ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৫)
শামীমা আহমেদ
শিহাব মোবাইলে কথা বলা শেষ করে উৎকণ্ঠিত রাহাতের দিকে তাকালো। শিহাবের চোখে মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে । তার সামনে রাহাতের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি! শিহাব যেন কিছু বলবার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এমনিতেই শিহাবের ভেতরে শায়লাকে পাওয়া না পাওয়ার দ্বিধান্বিত ভাবনা আবার এর সাথে যোগ হলো শিহাবের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ। ফোন কলটি যেন শিহাবের জন্য বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে এলো।
রাহাত শিহাবকে ভাবনার জগৎ থেকে বের করে আনতে প্রশ্ন করলো,
কী হয়েছে শিহাব ভাইয়া ? কোন খারাপ খবর ? আপনার বাসার সবাই ভালোতো ?
শিহাব এবার একটু স্বাভাবিকে এলো, বিড়বিড় করে বললো, ভাবীর কল এসেছিলো।আমার ছোট্ট আরাফ সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। কপালে কেটে গেছে। খুব রক্ত ঝরছে। সবাই হাসপাতালে নিয়ে গেছে।সে বাবা বাবা বলে কাঁদছে। কথাগুলো বলতে গিয়ে শিহাবের ভেতরে কান্নার ঢেউ এলেও এমন খোলা যায়গায় সে নিজেকে খুব কষ্ট করে সংযত রাখলো।
তাহলে তো আপনার এখুনি যাওয়া উচিত শিহাব ভাইয়া। দেরি করবেন না।
শিহাব কথাটি ঠিক শুনলো কিনা! সে মোবাইলে কিছু টাইপ করছে যেন।
শিহাব শায়লাকে মেসেজ পাঠিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো পার্লারে এখন ও নানান প্রস্তুতিতে আছে।এখন কিছু জানলে ও বেরিয়ে আসতে চাইবে। আবার শিহাবের এতটা সময় অপেক্ষা করাও সম্ভব না? তার আরাফের জন্য মন মানছে না। এমনিতেই শিশুটি মা বাবার আদর ছাড়াই বড় হচ্ছে। ওর কোন বিপদ শিহাবের মনে অনেকখানি ব্যথায় ভরিয়ে দেয়। ধি্বে অন্তরে ভাবনা ঢেউ,নিশ্চয়ই আরাফ ব্যথায় খুব কাঁদছে। নিশ্চয়ই তাকে দেখতে চাইছে !
শিহাব ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে কি করবে ?
তবুও তাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে। শিহাবের এই একটা চমৎকার গুন। সে সব অবস্থাতেই নিজেকে স্থির রেখে করণীয় দ্বায়িত্ব কর্তব্যের ছক কেটে নিতে পারে। তাকে এখন দুই দিকই সামাল দিতে হবে।
যদিও শায়লা সবই সহজভাবে নিবে চাইকি জানতে পারলে সে এখনই আরাফের জন্য ছুটে যাবে !
আবার শিহাব এটাও জানে, ভালবাসায় ভুল বুঝাবুঝি দুজনার মাঝে আনতে পারে বিস্তর ফারাক।এতে দুজনার প্রতি দুজনার বিশ্বাস হারায়। তাই শিহাব আর দেরী না করে,মেসেজে সে তার প্রকৃত অবস্থা শায়লাকে জানিয়ে দিলো। শায়লার প্রতি তার শুধু এটুকু মিনতি রইল, শায়লা তুমি আমার অপেক্ষায় থেকো। আমি আরাফকে সুস্থ করে তোমার কাছে ফিরবো। শায়লার প্রতি শিহাবের অনেক আস্থা। সে তার যে কোন কিছুকে খুব সহজভাব নিবে। রিশতিনা বা আরাফের বিষয়টিতে সে কোন প্রশ্ন আনেনি কোনদিন।কারণ শিহাবের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস আর অপরিসীম ভালবাসা। শিহাব মেসেজ সেন্ড করে সময় দেখে নিলো।এগারোটা বাজছে।শায়লার আরো একঘন্টা লাগবে।এদিকে জিগাতলা থেকে আবার মায়ের ফোন এলো। মা কাঁদছে। শিহাব আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। সামনে যে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে শিহাব তা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল।শিহাব বাইক স্টার্ট দিয়ে আবার থামল। সে হঠাৎই রাহাতের হাত ধরে অনুরোধের সুরে বললো, রাহাত আমি যাচ্ছি।সন্তানের ডাক সে এক অন্যরকম অনুভুতি। যেন এক সাগর সাঁতরে যেতেও কোন কষ্ট বোধ নেই। শুধু অনুরোধ রইল, তোমার আপুকে কানাডা যেতে দিও না। ওখানে গেলে ও বাঁচবে না। আমার শূন্যতা ওর কাছে এক অপূরণীয় অনুভুতি। আমার অনুপস্থিতি যেন জলবিহীন মরুদ্যান।
আমি ওকে খুব করে চিনেছি রাহাত।আমাকে ছাড়া ওর জীবনীশক্তি হারিয়ে যাবে। আর আমিও এদিকে একাকীত্বের বেদনায় ডুবে যাবো। তোমরা ভুল করোনা। শায়লাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিও না।শিহাব আর কিছু বলতে পারছে না। তার মনের ভেতর প্রচন্ড এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। রাহাতের কাছে সকল আর্জি জমা রেখে গেলো। শিহাব হেলমেট পরে বাইক স্টার্ট দিয়ে উচ্চরবে হর্ণ তুলে ঢাকা এয়ারপোর্ট রোডের জনারণ্যে মিশে গেলো। রাহাত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বারবার তার একই পরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে।একদিকে পরিবারের মান সম্মান আরেকদিকে দুটি সুন্দর মনের কাছে আসার আকুতি। সে এখন বেশ বুঝতে পারছে রুহি খালার কথা শুনে তার মত বদলে ফেলা উচিত হয়নি। শায়লা আপু শিহাব ভাইয়া তো তার কাছেই সমাধানের জন্য এসেছিলো। তার নিজেকে বদলে ফেলা উচিত হয়নি। এতদিনে ডিভোর্সের কাগজপত্র এগিয়ে নিলে নোমান ভাইয়াকেও ঠেকানো যেতো। রাহাত আর কিছু ভাবতে পারছে না। বিষয়টি ভীষণ জটিল হয়ে গেলো। শায়লা আপুকে সুখী দেখাইতো তার চাওয়া ছিল। আপুর চোখের ছায়ার সর্বদাই শিহাব ভাইয়া। আর শিহাব ভাইয়াও আপার জন্য যেভাবে বারবার ছুটে আসছে এমন একটা বন্ধন এক হতে না দিলে রাহাত সারাজীবন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।আর কিছুক্ষণ পরে আপুর হাজবেন্ড নোমান ভাইয়ার বিমান ল্যান্ড করবে। আপুকে নিয়ে তাকে রিসিভ করতে যেতে হবে।কিন্তু শিহাব ভাইয়ার এই খবর জানলে আপুকেতো কিছুতেই শান্ত রাখা যাবে না। উফ ! আমি আর ভাবতে পারছি না। রাহাত সবকিছু নিয়তির উপর ছেড়ে দিল। চারপাশের মানুষের এত কোলাহলেও সে নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভেতরে শায়লা নানান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।তক্ষুনি তার শিহাবের মেসেজ দেখাটা তার সম্ভব হলো না। সবকিছু শেষ হতে প্রায় বারোটা বেজে গেলো। শায়লার নিজেজে বেশ ফুরফুরে লাগছে। সে বুঝতে পারছে বাইরের সৌন্দর্যও মনের প্রফুল্লতা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য সে এতদিন এসবকিছুর দিকে একেবারে খেয়াল দেয়নি।পুরোটা সময় সে শিহাবের ভাবনায় ডুবে থাকতো। আয়নায় নিজেকে খুব ভাল করে দেখতে লাগলো।নিজের কাছে নিজেকে অচেনা লাগছে। আগের চেয়েও আরো আকর্ষণীয় লাগছে।কিন্তু শিহাবের চোখে কি তা ধরা পড়বে ? শিহাবের কথা মনে হতেই সে ভেবে নিলো নীচে শিহাব অপেক্ষায় আছে দ্রুত বেরুতে হবে। সে বুবলীকে খুঁজতে লাগলো। হঠাৎই বুবলী সামনে এসে দাঁড়ালো। দারুণ এক হেয়ার স্টাইলে তাকে চেনাই যাচ্ছে না।
চটপটে বুবলী নিজেকে আড়াল করে শায়লার প্রশংসায় একের পর এক বাক্য ব্যয় করে যাচ্ছে। ওয়াও আপু তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।দুলাভাই আজ এসে তোমাকে চিনতেই পারবে না।
শায়লার ভেতরে শিহাবের জন্য মনটা খচখচ করছে। কতক্ষণে সে নীচে নামবে। আর যেভাবেই হউক রাহাতকে এড়িয়ে তাকে শিহাবের কাছেই যেতে হবে।আর সে যদি তা না পারে তাহলে আজীবনের মত সে শিহাবকে হারাবে।মনে মনে সে নিনেকে তৈরি করে নিলো। বুবলীকে দ্রুত বিল মিটিয়ে নীচে নামতে বললো। বুবলী ধরেই নিলো, দুলাভাইয়ের জন্য আপুর আর ত্বর সইছে না।
বিল হিসেব পত্র করে বুবলী টাকার লেনদেন সেরে নিলো। পার্লারের একটি মেয়ে শায়লাকে একটা ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে তার সুন্দর দাম্পত্য জীবনের জন্য অভিনন্দন আর শুভকামনা জানালো। শায়লা এক ঝলক শিহাবকে ভেবে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো!
দুজনে লিফটে নীচে নেমে এলো। শায়লার উৎসুক চোখ শিহাবকে খুঁজছে। নিশ্চয়ই শিহাব তাকে দেখে এগিয়ে আসবে।শায়লা শিহাবের লাল বাইকটি খুঁজছে। শায়লা আশেপাশে তাকাচ্ছে।বুবলী বুঝতে পারছে না আপু কাকে খুঁজছে ! ঐতো রাহাত ভাইয়া দাঁড়ানো। শায়লাকে রেখেই বুবলী রাহাতের দিকে এগিয়ে গেলো।
ভাইয়া এইতো আমরা। গাড়ি কোথায় ?
রাহাত শুধু শায়লার চোখের দিকে তাকিয়ে।
তবে কি শিহাব ভসিয়া আপুকে জানিয়ে যায়নি ? আপু কেন তবে শিহাব ভাইয়াকে খুঁজছে । সামনে বুবলী দাঁড়ানো, রাহাত স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু শায়লার ব্যথাক্লিষ্ট মনের ছাপ শায়লার মুখে যেন ভেসে উঠেছে ! রাহাত আপুর মনে অবস্থা খুবই বুঝতে পারছে।শিহাবের অনুরোধের প্রতিটি কথাই তার কানে বাজছে।
রাহাত এগিয়ে এসে বললো, আপু বাসায় চলো। আমাদের এয়ারপোর্টে যেতে হবে।
কিন্তু শায়লার চোখে রাহাতের প্রতি তীক্ষ্ণ প্রশ্নবান যেন আক্রমণ ক্রতে চাইছে।
নিশ্চয়ই রাহাত শিহাবকে এমন কিছু বলেছে তাই শিহাব চলে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো,শিহাব তো কারো কথায় চলে যাওয়ার মত ছেলে নয়! তবে সে কোথায় গেলো ?
রাহাত আর শায়লার মাঝে দাঁড়িয়ে বুবলী কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন আপু গাড়িতে উঠছে না আর কেনইবা রাহাত ভাইয়া আপুকে গাড়িতে তুলছে না।
শায়লা শিহাবকে কল করতে চাইলো। কেন সে এখানে নেই ? সে তাকে রেখে কেন চলে গেছে ? এসব জানতেই শায়লা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করতেই শিহাবের মেসেজ দেখতে পেলো। সবটা জেনে শায়লার যেন দেহে প্রাণ ফিরে এলো। সে মনে মনে বলে উঠলো, শিহাব আমি তোমার জন্য আজীবন অপেক্ষায় থাকবো।তবে আরাফের শায়লার জন্য মনটা কেঁদে উঠলো।
রাহাত এগিয়ে এসে শায়লার হাত ধরলো। আপু চলো,বাসায় যাই।
শায়লা তার অনাগত পরিস্থিতিতে নিজেকে সঁপে দিলো। নিয়তির কাছে সমর্পণ করলো তার ভবিষ্যৎ । সে ধীর পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। শায়লার চোখে তখনো আজ সকালে দেখা মেরুণ রঙা শার্টের শিহাবের মুখটা মুখটা যেন মিশে আছে।
শায়লা মনে মনে বলে চললো, শিহাব তুমি যেখানে যেভাবে বা যতদূরেই থাকো তুমি আমার মনের সবটা জুড়ে। আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি।
ভাইয়া, ফুলের অর্ডার দেয়া ছিল। ওরা কি কিছু জানিয়েছে ? আপুর হলুদের জন্য ফুলের গয়না দেয়ার কথা আর ফুল দিয়ে ঘর সাজিয়ে দিয়ে যাওয়ার কথা।
রাহার ভাইয়া ওরা কি যোগাযোগ করেছে ?
দায়িত্বশীল বুবলীকে সবদিক দেখতে হচ্ছে।কিন্তু বুবলীর প্রশ্নে রাহাত নিরুত্তর হয়ে রইল।
শায়লা আর রাহাতের মনের ভেতর যেন এক ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে। যেখানে রাহাত স্বেচ্ছায় পরাজয় বরন করে নিতে চাইছে।
গাড়ি যানজট কাটিয়ে সেক্টর সাতের দিকে এগিয়ে চললো।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much