উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৯৬
অস্তিত্বের লড়াই
মমতা রায় চৌধুরী
বিদ্যালয়ে রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী উৎসব মোটামুটি ভালোভাবেই পালিত হয়েছে ।যদিও সেই দিনটা ছিল ঝড়ো মেঘলা দিন। ঝোড়োমেঘলা দিনের গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য গুরুদেবের গান দিয়েই "আজ ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে"স্নিগ্ধা"অপূর্ব গাইল। রাজশ্রী কবিতা আবৃত্তি করল "আফ্রিকা'। 'অনবদ্য কবিতা আবৃত্তি।
সোহিনী তার শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে রবি ঠাকুরের অনবদ্য রচনা "গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে…।' নৃত্যের মধ্যে দিয়ে । আরো যারা ছিল মিত্রা ,দেবাংশী প্রত্যেকে খুব সুন্দর পারফর্ম করেছে।
সবার শেষে বিদ্যালয়ের সিনিয়ার দিদি ঘোষণা করলেন আমার নাম। তিনি বললেন একজন লেখিকা আর তার নিজের স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি না শুনলে আজকের দিনটার আনন্দঘন শ্রদ্ধার্ঘ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।তাই শুনবো না এটা কখনো হতেই পারে না ।সত্যিই দিনটা এমন ছিল মনের ভেতরে গুনগুনাচ্ছিল রবি ঠাকুরের প্রতি আমার প্রাণপ্রিয় গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব। তাই রেখা আর কালবিলম্ব না করে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাল "অপেক্ষার বৃষ্টি হয়ে ফিরে এসো রবি ঠাকুর। "অনবদ্য কবিতা আর তার পাঠিয়ে সকলেই মোহিত হয়ে গেল
সারাটা দিন বেশ সুন্দর একটা শেষ ভাবের মধ্যে দিয়ে যেন উদযাপিত হল মনটাও একটা আলাদা তৃপ্তি অনুভব করল। বড়দি ভীষণ খুশি হলেন যে হঠাৎ করেই প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করে এত সুন্দর শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন হবে কল্পনার অতীত ছিল। বড়দি প্রোগ্রাম নিয়ে খুব প্রশংসা করলেন।
আজ অনিন্দিতা এসেছিল স্কুলে। ওর শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। রিপোর্ট পেয়েছে হাতে ক্যান্সার ফাস্ট স্টেজ।ওর চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কি একটা দুশ্চিন্তা সবসময় ওকে ঘিরে আছে ।রেখা ওকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে নি ।প্রোগ্রাম শেষে যখন বড়দির সঙ্গে কথা বলছিল, তখন অনিন্দিতা এসে বলল "রেখাদি তুমি ভালো আছো?"
রেখা হেসে বললো"হ্যাঁ, ভালো আছি ।তুই কেমন আছিস?"
রেখার কথা শুনে অনিন্দিতার চোখে জল আসে আর বলে -" আর আমার ভালো থাকা, ভালো থাকার চেষ্টা মাত্র ।শুধু একটাই চিন্তা জানো তো আমার ছেলেটার জন্য।"
বড়দি আর রেখা বলল" এতো ভাবছো কেন সব ঠিক হয়ে যাবে ।তুমি তো ট্রিটমেন্ট
করাচ্ছো ।ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রাখ।"
"এই রোগের আর ঠিক হওয়া দিদি"বিষন্ন সুরে বলল অনিন্দিতা।
বড়দি আর রেখা কি বলবে জানে তো এই রোগ সম্পর্কে এজন্য কিছুটা চুপ থেকে বলল "এই রোগের ট্রিটমেন্ট করাচ্ছো টিটমেন্ট অনুযায়ী তোমাকে ভালো থাকতে হবে।"
অনিন্দিতা একটু ম্লান হেসে বলল
"কি যে পাপ করেছি সেজন্য তার শাস্তি ভোগ করছি,।"
রেখা বললো "এভাবে কেন বলছো? শরীর থাকলে তো অসুখ হতেই পারে ।এতে পাপ-পুণ্যের কথা কেন আসবে ,তুমি মনটাকে ভালো রাখার চেষ্টা করো। সবসময় এরকম নৈরাশ্যজনক কথা ব'লো না। পজিটিভ ভাবো।"
*ভাবি কিন্তু পেরে উঠি না গো রেখাদি।'
রেখা বলল"তুমি আজকে শরীর খারাপ নিয়ে স্কুলে আসলে কেন? এখন তো সামার ভ্যাকেশন চলছে ।আজকে তো কারো বাধ্যতামূলক ছিল
না । বড়দি সেভাবে কাউকে আসতে বলেন নি।'
"না গো ,বাড়িতে থেকেও তো বোরিং হচ্ছিলাম এইতো কদিন আগেই ফিরেছি চেকআপ
করিয়ে ।ভাবলাম, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী তো হবেই আর তুমি যেখানে আছো সেখানে তো হবেই ।তাই চলে আসলাম।"
"খুব ভালো করেছ "
বড়দি রেখার দিকে তাকিয়ে বললেন 'যে কয়জন মেয়ে এসেছে অভিভাবক এসেছেন, তাদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করেছ টিফিনের?
"ওই পঞ্চমীদিকে বলাই ছিল কাউন্ট করে নিয়ে কয়েকটা কেক আনিয়ে দিতে।"
বড়দি বললেন* অনিন্দিতা, রেখার উপর কেন আমি ভরসা করি এবার বুঝতে পারছ?ওকে যেকোনো কাজ দিলে ও কতটা দায়িত্বের সঙ্গে করে। আমাকে কোন টেনশন করতে হয় না "
রেখা বুঝতে পারল বড়দি অনিন্দিতাকে একটু খোঁচা দিয়ে কথা বললেন "কারণ এর আগে অনিন্দিতা খুব সমালোচনা করেছে রেখাকেনিয়ে।"
"দিদি ,আপনারা অভিজ্ঞ ব্যক্তি আপনাদের চোখকে কখনো ফাঁকি দেয়া যায়?আপনি যোগ্য লোককে দায়িত্ব দিয়েছেন।"
রেখা অনিন্দিতার কথা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়লো মহৎ বানী'কেউ আঘাত করলে প্রতিশোধ নেবার দরকার নেই। ধৈর্য ধরলে আঘাত নিজেই তার কর্মের জন্য পাবে।
সেদিন যে অকারনে রেখাকে আঘাত করেছিল কন্টিনিউয়াসলি, আজকে ভাগ্য কোথায় নিয়ে গেলো অনিন্দিতাকে ।সেই রকম মেজাজি অহংকারী মনোবৃত্তি কোথায় চলে গেছে।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার ভিতর যেন একটা আর্তনাদ রয়ে গেছে বুকের ভেতরে যে এতদিন শুধু প্রত্যেককে অপমান আঘাত করার আগুন জ্বলছিল, সেটা এখন নিভে যেতে বসেছে আপনা থেকেই। হয়তো এটা তার অনুশোচনা অনুতপ্তবোধ তাকে বিবেকবোধের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।
কাউকে কখনো ছোট করে দেখা উচিত নয়।
বড়দি বললেন" রেখা আমার সঙ্গে দুজন ভদ্রলোক কথা বলতে আসছেন ,তোমরা বরং স্টাফ রুমে গিয়ে বাকি কথাটুকু সেরে নাও কেমন?"
রেখা বলল" হ্যাঁ বড়দি ,ঠিক আছে।"
স্টাফ রুমে যেতে যেতে রেখা অনিন্দিতাকে বলল "তোর বর সুরেন ঠিক আছে তো?
তোকেনিয়ে খুব ভাবছে না?"
রেখা বলল "সে তো একটু ব্যস্ত আছে, ভাবনা তো রয়েছে বাচ্চাটা ছোট।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার কথার মধ্যে যেন একটা ঔদাসীন্য আর অবহেলায় ভরা সুর।
সেই অস্তিত্বটাকেই বুঝাতে চাইছিল ।যদিও ভাষাতে তার অভিব্যক্তি নেই কিন্তু চোখে-মুখে
বিষন্নতার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে।
রেখা বলল "অনিন্দিতা বাড়ি যাবে না?"
"তোমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে।"
"না ,এখনো মিনিট দশেক বসতে পারব।"
আমি বাড়ি গেলে তো হাজারো চিন্তা মাথায় আসে এখন শুধু মনে হয় কত তাড়াতাড়ি স্কুল টা খুলবে আমি কাজের মধ্যে নিজেকে এখন জড়িয়ে রাখতে চাই।"
"কিন্তু তোমার বাড়িতেও তো একটা বাচ্চা আছে ওকে নিয়েই তো তোমার সময় কেটে যাবে।"
জানি রেখাদি ,কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকালে না শুধু মনে হয় কেন আমি ওকে পৃথিবীতে আনলাম আমি যদি ওকে সঠিকভাবে লালন পালন করে ওকে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে না পারি তাহলে আমার মা হবার কোন অধিকারই নেই।"
"এভাবে বোলো না অনিন্দিতা।"
অনিন্দিতা অঝোরে কাঁদছে আর বলছে" আমি কতদিন এই পৃথিবীতে আছি রেখাদি আমি জানি না ।যেহেতু ফাস্ট স্টেজে ধরা পড়েছে ,হয়তো থাকবে কিছুদিনের জন্য কিন্তু কতদিন?"
একটা হতাশাগ্রস্থ বেদনা ,যন্ত্রণা অনিন্দিতাকে কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে ভেতরে ভেতরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে একটা ভয়। সর্বদা যেন কুকুর তাড়া করছে।
রেখা অনিন্দিতার মাথায় হাত রেখে বলল "যে কটা দিন থাকো তুমি হেসে খেলে পজেটিভ ভাবনা নিয়ে থাকো ।সেই কটা দিনই তুমি তোমার সন্তানের জন্য মূল্যবান সময় অতিক্রম করো।
" রেখা দি তুমি সন্তানের মা হতে পারোনি তুমি অনেক লাকি।"
কথাটা শুনে রেখার চোখ ছল ছল করে উঠলো আর বললো "বলছো আমি লাকি ।আমি জানি আমি কতটা লাকি। আসলে আমাদের জীবনটা এরকম জানো তো যে যা পায় ,সেটা নিয়ে খুশি হতে পারে না ।আমরা যদি প্রত্যেকেই সেটুকু অংশ নিয়ে খুশি থাকতে পারতাম, তাহলে মনেহয় সব থেকে বেশি সুখী হতে পারতাম।"
"রেখাদি আমি অনেক ভুল করেছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।"
অনিন্দিতা হাতজোড় করে রেখার কাছে ক্ষমা চাইছে ।রেখা উপলব্ধি করলো আজ অনিন্দিতা ক্ষমা সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখছে।
অনিন্দিতা অনর্গল বলে যাচ্ছে " জানো আমি তোমাকে খুব ঈর্ষা করতাম আর ভেতরে ভেতরে খুব জ্বলতাম।"
রেখা খেয়াল করল অনিন্দিতার স্বপ্নময় দুটি চোখ যেন এখন ক্লান্ত শুধু খুঁজে বেড়ায় তার অস্তিত্ব টিকে থাকার লড়াই, একটা সচকিত আতঙ্ক যেন ক্রমশ অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে টেনে।
রেখা বলল "শান্ত হও অনিন্দিতা, শান্ত হও।"
অনন্দিতা চঞ্চল ,অস্থির ,উদ্দাম হয়ে বলতে লাগলো আমাকে বলতে দাও রেখা দি।
আমি এই কথাগুলো বলে যেতে না পারলে আমি যে আমার জীবন শেষে শান্তি পাব না।"
কন্টিনিউয়াসলি অনিন্দিতা কেঁদে চলেছে ।রেখা দেখল কাঁদারপ্রয়োজন রয়েছে ।
শুধু এইটুকু বলল "আমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে অনিন্দিতা। আমাকে এবার উঠতে হবে তুমিও বাড়ি যাও মাঝে মাঝে ফোন ক"রো আমিও তোমাকে ফোন করবো ।ওকে সান্ত্বনা দিয়ে রেখা বেরিয়ে পড়ল টোটো ধরবে বলে । টোটোতে উঠে বসে বসে রেখা ভাবছে অনিন্দিতা কাঁদুক। ওর অসাড় দেহ অন্ধের মত হাতরে হাতরে খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধু অস্তিত্ব টিকে থাকার
লড়াই ।অন্ধকারে মনে হচ্ছে যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না ।চারিদিক শুধু অনন্ত অন্ধকার ।অঙ্গার এর আগুন যেমন পুড়ে পুড়ে নিজে শেষ হয়ে যায় তেমনি যেন মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নগুলো আর বাস্তবায়িত হবে না।চারিদিক চোখ বন্ধ করে দিচ্ছে।
রেখা আজ রবি ঠাকুরের জন্মদিনে তাই বারবার মনে করছে "হে গুরুদেব , হে ঠাকুর,সকলের ভেতরে তুমিই উদ্যম ,প্রাণশক্তি জোগাতে পারো তুমিই আমাদের বেঁচে থাকার রসদ ।মনেপ্রাণে সেই শক্তি দাও। সেই শক্তি ওকেও দান করো "
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much