উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৯২
ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো
মমতা রায় চৌধুরী
আজ প্রায় সারাটা দিন চলে গেল এই মেয়েদের প্রোগ্রামের লিস্ট করতে, মেয়েদের ফোন কল ওদিকে রাজ্যের কাজ পড়ে রয়েছে। মাসি আসলো না। রেখা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বুকে চিনচিন করে উঠলো।
মাসি এলো না । মাসি তো না বোলে কামাই করে না। আগে সমিতা যা মিথ্যে কথা বলতো । সব সময় যেন মা সরস্বতীরকে মিথ্যে কথার ঝুলি তে বন্দি করে রেখেছিল। এই মাসি সে রকম তো নয়। বয়স হয়েছে।মাসির ভিতর ফাঁকিবাজি কাজ করে না।তবুও ছেলেটা অসুস্থ আছে,নাতি নাতনী দের কথা মাথায় রেখে কাজে নেমেছে। আহা রে এদের আবার অন্ধের কিবা রাতি কিবা দিন অবস্থার মত।
"না।আর ভাবলে হবে না। যাই জামা কাপড়গুলো শুকোয় নি ।এই বৃষ্টি আবার এই রোদ, ছাদে দিয়ে আসি। এখন তো এক চিলতে রোদ্দুর দেখা মিলেছে ।"
এই ভেবেই রেখা ছাদে গিয়ে উঠল জামা কাপড় নিয়ে ।ছাদের থেকে চোখ পড়ে গেল আবার সেই চৈতিদের বাড়ির দিকে ।
"আহা রে ছাদখানা কেমন খাঁ খাঁ
করছে ।বাড়িটাও ঠিক তাই ।লোকজন না থাকলে যা হয় ।"
"ছাদ থেকেনেমে গিয়ে একবার চৈতির মাকে ফোন করতে হবে। কি করছে কে জানে?'
রেখা এসব ভাবতে ভাবতে জামা কাপড়গুলো ছাদে মিলিয়ে দিল ,ক্লিপ লাগিয়ে দিলো। এবার ছাদে কিছু ফুলগাছ করেছে ।দেখে নিল ফুল গাছ গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা ।এখন যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে, জল দেবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। গতবার নীলকন্ঠ ফুল যা হয়েছিল বাবা, দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায় ।কতজন যে কত নজর দিয়েছে তার ঠিক নেই।
রেখা ভাবছে "না ,আর একটা কাজ বাকি আছে কদিন ধরে লিখে উঠতে পারছে না, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী জন্য। একটা গল্প বা কবিতা দিতে হবে দুটো পত্রিকা থেকে আর্জি জানিয়েছেন সম্পাদক। এইজন্য তাড়াতাড়ি জামা কাপড়গুলো মিলিয়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে রেখা নেমে আসলো।l
ঘরের কিছু টুকরো-টাকরা কাজ করার পর দেখল মেঘ করেছে রেখা আবার ছাদে কেন জামা কাপড় গুলো নামিয়ে আনলো। শুকিয়েছে সেগুলো কে আলাদা জায়গায় রেখে বাকিগুলো কে একটু মিলিয়ে দিল। তারপর রেখা ড্রইং রুমের জানলা খুলে দিয়েছে হালকা করে একটু বৃষ্টির ছাঁট ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া তার চোখে মুখে এসে লাগল । মনের ভিতর কেমন একটা উদাসী হাওয়া বুকের ভেতর হু হু করে বয়ে যেতে লাগলো। একটি সুন্দর প্রাকৃতিক মুহূর্তেই কত রকমের প্রশ্ন ভিড় করছে তার মনের ভেতর।
রেখা ঠিক করে নিয়েছে এখনি একটা রবি ঠাকুরের কবিতা লিখে ফেলবে যেমনি ভাবা অমনি কাজ । সত্যি সত্যি তার কল্পনা প্রবণ মন বাস্তবের মাটিতে
স্পর্শ করে। লিখে ফেলল একটি কবিতা। কবিতা লিখতে লিখতে দু-এক ফোঁটা করে বৃষ্টির ছাঁট রেখার চোখে মুখে এসে লাগলো।
এ যেন মনে পড়ে সেই গান 'আজ ঝর ঝর মুখর বাদল ও দিনে….।"
রবি ঠাকুরের বর্ষাকে নিয়ে যে কত কবিতা গান আছে,তার ঠিক নেই ।আজ বর্ষাকাল না হলেওবৃষ্টিকে নিয়েই ইচ্ছে করছে কবিতা লিখতে। কবিতা লিখে তার নামকরণ করল "অপেক্ষার বৃষ্টি হয়ে এসো রবীন্দ্রনাথ"।
কবিতাটি লিখে নিজেই পাঠ করতে শুরু করল ।এদিকে বৃষ্টির জোর আরো বেড়ে গেল। রেখা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে জলকে স্পর্শ করল। রেখার দোপাট্টা হয়ে গেল আলুথালু, চুলগুলো কিছুটা ভিজছে শরীর-মন বৃষ্টির পরশে মেতে উঠেছে। তখন মনে হচ্ছে সেই গুরুদেবের কবিতার লাইন না' আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর ।…..
না জানি কেন রে এতদিন পর জাগিয়া উঠেছে প্রাণ ,ওরে উথলি উঠেছে ,.. প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি.।"
রেখা বেশ কিছু টা ভিজে গেল এদিকে জানলা দিয়ে জলের ঝাপটায় সেই ঘরেও কিছুটা জল প্রবেশ করল ।সেদিকে কোন খেয়ালই নেই । হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে..।আজকে মনে হচ্ছে রেখা পেখম তুলে ময়ূরের মতো নাচতে ।'
কিছুটা ঝোড়ো হাওয়ায় গাছগুলো সব ওলট-পালট শুরু হয়েছে ।চৈতিদের বাড়ির নারকেল গাছ ,সুপারি গাছগুলো দুলছে আবার ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এই পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই মন প্রাণ আর বসে থাকতে চায়না। রেখার মনে হলো যে সে 40 পেরোচ্ছে কিন্তু তার মনের বয়স যেন পেরোয়নি সে যেন 18 বছরের তরুণী।
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। রিং হচ্ছে।কেটে গিয়ে আবার আবার ফোন বাজছে, সেদিকে রেখার কোনো হুঁশ ই নেই।
হঠাৎই আবার চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে থমকে যায় তার উড়াল পাখি। কি একটা প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছিল রেখা নিজের ভেতরে, হঠাৎ একটা যন্ত্রনা কুরে কুরে খাচ্ছে।মাঝে মাঝে হচ্ছে এই যন্ত্রণাটা। জানলাটার থেকে সরে এসে এবার বসল রেখা ।তখন আবার ফোনটা বেজে উঠলো। রেখা কোনক্রমে ফোনটা ধরল বলল 'হ্যালো।'
"হ্যাঁ আমি সুরঞ্জন বলছি মনোজ আছে?"
"কে সুরো দা ,বলছেন ?'
'হ্যাঁ ,রেখা আমি সুরোদা বলছি।
তোমার গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?'
রেখা পুরো অস্বীকার করল" কই না তো এমনিই মনে হচ্ছে? ও তো অফিসে গেছে দাদা।"
"দেখো আমার মাথাটা গেছে আমি একদমই ভুলে গেছি। ঠিক আছে ও আসলে বলবে আমি ফোন করেছিলাম।"
"ঠিক আছে দাদা বলব।
বাড়ির সবাই ভালো আছে তো দাদা?''
ততক্ষণে সুরো ফোন কেটে দিয়েছে।
রেখা মনে মনে ভাবল আজকে সুরোদাকেএকটু অন্য রকম লাগলো ,বেশ চিন্তিত মনে হল।কিছু কি হয়েছে?
এদিকে আমার যন্ত্রণা টাও কেমন যেন আরও বাড়ছে । কিসের থেকে
হচ্ছে ? না একটা গ্যাসের ওষুধ খেয়ে নিই।'রেখা ভাবল "রিপোর্টগুলো নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে ।ডাক্তারবাবু তো আসবেন নাম ক 'সপ্তাহ বলেছেন।"
যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে দেখে তুতু এসে পায়ের কাছে বসল ,মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ।তারপর কেমন একটা অস্থিরতা ওর ভেতরে লক্ষ্য করা গেল ।রেখা নিজের যন্ত্রণার কথা ভুলে যাচ্ছে তুতুকে দেখে ।একটা অবলা জীব তার কত অনুভূতি ।আমার কষ্ট দেখে ওর ভেতরেও কেমন কষ্ট হচ্ছে সত্যিই যারা এদেরকে ভালোবাসে তারাই একমাত্র বুঝতে পারবে ওদের অনুভূতিগুলো ,ওদেরও ভাষা
আছে ,ওদেরও সমানুভূতি আছে ।শুধু একটু বোঝার অপেক্ষা ।ওদেরকে একটু বুঝে ভালোবেসে কাছে ডাকলে সমস্ত কিছু অনুভব করা যায় ।মানুষের থেকে অনেক বোঝে এরা ,শুধু মানুষের ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না।এবার কিউ কিউ আওয়াজ করছে। একবার ছুটে ছুটে দরজার কাছে যাচ্ছে ,একবার রেখার কাছে আসছে । রেখা ভাবলো না যন্ত্রণাতে এইভাবে কাতরানো যাবে
না ।নিজের কষ্ট হলেও ওকে বুঝতে দিলে হবে না । রেখা এবার হাসিমুখে তুতুকে ডাকছে।' কি হয়েছে মা তোমার ?তুমি এমন করছ কেন ?তুটু এসে রেখার গাল চাটতে শুরু করলো এবং দুই হাত দিয়ে রেখার কোলে মাথা রাখলো ।কি অসাধারন অনুভুতি ।ট্রেনিং দেয়া হয়নি
অথচ এমন সব কাণ্ড করে যেন মনে হবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত এরপর কেমন একটু শান্ত হলো এবার ওকে দেখে রেখার ও যন্ত্রণা যেন মনে হল একটু উপশম হল ।রেখা একটু ওই অবস্থাতেই সোফাতে শুয়ে পড়ল । তুতু ওর বুকের ওপর।
বেশ কিছুক্ষণ চোখটা লেগে এসেছিল যখন ঘুম ভাঙলো দেখলো বেশ বেলা হয়ে গেছে ।খাবার খাওয়া হয়নি বাচ্চাগুলোকে।খেতে দিতে
হবে ।তুতুকে এবার।আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়ে রেখা ভালো করে হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে গেল রান্নাঘরে ওদেরকে খাবার খাওয়াবে বলে খাবার রেডি
করতে ।বাইরে পাইলট বসে
আছে ।আজকে কোন সাড়াশব্দ
নেই ।শুধু বসে আছে ।দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন একটা কৌতুহল ওদের ভেতরে । রেখা খাবার দিল আর গায়ে হাত বুলাতে লাগল। খাওয়ার শেষে দরজা বন্ধ করতে যাবে ঠিক তখনই পার্থ এসে বলল
"বৌদি ।"
রেখা পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলল "একি তুমি এই সময়?,"
'দাদা তো অফিসে গেছে না?'
'', হ্যাঁ"
"দাদা ফিরলে অবশ্যই আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবে বা ফোন করতে ব"লো।"
"কেন কী হয়েছে গো? এত জরুরি তলব।"
"আরে চৈতির বাবার অবস্থাটা ভালো নয় বৌদি ফোন করেছিল।"
"আমরা কি করব বল তো পার্থ? সত্যি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু কি করার আছে। ওদের কেই ডিসিশন তো ওদের নিতে হবে ।কী করবে, না করবে ?মেয়ে জামাই আছে।"
"চিন্তার ব্যাপার। বৌদি একটা টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৌদিকে দেখবে চেহারাটা এই কদিনের মধ্যে কি হয়েছে?"
এ তো স্বাভাবিক। সমস্ত চিন্তাভাবনা এখন বৌদির কাঁধে।এত বড় একটা সংসার রয়েছে। সংসার টা চলবে কি করে? সে একটা বড় চিন্তা । মেয়েটার বাচ্চা হবে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতেও তো সেরকম শুনেছি ভালো নয়। মাঝে তো খুব অশান্তি হয়েছিল। হাজারো চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।"
"হ্যাঁ এবার আমরা কি করব সেটাও ভাবছি।"
"দাদার গসারি দোকানটাই এখন বৌদিকে কোনরকম চালাতে হবে আর কি করা যাবে ।।সেরকম হলে আমরা পাড়া-প্রতিবেশীরা একটু সাহায্য
করবো। এই ছাড়া তো আর কিছু করার উপায় নেই।"
"বউদি বলছিল পুঁজিগুলো সব ভেঙ্গে দাদার চিকিৎসা হচ্ছে।
এদিকে আরো বলছিল যে কিছু ধার করে ফেলেছে।"
আমাকে চাবিটা দিয়েছে জানো তো বৌদি বলেছে ঘরদোরগুলো একটু দেখতে গিয়ে।"
"যাবে একটু দেখে আসবে।
সবাই মিলে সহযোগিতা না করলে তো হবে না পার্থ।'
ফোন করবো ভেবেছি তার মধ্যে আমার পেটে এত ব্যথা শুরু হলো না ,দিয়ে আমি মানে ওই গ্যাসের ওষুধ খেলাম তারপর একটু শুয়েছিলাম শুয়ে ওদের খেতে দিতেও দেখছো না দেরি হয়ে গেছে এবার নীচে গিয়ে একটু ফোন করবো বৌদিকে।'
'হ্যাঁ ,তুমি একবার ফোন ক'রো মনে একটু জোর পাবে।"
"পার্থ বিপদের মধ্যে ,দুঃখের মধ্যে আমরা যদি একটু সাহায্য করতে পারি, তার পাশে থাকতে পারি থেকে আর বড় কিছু নেই ।বিপদেই তো মানুষকে চেনা যায়।"
'"একদমই ঠিক বৌদি।"
আশেপাশে তো আরও লোকজন আছে কেউ খোঁজ খবর নিচ্ছে!"
"ওদিকে তাকিয়ে লাভ নেই পার্থ পৃথিবীতে সব মানুষ সমান হয় না ।কাজ করছ তোমার কর্ম তুমি করে যাও ফল তুমি নিশ্চয়ই পাবে। আমরা করি না কেউ হলো না তো কি হয়েছে সবার দলে আমাদের ফেললে হবে না বুঝেছ?"
"বুঝলাম ঠিক আছে বৌদি ।আসছি ,মা ওদিকে চিন্তা করবে।"
"ঘরের কাজ আছে, মাসি আসছে না। এইভেদরজা বন্ধ করবে তখনই তুতু আগে আগে ঘরে ঢুকলো।
রেখা বাসন টা রেখে ভাল করে হাত ধুয়ে নিজের খাবারটা নিয়ে বসলো।
ফোন বাজছে রেখা ফোনটা এসে দেখলো যে বেশ কয়েকবার ফোন বেজেছে । নম্বর টা চেক করে দেখলো না এটা বড়দি ফোন করেছেন।
রেখা রিং ব্যাক করল।
ওদিক থেকে ফোনটা রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে রেখা বলল " বড়দি বলুন।"
রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর সমস্ত অ্যারেঞ্জ করে ফেলেছ রেখা ,না পারো নি ।আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছে।"
" হ্যাঁ দিদি ,কোন টেনশান নেবেন না আমার অ্যারেঞ্জ করা হয়ে গেছে। শুধু পঞ্চমীদিকে বলে রাখা একটু আগের দিন আমি সেটা করবো রাত্রে বেলায় ফোন করবো টেবিল ক্লথ ঠাকুরের ছবি মালা ধুপ এগুলো যেন সব রেডি করে রাখে।
ঠিক আছে টেনশন মুক্ত করলে ,।আমি কেন যে টেনশন করি ?জানি না। জানি তোমার ওপর দায়িত্ব দিলে হবে ।তা হলেও এখন ফোনে পেলে কিনা সে জন্যেই ।ঠিক আছে আমি পঞ্চমীকে বলে দেবো তোমাকে ফোন করতে হবে
না ।আর কি প্রোগ্রাম টা কখন করছো?স্কুল আওয়ার্স তো?"
" হ্যাঁ দিদি"।
"'বেস্ট অফ লাক।'
ভালো থেকো তুমি।'-বলেই বড়দি
ফোনটা কেটে দিলেন।
রেখা গান ধরল "মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো..।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much