উপন্যাস
টানাপোড়েন ১২৮
মনের মানুষ থাকুক মনের মন্দিরে
মমতা রায় চৌধুরী
রেখা হঠাৎ ই অন্যমনস্ক হয়ে গেল। পার্থ যে টানাপোড়েনের মধ্যে আছে। রেখা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কতটা কষ্ট হয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে মিল না হলে। শৈশবকালে রেখা নীলকে হারিয়েছে। সেই ক্ষত এখনো টাটকা আছে। জ্বালা, যন্ত্রণা কিছুটা উপশম কাজের মধ্যে ভোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অতীত স্মৃতি ইতিহাসের পাতার মতো জ্বলজ্বল করে।
পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভিড় করে আসে মনের আরশিতে।
এর মধ্যেই জীবনে ঘটে গেছে কত কিছু। স্বপ্নীল এসেছে জীবনে সেও অতীত। এটা হবারই কথা ছিল। বিবাহিত জীবনে পরকীয়া এটা কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু মন তো অনেক কিছু চায়। মনের ক্রাইসিস কে দূর করবে? প্রকৃত বন্ধুর দরকার। প্রকৃত বন্ধুকে সবকিছু বলা যায় নিজের স্বামীকে বলা যায়না। তাহলে সে প্রকৃত বন্ধুটা কে? প্রকৃত বন্ধু সেই যে কখনো বন্ধুকে ছেড়ে কোথাও যায় না হ্যা হয়তো সবসময় তাকে কাছে পাওয়া যায় না কিন্তু তার মানে এই নয় তার দুঃখে তার অবসাদে তার কষ্টে সে শামিল হবে না ।দুঃখ বিমোচনে পরামর্শদাতা হবে না?
সবাই ছেড়ে গেলে ও বন্ধু ছেড়ে যাবে না।
সেরকমই বন্ধু পেয়েছিল স্বপ্নীলকে। স্বপ্নীল বন্ধু হয়ে উঠেছিল হয়তো বন্ধুর থেকে আরো একধাপ উঁচুতে। তবে স্বপ্নিলের সব দাবিতে সাড়া দিতে পারে নি রেখা।
একদিন তো বলেই ফেলল স্বপ্নীল
চলো দূরে কোথাও পালিয়ে যাই।
কোথায় যাব?
যেখানে তোমাকে আমাকে কেউ চিনতে পারবে না?
শ্রাবণী পূর্ণিমায় তোমাকে নিয়ে পালাবো রসিকতা করে বলেছিল।
রেখা একটু রেগে গেছিল এসব কথা তুমি কি বলছো আমি বিবাহিতা আমি সমাজ-সংসার সকলকে ভয় পাই?
আর আমাকে?
আমি তো তোমাকে ভালোবাসি?
রেখা কিন্তু বলেছিল' আমি কি তোমাকে বলেছি ভালবাসি?'
অবাক হয়ে স্বপ্নীল বলেছিল "তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
তুমি আমার দিকে তাকিয়ে বলো?'
রেখা বলেছিল 'না।'
ছোট্ট একটা শব্দ '। অথচ এর ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায় যা তাতে কারো মন ভেঙে খান খান হয়ে যায় ।অবসাদ চলে আসতে পারে ,দুঃখ-যন্ত্রণা ভরিয়ে দিতে পারে।
রেখা জানত কিন্তু রেখার কোনো উপায় ছিল না ।এটা রেখাকে বলতেই হত ।নইলে স্বপ্নীল সারাটা জীবন ধরে রেখার পেছনে পড়ে থাকত জীবনটাকে বাজি রেখে ।
রেখা চেয়েছিল ভালো থাকুক। ওর ও একটা ছোট্ট সংসার হোক। মনের ভিতর রেখার প্রতি ভুলটাকে নিয়েই স্বপ্নীল থাকুক।
স্বপ্নীল অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে ছিল।
তারপর বলেছিল ভালোবাসাটা একতরফাই থেকে গেল। তাই থাকুক। কিন্তু আমি তোমাকে ভালবেসে যাব নিরন্তর। ভালোবাসার মৃত্যু নেই। ভালোবাসা চিরজীবী।
স্বপ্নীলের দুচোখ কখনো জলে ভরা আবেগমথিত কন্ঠে বলেছিল
' ঠিক আছে আমি আসছি ।আমি আমার কষ্টটাকে ভাগ করার জন্য চলে যাচ্ছি কদিনের জন্য।
রেখা অবাক হয়ে বলেছিল কোথায় যাচ্ছ?
তোমাকে বলতেই হবে?'
সেটা তোমার ইচ্ছে।'
আমার ইচ্ছেগুলো কি সেটা তুমি সব জানো ।সেই ইচ্ছেগুলো ডানা মেলে উঠতে পারল না। তবে তোমাকে বলে যাচ্ছি আমি সমুদ্রে যাচ্ছি ঢেউ গুনতে।
ঢেউ এর সাথে সাথে কতবার শুধু ভালোবাসার নামটাই উচ্চারিত হয় ।সেটা দেখতে যাব।
স্বপ্নীল এই কথা বলেই দ্রুত বাইকটা স্টার্ট করে চলে
যায় ।
তার পরে বেশ কয়েকদিন স্বপ্নীলের কোন ফোন নেই ,দেখা নেই।
রেখা জানতো এই নির্দয়তার পরিচয় না দিলে স্বপ্নীল রেখাকে ভুলতে পারবে না। তারপর রেখা
হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল সত্যিই সে স্বপ্নীলকে কতটা ভালোবেসেছে ,এতটা কষ্ট এতটা যন্ত্রণা ,কেন পাচ্ছে ?মনে হচ্ছে স্বপ্নীলের সঙ্গে কথা না বললে রেখার যেন পাগল পাগল লাগছে। একটা শুন্যতা ,রিক্ততা সারাটা মন জুড়ে থেকে
গেছে ।কতবার ফোন টার দিকে তাকিয়েছিল ।একটা ফোন আসেনি ।রেখা ও যখন ফোন করতে গেছে ফোনটা নট রিচেবল থেকেছে। ওই কদিনে রেখার ভেতরে যে কষ্টের পাহাড় গড়ে উঠেছিল তিল তিল করে সেই হিসেব শুধুমাত্র রেখেছে।
রেখা মনে মনে বলেছে স্বপ্নীল 'তুমি জানো না তোমাকে যদি আমি এই কথাগুলো না বলতাম তুমি সারাটা জীবন আমার জন্যই নিজের জীবনটাকে অতিবাহিত করতে কিন্তু আমি তো সেটা চাই না ।আমি চেয়েছি তুমি সুখী হও তোমার একটা ঘর সংসার হোক। সারাটা দিন ক্লান্তি শেষে তুমি নিরাপদ আশ্রয়ে এসে দুটো একটা মনের কথা খুলে বলো ।ক্লান্তি, অবসাদে তোমার কাছে বসে যে তোমার কপালটা একটু টিপে দেবে ,কখনো বা আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে তোমাকে । এমনি করেই একদিন তুমি আমাকে ভুলে যাবে , এটাই নিয়ম।
কতটা যে যন্ত্রণা কতটা যে কষ্ট রেখা মনের ভেতরে চেপে রেখেছিল সেই কটা দিনে। মনে হয়েছিল যেন স্বপ্নীল কোথায় চিরদিনের জন্য রেখাকে ছেড়ে চলে গেল। মিনিটে মিনিটে ঘন্টায় ঘন্টায় সারাক্ষণ শুধু স্বপ্নীলের কথা ভেবেছে।
মনে হচ্ছিল যেন ক্রমশ তাদের এই গল্পে যে পাতা জুড়ে গিয়েছিল।দু মুঠো বিকেল ক্রমশই হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভবের চাদরে মুড়ে গেছিল। আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে শুধুই তোমাকে উপলব্ধি । আর ছেলেমানুষি গুলোকে মনের ক্যানভাসে রং তুলির আঁচড় দিয়ে কোন এক শিল্পীর আঁকায় অবয়ব দেবার চেষ্টায় মন ব্যাকুল হয়েছিল। অথচ চলে যাবার পর সবকিছুই যেন ফাঁকা মাঠের মতো হুহু করা এক রিক্ততা।
তারপর যখন ও ফিরে এসেছে সে কি এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠেছিল রেখার মন ও প্রাণ।
হারানো জিনিস ফেরত পেলে যে অভূতপূর্ব, অনির্বচনীয় আনন্দ এর সৃষ্টি হয়। রেখার ও ঠিক সেরকমই হয়েছিল।
আজ সেই স্মৃতিচারণ করতে বসে রেখার দু'চোখ জলে ভরে ওঠে। সত্যি সত্যি রেখা চেয়েছিল, স্বপ্নীল নিজের মতো করে বাঁচুক।
আর যখন স্বপ্নীল নিজের মতো করেই বাঁচার জন্য রেখার থেকে দূরে চলে গেল তখন রেখা মানার চেষ্টা করলেও ভেতরে কষ্টে যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে হৃদয়টা যেন ভেঙে খান খান করে দিয়ে গেল। এখন স্বপ্নীল কে দুটো কথাও বলতে পারে না কোথায় আছে কে জানে ?কোথায় হারিয়ে গেল ওর জীবন থেকে ।গল্পের পাতা গুলো এভাবেই ছিঁড়ে গেল।
সত্যিই তাই সবকিছু সুন্দর হয় যদি কাছে থাকে এমন কেউ।
মনে মনে চাইছে স্বপ্নীল আবার ফিরে আসুক জীবনে । ফিকে হয়ে যাওয়া ধূসর জীবনে হাতছানি দিক কৃষ্ণচূড়ার পলাশের রং। ফিরে আসুক আবার বসন্ত কোকিলের কুহুতান আবার ডেকে উঠুক তাদের সুমিষ্ট ধ্বনি।
এমন সময় এক ঝাঁক পায়রা উড়ে চলেছে নীল আকাশে হয়তো বা ওরা গোধুলিবেলায় নিজের নিজের ঠিকানায়। রেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল ওদের। কি মুক্ত স্বাধীন যখন খুশি যেখানে খুশি চলে যেতে পারে ,নেই কোনো বাঁধন। এরকম মুক্ত পাখির মতো যদি ডানা মেলে উড়ে যেতে পারত দূর-দূরান্তে। হয়তো বা ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারত স্বপ্নিলের।
এমন সময় শাশুড়ির চিৎকারে রেখার ধান ভাঙ্গে।
'হ্যাঁ রে মনু, বলি তোর বউটা কি বেআক্কেলে রে।
এতটা সময় হয়ে গেল চা পেলাম না। শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে, না কিরে?'
মনোজ বললো 'সে কি ?
এখনো চা পাওনি?'
তাহলে কি তোকে আমি মিথ্যা কথা বলছি? জিজ্ঞেস কর তোর বউকে।'
মনোজ তারস্বরে চেঁচাতে লাগলো' রেখা রেখা রেখা আ. আ. আ।'
রেখার চমক ভাঙ্গে অবাক হয়ে কাছে এসে বলে কি হয়েছে এভাবে চিৎকার করছো কেন?
এখনো চা দাওনি মায়েদের?
গ্যাস নেই তো।
সেকি?? আগে বলনি তো?
মনে করে দেখো ৫-৬ দিন আগেই বলেছি গ্যাস শেষের মুখে গ্যাস দিতে বলো।
এই যা আমিতো ইসলামকে বলতে ভুলে গেছি। এখন উপায়?
মনে সংশয় নিয়ে রেখার মুখের দিকে তাকায়।
রেখা বলল পার্থদের বাড়ি খোঁজ নাও ওদের থেকে এনে দাও।
একদম ঠিক বলেছ।
রেখা কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে।
রেখা মনে মনে ভাবে শাশুড়ি মা যখন কথাগুলো বলেন মাঝে মাঝে মনে হয় তার জবাব দিই কিন্তু ইচ্ছে হয়না। বোঝানো যাবেনা শুধু শুধু মুখ নষ্ট করে লাভ নেই। অনেকে বলে এডুকেটেড মেয়ে চুপ চাপ থাকিস কেন প্রতিবাদ তো করতে পারিস। তখনই প্রতিবাদ হয় যখন তার থেকে রিটার্ন কিছু পাওয়া যায় । উজবুক দের বুঝিয়ে কোন লাভ নেই। সেজন্য বোবা হওয়াই সব থেকে বেশি বেটার।
আজকাল এই পলিসি নিয়ে চলছে রেখা। চালাতেই হবে। না রোজগারের অশান্তি।
কিন্তু কতদিনই বা এ ভাবে মেনে নেবে জানে না।
ঈশ্বর ধৈর্যশক্তি দিন। ছুটির দিন কোথায় গল্প লিখবে সে ফুসরত নেই। এরমধ্যে কলিংবেলের আওয়াজ" জয় গনেশ, জয় গনেশ ,জয় গনেশ দেবা।"
রেখা গিয়ে দরজাটা খুলে দেখে পার্থ একগাল হাসি নিয়ে বললো 'বৌদি ,এই নাও তোমার রান্নার গ্যাস। এতক্ষণ তোমরা চা না করে বসে
আছো ।আমাকে একটা ফোন করলেই তো হতো।
"হ্যাঁ ,তা হতো আসলে আমিও একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম।
ও বৌদি কবে যাবে মায়ের কাছে?
রেখা বলে ঠিক আছে দেখছি আজকে যদি পারিস সন্ধ্যের পরে যাব।
একটু ভালো করে বুঝাও না বৌদি মাকে।
হাত তুলে আশ্বস্ত করে বলল নিশ্চয় চেষ্টা করব ভাই আমি তোমার মনের কষ্টটা বুঝতে পারছি।
এই জন্যই তো তোমাকে আমি বললাম মা ও তো তোমার কথা শোনে।
ঠিক আছে বৌদি আসছি।
রেখা বলল ঠিক আছে এসো।
পার্থ চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে চলে যাবার সময় পার্থর মুখটা কি অনাবিল আনন্দ আর প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে । পার্থ গান করতে করতে যাচ্ছে 'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে। 'রেখা পার্থর চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে ভাবতে থাকে 'সত্যিই তো একটা ভালোবাসা যদি পরিপূর্ণতা পায় একটু চেষ্টা করে দেখতে দোষ
কি ।ভালো থাকুক সবাই।'মনের মানুষটি থাকুক ভালোবেসে মনেরও মন্দিরে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much