শামীমা আহমেদ





শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত 
(পর্ব ২৫)
শামীমা আহমেদ 

সারাদিন নানান ব্যস্ততায় কেটে গেলেও ভেতরে ভেতরে শিহাবের কোথায় যেন একটা চাপা ব্যথা। অপ্রকাশিত অভিমান। কিছু হারিয়ে যাওয়ার উৎকন্ঠা,যেন ভেতরে বয়ে চলেছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা,চারিদিক শোকে মুহ্যমান। সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই লগ্নে শিহাব যাবতীয় দ্বায়িত্ব সেরে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলো।বেরুনোর আগে মোবাইলে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলো।নাহ! কোন মেসেজ নেই। বুঝা গেলো শায়লা খুবই অভিমানে আছে। শিহাব দোষটা, দায়টা নিজের উপরেই নিলো। শায়লাকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না,শায়লাকে অপেক্ষায় রেখে তার ভেতরেও কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে।
না, এভাবে দিনদিন একটু একটু করে সম্পর্কটা কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছে? শেষটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? শায়লা বিবাহিতা,একজনের জীবনসঙ্গী।এভাবে তাকে, তার মনকে এখন শিহাবের দিকে ফেরানো মোটেও কোন যুক্তিযুক্ত কাজ হচ্ছে না। শিহাব নিজেকে চিনতে পারছে না।নাহ! সেতো কখনো এমন অসংলগ্ন কাজ করেনি। পরিবারে সে যথেষ্ট দ্বায়িত্ববান একটি ছেলে তার এমন দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ করা ঠিক হচ্ছে না।কিন্তু তার জীবনে শায়লার এই সহসা আগমন, কথায় কথায় এতটা জড়িয়ে যাওয়া যেমন একটা পূর্ণতা এনে দেয় আবার শায়লার নীরবতা, অনুপস্থিতিও তার মাঝে একটা শূন্যতায় ভরিয়ে দেয়। সারাদিনে শায়লার একটা খোঁজ না নিলে মনের ভেতর অস্বস্তি লাগতে থাকে,তাকে ভেবে শায়লা কতইনা গভীরে চলে যায়, তার অতীতের কষ্টটা ভুলে থাকতে শায়লার একটু  কন্ঠের ছোঁয়া শিহাবকে প্রানবন্ত করে তোলে, শায়লার সাড়া না পেলে অভিমানে তার মনটিও ভরে যায়।মনের কোনে কোথায় যেন এক অদৃশ্য টানে বারবার শায়লার কাছে ফিরে আসা। তবে কি শায়লাকে সে বাঁচার অবলম্বন ভাবছে? একাকী জীবনে সঙ্গী করে পেতে চাইছে?
নয়তো কেন এমন অনুভুতি অনুভব?বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা অধিকার জন্মাচ্ছে ধীরে ধীরে।নাহ! নিজেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শায়লাতো ঠিকই করছে। যার কখনো কোন বাস্তবরূপ হবে না, শুধু মনের মায়ার টানে কেন মিথ্যে আশায় তাকে বাঁধা?
মনের এমনি নানান ভাঙা গড়ায় শিহাবের ভেতরে সিদ্ধান্তহীনতা। 
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিহাব বাইকে স্টার্ট দিলো।মনের ভেতর নানান প্রশ্ন আর উত্তরের দোলাচলে শিহাব এগিয়ে চললো।

শায়লা সারাদিন মনের ভেতর একটা দৃঢ় সিদ্ধান্তে অটল রইল। শিহাবকে কিছু কথা বলবে ভেবে সে মনস্থির করলো।ভেবে নিলো নিজেকে ফেরাতে হবে এই মিথ্যে মায়া মরীচিকা থেকে। এই অলীক স্বপ্ন, কোনদিনই যার কোন বাস্তবরূপ আসবে না তার জন্য কেন এত অপেক্ষা, উৎকন্ঠা?যেখানে দুজনার জীবনের শুরুর পাঠ  আর শেষের গন্তব্য ভিন্ন,শুধুমাত্র ক্ষনিক সময়ের জন্য যার যার গন্তব্যের অপেক্ষমান ট্রেনের যাত্রী হয়ে এক প্ল্যাটফর্মে  ক্ষনিকের দেখা। শায়লা বেশ বুঝতে পারে শিহাব তার নিজের জীবনকে একটি গন্ডীতে বেঁধেছে।হয়তো কখনো মনের কোন দূর্বলতায় শায়লাকে আপন ভেবেছে। আজ যখন শায়লা এগিয়ে গেছে শিহাব নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিচ্ছে।শায়লাও ভেবে নিলো সেও নীরব থাকবে।নিজেকে গুটিয়ে নিবে।শায়লা আনমনা হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।আকাশে চমৎকার চাঁদ উঠেছে!কিন্তু শায়লার মোটেও চাঁদটিকে ভালো লাগছে না।মনে  হচ্ছে  চাঁদটি কেমন যেন  তার দিকে চেয়ে উপহাসের হাসি হাসছে।শায়লা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল।ঘরের বাতি দেয়ার আলসেমিতে ভর সন্ধ্যাও ঘরটি আলোহীন হয়ে রইল!

সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত্রি নেমে এলো।পথ ঘাট পেরিয়ে শিহাব  শহরের পানে ছুটছে। একটু থামতে হবে।সন্ধ্যার চা পানের তাগিদ অনুভব করাতেই একটা চায়ের দোকানে থামল। বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে শিহাব একটা স্টিকে আগুন ধরিয়ে চোখ বন্ধ করে বেশ একটা সুখটান দিতেই আচমকা শায়লার মুখটা ভেসে উঠল! আর চোখ খুলতেই শিহাবের চোখ আটকে গেলো আকাশের অমন বিশাল রূপার থালার মত চকচকে চাঁদের গায়ে ।সারাটা আকাশ একেবারে ধবধবে সাদা হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর বুকে চাঁদ থেকে ঠিকরে আলো বেরিয়ে আসতে চাইছে।মূহুর্তেই
শিহাব জীবনের প্রতি তার সব মান অভিমান সঠিক ভুলের হিসেব নিকেশ ন্যায় অন্যায়ের ভেদাভেদ ভুলে গেলো। চট করে মোবাইলে শায়লার নাম্বারে কল দিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন শায়লার কন্ঠটা ভেসে আসবে!

ও প্রান্তে শত অভিমানেও  শায়লা ভেতরে ভেতরে একটা ফোন কলের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে ছিল। কল আসতেই সারাদিনের যত ভাবনা দূর্ভাবনা নিমেষেই জল হয়ে গেলো।
ফোন রিসিভ করেই শুনল শিহাবের কন্ঠ! 
শায়লা, কেমন আছেন?
শায়লায় চোখ  উপচে জল পড়লো।
ভালো নেই।
কেন? 
শায়লা কি জবাব দিবে বুঝে উঠতে না পেরে কেমন করে যেন ভেতর থেকে দ্বিধাহীনভাবে কথাগুলো উঠে এলো আর মুখ ফসকে তা বেরিয়ে এলো,শিহাব আমি অসুস্থ। তুমি আমাকে দেখে যাও।তুমি এলেই আমার সব অসুস্থতা ভালো হয়ে  যাবে।আসবেতো?
ওপ্রান্তে শিহাব শায়লার এমন  আবেগী উত্তরে একেবারে জমে ঠান্ডা হয়ে গেলো। শরীরের রক্ত চলাচল মূহুর্তের জন্য থমকে গেলো।
মনে হলো  লোহার মতন শক্ত পৃথিবী পৃষ্ঠে সে দাঁড়িয়ে। আর ভেতরে উথাল পাথাল সমুদ্দুর।কেমন করে বুঝাবে সারাটাদিন তার কেমন কেটেছে। শিহাব খুব ভালো করেই জানে দুঃখের অমানিশা কেটে গেলে আসে আলোকিত রক্তিম ভোর।যা চিরকালীন সত্যি। মানুষ দ্বিধাহীন থাকলেও প্রকৃতিই তার সমাধান করে দেয়।শায়লার অমন স্পষ্ট উচ্চারণে শিহাব স্বপ্ন আর বাস্তবের উর্ধ্বে কোন এক বায়বীয় জগতে ভাসছিল।
কোন আগপিছ না ভেবে বলে উঠল, তোমার বাসার ঠিকানাটা জানাও আমি তোমাকে দেখতে আসবো।ওপ্রান্তে শায়লা কাঁদছে।
শিহাব ফোন বন্ধ করে হাতের জলন্ত সিগারেট ছুড়ে ফেলে দিল। চোখ তুলতেই দেখলো চাঁদটি যেন তার পানে চেয়ে হাসছে। শিহাব দ্রুত মোবাইল ক্লিকে চাঁদের ছবিটি তুলে নিয়ে শায়লাকে পাঠিয়ে দিল।আর লিখলো "আজকের চাঁদ"।
শায়লা বুঝে নিলো,শিহাবই তাহলে চাঁদটিকে শায়লার কাছে পাঠিয়েছিল। শায়লা দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল আকাশের চাঁদটিতে শিহাবের মুখটি হাসছে!
শিহাব বাইকে স্টার্ট দিলো। আজ শায়লার সাথে দেখা করে তারপর বাসায় যাবে।মনে মনে বারবার বাসার ঠিকানাটা  আওড়ে নিলো।
চলবে..

মন্তব্যসমূহ

সুন্দর ভিউজ নজর করুন

কবি সানি সরকারের কবিতা "দগ্ধ - মৃত - গাছ"

কবি আইরিন মনীষা এর কবিতা "বেদনার বালুচরে"

রীনা ঘোষ