ্নটা  উঁকি দেয়,এটা কি তার নিছক ভদ্রতা ছিল, নাকি ছিল একধরনের উপেক্ষা? ফাইভ স্টার হোটেল রুমে শায়লার বতেমন করে বাসর সাজানো হয়নি,বিয়েতে  আর দশটি মেয়ের যেমন হয়।সেই যে তার শায়লাকে আপন করে না নেওয়া সেটা যেন বিশাল এক শূন্যতা হয়ে রইল।আর আচমকাই একটু একট করে, কেমন করে  শিহাব তার ভাবনায় জায়গা করে নিলো!দুজনেই যেন বঞ্চিতের দুঃখ ব্যথায় দুজনের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে।দুজনার শূন্য জায়গাটা পূরন করার আকুলতায় কাছে এসেছে। শায়লার চোখের কোনে পানি এসে জমলো।তার জীবনটা কেন সবসময় এমনি অপ্রাপ্তি দিয়ে ভরা? এমনি নীরব প্রশ্নে বুকের ভেতরটা অভিমানী হয়ে কেঁদে উঠলো।  নানান ভাবনার গভীরতায় ডুবে শায়লা গুটিসুটি হয়ে কখন যেন ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো।

রাহাত টিভির ক্রিকেট  খেলায় একেবারে ডুবে রইল।ছুটির দিনটি আজ  ঘরেই কাটালো রাহাত। চোখ টিভি স্ক্রিনে আটকে থাকলেও মনের ভেতর অনেক কিছুরই হিসেব চলছে।মাথার ভেতরে অনেককিছুর গণনার হিসেব চলছে।নোমান সাহেব আসতে আর দধদিন বাকী।তাইতো শায়লার বিষয়টি নিয়ে সে গভীরভাবে ভাবছে। শায়লার মুখের দিকে তাকালে রাহাতের মনটা কেঁদে উঠে।কতদিন আর আপুর এই একার জীবন চলবে? যদিও নোমান সাহেব আসতে চাইছেন।কিন্তু তা বেশ দেরি হয়ে গেলো। নব বিবাহিতদের মাঝে দেড় বছরের দূরত্ব সেতো অনেক। দুজনার মাঝে বয়স আর ভাষার ব্যবধান তাদের একেবারেই কাছে টানেনি।তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা দেয়া ঠিক হয়নি।কিন্তু কী আর করা তখন? এক বোনের ভালোর জন্য আরেক বোনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
রুহি খালাকেও উপেক্ষা করা যায়নি।আমাদের পরিবারে তার একটা বিরাট অবদান। এখন এই সিচুয়েশনে   তাকেও ম্যানেজ করতে হবে।আবার নোমান সাহেব নিজের স্ত্রীকে কাছে নেয়ার অধিকারের কাছে তো আর শিহাব ভাইয়ার আবেগ দাঁড়াতে পারবে না। যেখানে কাগজে কলমে আইনে সে শায়লার স্বামী। কিন্তু এদিকে শায়লাও পুরোপুরি শিহাবের দিকে মন নিয়ে গেছে। দুজনাকে মানায়ও বেশ!
তবে এখানে শায়লার চেয়ে নোমান সাহেবের দোষটাই বেশী। তার উচিত ছিল আপুর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা আর তাকে কাছে নেয়ার প্রসেসটা দ্রুত করা।চাইলে জীবনের একটা দীর্ঘ সময় একা থাকা যায় কিন্তু কারো সাথে জীবন বাঁধলে তখন দূরত্বটা চরম এক হতাশা আর অস্থিরতায় ভরে উঠে। মনের সাথে শরীরেরও এক তীব্র চাওয়া হিংস্র হয়ে উঠে।স্বামীদের দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন দেশে থাকা স্ত্রীরা জানে জীবনের  কতটা  সুন্দর সময় একাকীত্বে কাটছে।তখন অন্য কোন হাতছানি এলে নিষিদ্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে যায়।মানুষের দেহ আর মনের চাওয়া যে সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এটা আমাদের সমাজের মুরুব্বিরা বুঝতে চায় না।
রাহাত ভাবলো,কাল একটু সময় করে শিহাব ভাইয়ার সাথে কথা বলতে হবে।রাহাত টিভিতে  খেলার চ্যানেল বদলে অন্য চ্যানেলে থামতে হলো।সংবাদ চলছে।সংবাদ পাঠিকাকে রাহাতের খুব ভাল লাগলো।চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে।রাহাত ভাবলো,বাঙালি মেয়েদের শাড়িতে অনন্য অপূর্ব রূপসী লাগে! 
রাতের খাবারের সময় হয়ে এলে রাহাত শায়লাকে ডেকে তুললো।এমন অসময়ে কিভাবে ঘুমিয়ে গেলাম? এইভেবে শায়লা দ্রুতই বিছানা ছাড়লো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে নীরবে নিঃশব্দে ভাইবোন খেয়ে নিলো। শায়লার ভাবনায় কপালের ভাঁজ রাহাতের দৃষ্টি এড়ায়নি। রাহাত নিজেও কোনপথে কিভাবে এগুবে তা নিয়েও ভাবনায় ডুবে থাকে।সুনশান নীরবতায় বাড়িটাকে যেন মৃত্যুপুরী মনে হচ্ছে।মা থাকলে তবুও কিছু কথা চলে।
রাহাত খাবার শেষ করে শায়লাকে সব গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করলো। রাহাত বুঝেছে আপুর জন্য এখন নিত্যদিনের কাজকরায় দিনদিন অনাগ্রহই আসবে।
আপু রাত জেগোনা,ঘুমিয়ে যেও।
বলে রাহাত নিজের ঘরে চলে গেলো।শায়লা নিজের ঘরে ঢুকলো।শিহাবের কথা মনে পড়ছে।সেকি রাতের খাবার খেয়েছে? নাকি নাখেয়েই ঘুমিয়ে গেলো? একটা কল দিয়ে জানাতো  যায়!ভাবতেই মোবাইল স্ক্রিন আলোকিত হয়ে উঠলো। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো, নোমান সাহেবের কল!  শায়লা বুঝতে পারছে না এখন কি করবে? এখনতো কোন অজুহাতে কল না ধরে থাকা যাবে না।
শায়লা হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়ে কল রিসিভ করলো।হ্যালো বলতেই,পৃথিবীর ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো,হাই,শাআলা,,দিস ইজ নোমান ফ্রম কানাডা।হাউ আর ইউ? গুড ইভনিং,, 
কে যেন শায়লার কন্ঠ রোধ করে রাখলো।অপ্রান্ত থেকে বারবার একই প্রশ্নের শায়লার  অস্ফুট স্বরে একটা কথাই বেরিয়ে এলো,আই এম ফাইন,,থ্যাংকিউ।নোমান সাহেবের আজ যেন কথার খই ফুটেছে! একটানা কথা বলেই চলেছে।শায়লার অনিচ্ছতে কানে মোবাইলটা আটকে আছে যেন!

শিহাব রাতের বেশ অনেকটা সময় বারান্দায় বসেই কাটিয়ে দিলো।আজ আর ঘরের দিকে মন টানছে না।মন চাইছে সারারাত এই বারান্দায় বসে কাটিয়ে দিতে।শায়লার অনুভব নিয়ে চোখে এক ঘোর লাগা  রঙিন 
স্বপ্নভেলায় ভাসছে সে।তার মন খুব করে শায়লার উপস্থিতি চাইছে।মনে হচ্ছে এখুনি কল করে শায়লাকে চলে আসতে বলি। আজ সারাটাদিন শায়লার চোখের প্রতিটি চাহনী তার বুকে যেন তীর হয়ে বিঁধছে।সুখানুভুতির তীব্রতায় আনমনে ভাবনায় কখন এভাবে সময় হয়ে গেলো, একেবারে টেরই পেলো না শিহাব।  একটি একটি করে পুরো এক প্যাকেট বেনসন শেষ হয়েছে।নিশ্চয়ই শায়লা থাকলে শত বারনে থামিয়ে দিত এই ধোয়া টেনে যাওয়ায়।নিশ্চয়ই বলতো সন্ধ্যে হয়েছে ঘরে আসো,এমন ভর সন্ধ্যায় বাইরে থাকতে হয়না।এমনি করে মিষ্টি  শাসনে কতদিন হল কেউ বারন করে না। শিহাববের ভাবনায় বারবার লিফটে সেই শায়লার স্পর্শ  শায়লার নিজেকে  একেবারে সঁপে দেয়া ক্ষণ গুলো যেন শিহাবকে বিদুৎ চমকে আবেশিত করছে।শিহাব ক্রমশ অধীর হয়ে উঠছে।শায়লাকে একান্তে পাওয়ার আবেগে একাকীত্বটা অসহনীয় হয়ে উঠছে। কেবলি বলতে ইচ্ছে করছে, শায়লা তুমি এক্ষুণি চলে আসো,এসে দেখো আমি কেমন একা  একা বসে শুধু তোমাকেই ভেবে চলেছি।হাতের কাছে মোবাইলটা। তবুও ইচ্ছে করছে না কল করতে, ইচ্ছে করছে না কথা বলতে, অনুভবের এই উন্মাদনায় শিহাব পুরোপুরি ডুবে আছে।চাইছে না কথার অনুরননে তার ছেদ ঘটাক। মাঝে মাঝে নিঝুম নিশ্চুপ নিরালা পরিবেশ হাজার কথার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠে। আজ আকাশে প্রচুর তারার মেলা।শিহাব বারান্দায়  আলো নিভিয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে বসা।ধীরে ধীরে সে সন্ধ্যার আকাশ থেকে রাতের এই ঘন কালো আঁধারের আকাশ দেখছে। তারার ঝিকিমিকিতে শিহাবের মন আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। নিজেকে আজ একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষ ভাবছে। দুঃখ যতই আঘাত হানুক একটু সুখ ছোঁয়ার তার চেয়ে অনেক ক্ষমতা। শায়লাকে খুঁজে পাওয়া তার  আপন হওয়া এমনি করে তার জীবনের সাথে শায়লার মিশে যাওয়া শিহাবের  পিছনের সব দুঃখকে ভুলিয়ে দিয়েছে। শিহাবের যেন আর দেরী সইছে না, শায়লাকে কবে নিজের ঘরে তুলে আনবে।সব কিছুর দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সে শুধুই শায়লাকে দেখে সময় কাটাবে। কত কত দিন যে এই নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছে। দিন শেষে শূন্য হৃদয়ে,ফাঁকা এই ঘরটার লক খুলে ঢুকেছে। অসহনীয় সেই ক্ষণগুলো।আর ভাল লাগছে না কিছুই।কবে শায়লার সান্নিধ্য পাবে, কাটবে মধুময় সময়।শিহাব বুঝতে পারছে কেমন করে শায়লা তাকে এতটা বিভোর করে রাখে।
ইচ্ছে করছে এখুনি বাইকটা নিয়ে পিছনে শায়লাকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়ি অজানার উদ্দেশ্য।  ছুটে চলি মাঠ ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে দূর থেকে দূরে। 
বেশ অনেক রাত হলো।শিহাব মোবাইল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। রাত সাড়ে বারোটা!  কিভাবে এতটা সময় পেরিয়ে গেলো।শায়লার সাথে কথা বলার জন্য মনটা বেচায়েন হয়ে উঠলো!  তার ফোন কলের অপেক্ষায় নিশ্চয়িই অভিমানী মুখ নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। শিহাব বিছানায় আধশোয়া হয়ে শায়লাকে মেসেঞ্জারে কল দিতেই ফোন স্ক্রিনে দেখা গেল, সি ইজ বিজি উইথ এনাদার কল! 
শিহাব বুঝতে পারলো না, এত রাতে শায়লা কোন কল নিয়ে বিজি হলো? তবে কি কানাডার কল এটেন্ড করছে সে? 
শিহাবের ভেতরটা ওলোট পালোট হয়ে গেলো।


চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much