০৯ এপ্রিল ২০২২

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ৮৪




ধারাবাহিক উপন্যাস 


শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৮৪)
শামীমা আহমেদ 



গাড়ি থেকে নেমে শায়লার চলার গতি ধীর হয়ে যায়। কেমন যেন পায়ে বাধা নিয়ে চলছে। বুবলী ঠিক বুঝতে পারছে না শায়লা আপু কেন এতটা ম্রিয়মান হয়ে আছে।আজ এতদিন পর তার হাজবেন্ড আসছে তারতো অনেক হাসিখুশি থাকবার কথা। গাড়িতে না হয় রাহাত ভাইয়া আর  ড্রাইভার ছিল কিন্তু এখনতো আপুর মধ্যে একটু আগ্রহ আসা উচিত।বুবলী যেন শায়লার অনিচ্ছাতে পার্লারে এনেছে। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কেন আপু এতটা নীরব ! বুবলী শায়লার হাত ধরে লিফটের দিকে এগিয়ে নিলো।কিন্তু শায়লা বারবার যেন পিছনে ফিরে কাউকে দেখবার চেষ্টা করছিল। লিফটে উঠে ওরা আটতলায় পার্লারে নামলো।  পার্লারে ঢুকতেই হেল্পিং মেয়েগুলো এগিয়ে এলো। তারা কি করতে চাইছে জানতে চাইল। বিয়ের সাজ না কোন পার্টি প্রোগ্রাম,না ম্যারিজ এনিভারসারি ? নাকি হলুদ না  পরিবারের কারো বিয়ে ? নাকি আজ বৌভাত, এটা কি নতুন বউ নাকি বাড়িতে  কোন আকদের আয়োজন ? তাদের মধ্যে কে বিয়ের কনে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নবাণে ওরা ওদের ক্লায়েন্টকে কাজে উৎসাহী করে তুলতে চাইছে। তারা দুজন কে কি করতে চায়।পার্লারে নানান রকম প্যাকেজ অফার শোনাতে লাগলো। বুবলী একা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। সে চাইছিল শায়লার ইচ্ছে মতই সব কিছু হউক। কিন্তু  বুবলী লক্ষ্য করছে আপুকে কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে । বুবলী জানে মেয়েরা বিয়ের দিন একটু আপসেট থাকে।জন্ম থেকে চেনা বাবার বাড়ির পরিবেশ থেকে অচেনা একটা মানুষকে তার পরিবারকে আপন করতে হয় এতে মেয়েরা একটু আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। কিন্তু শায়লা আপুর মুখটায় ঠিক সে রকমের কোন উৎকন্ঠা না তবে অন্য কেমন যেন মনটা ভার হয়ে আছে। 
তবুও যার বিয়ে তার ইচ্ছের তো মূল্য দিতে হবে। বুবলী শায়লাকে এক ঝাকুনি দিয়ে বললো, আপু তোমার কি হয়েছে ? ওরা এত রকম অফার দিচ্ছে তুমি কিছুই বলছো না ?  
কোনটা কি করাবো বুঝতে পারছিনা তো। 
পরক্ষনেই শায়লা কথা বলে উঠলো। বুবলী তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো। এবার বুবলীর পক্ষে সিদ্ধান্ত  নিতে সহজ হলো। সে তার অনেক বান্ধবীর সাথে এভাবে বিয়ের আগে পার্লারে গেছে। তার অভিজ্ঞতা থেকে তাই বুবলী জানিয়ে দিলো,আজ আপুর হাজবেন্ড এক বছর পর কানাডা থেকে দেশে ফিরছেন। আপু একটু ফ্রেশ হতে চাইছেন। পার্লারের মেয়েরা এবার বুঝে নিলো কি করতে হবে। ওরা জানিয়ে দিল মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত যা যা করনীয় ওরা তা করে দিবে। বুবলী এবার একটু সুস্থির হলো । ওদের ওপর সব কিছু ছেড়ে দিলো। শুধু জানতে চাইলো  টোটাল কত খরচ পড়বে ? উত্তর শুনে  বুবলী কাজ শুরু করে দিতে বললেন। রাহাত আগেই বুবলীকে বেশ মোটা অংকের টাকা দিয়ে রেখেছিল গাড়িতে আসার সময়। বুবলী মোবাইলে রাহাতকে জানিয়ে দিলো যে কতটাকা লাগছে আর কতটা সময় লাগবে।রাহাত দুটোতেই সম্মতি জানিয়ে কাজে এগিয়ে যেতে বললো। যদিও নোমান সাহেব প্রতি মাসে নিয়মিতই শায়লার একাউন্টে বেশ মোটা অংকের টাকা পাঠাতো
স্ত্রীর  প্রতি খুবই মহান একটা দায়িত্ব  সে পালন করেছে । তবে শায়লা কখনো সেই একাউন্টের টাকা ধরেও দেখেনি। এই দেড় বছরে বেশ অনেক পরিমাণ টাকাই জমেছে। শায়লার কখনো সে টাকা ছুঁয়েও দেখেনি।আসলে শায়লা কখনোই মন থেকে নোমান সাহেবকে আপন করে নিতে পারেনি। আর তা সম্ভবও নয়। যেখানে শিহাব তার পুরোটা  মন জুড়ে দখল করে আছে।  কাজের শুরুতে প্যাকেজের আওতায় যা যা করতে হবে ওরা কয়েকজন মিলে তা শুরু করে দিলো।বুবলী দেখছে শায়লা আপু খুবই চিন্তামগ্ন। ওর সাথেও খুব একটা কথা বলছে না। বুবলী নিজের জন্য টুকটাক কিছু কাজ সিলেক্ট করে সেও বসে গেলো।  হঠাৎই দেখলো শায়লার একটা মেসেজ এলো। মোবাইলে তাকিয়েই শায়লার সারা মুখে হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে গেলো ! বুবলী ভাবলো নিশ্চয়ই দুলাভাইয়ের মেসেজ। তাইতো আপু এত খুশি হলো। হয়তো এজন্যই আপু মন খারাপ করে ছিল এতক্ষন। কিন্তু বুবলী বুঝতে পারছে না কিভাবে মেসেজ এলো ?  দুলাভাইতো এখন ফ্লাইটে । সে কিভাবে মেসেজ পাঠাবে ? বুবলী মনের ভেতর প্রশ্নটা নিয়ে আয়নায় তাকালো।
কেমন যেন ঘটকা লাগছে তার কাছে। মনে হলো আপুকে একটু জোর করেই যেন পার্লারে আনা হলো। বুবলীর সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। সে নিজের দিকে মনযোগ আনলো। হ্যাঁ চুলটা একটু স্ট্যাইল করে কাটতে হবে। নয়তো ভাল লাগবে না।
যদিও এখন সবকিছুই শায়লার ইচ্ছার বাইরে করতে হচ্ছে কিন্তু এইমাত্র শিহাবের মেসেজ পেয়েই শায়লা যেন উজ্জীবিত হয়ে উঠলো !
শিহাবের চমৎকার মেসেজ ! 
তোমার যতক্ষন ইচ্ছে সময় নাও।আমি নিচে তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি । তুমি নেমে আমার বাইকে চলে আসবে।আমরা আজ ঢাকার বাইরে চলে যাবো। 
শায়লার চোখ আনন্দে হেসে উঠলো ! সে শুধু লাভ রিয়াক্ট দিয়ে  সম্মতি জানিয়ে মোবাইল  ব্যাগে তুলে রাখলো। মেয়েগুলো  একেকজন শায়লার  হাত পা চুল নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলো। তারা শায়লার ম্যানিকিওর পেডিকিওর হেয়ার অয়েল ট্রিটমেন্ট করছে। হেয়ার মাসাজ হবে এরপর। তাছাড়া এখনোতো ফেসিয়াল ভ্রু প্লাক আরোমা স্পা বডি মাসাজ  আর হেয়ার সেটিং বাকী। সব মিলিয়ে দু'ঘন্টা লেগে যাবে। নিশ্চয়ই  শিহাব তার জন্য অপেক্ষা করবে। শিহাব মেরুন রঙা শার্ট পরা ছিল আজ।শায়লা একঝলক দেখেছে।আর সেটাই যেন চোখে লেগে আছে। শায়লা সামনের বড় আয়নায় তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ভেবে নিল, আজকের এই সাজটা যদি শিহাবের জন্য হতো তবে যেন শায়লা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানবী। কিন্তু সেকি পারবে রাহাতকে এড়িয়ে শিহাবের কাছে যেতে ? এ কথা ভাবতেই তার চোখ জলে ভরে গেলো।

শায়লা আর বুবলী  গাড়ি থেকে নেমে যেতেই রাহাত ড্রাইভার মুনীরকে  আন্ডারগ্রাউন্ডে গাড়ি রাখতে বলে সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। রাহাতের ইচ্ছা শিহাবের সাথে কথা বলার। আর তা ড্রাইভার মুনীর যেন দেখতে না পায়। রাহাত সবসময়ই ড্রাইভার দারোয়ান কাজের লোকদের থেকে সাবধান থাকে। ওরা নানানজনে কথা ছড়ায়। 
রাহাত শিহাবের দিকে এগিয়ে গেলো।রাহাত দেখলো  মেরুন রঙা শার্টে শিহাবকে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে। রাহাত সালাম দিয়ে দুজনেই হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে নিলো।
শায়লার কারনে দুজনে একসময় খুব কাছাকাছি এসেছিল। শিহাবের চাওয়াকে বাস্তব রূপ  দেয়ার জন্য রাহাত প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে রাহাত নিযেকে পালটে  ফেলেছে।বলা যায় শায়লা আর শিহাবের সাথে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।অবশ্য এতে শিহাবের কিছু আসে যায় না। শায়লাকে আপন করে পেতে সে একাই যথেষ্ট।  
কেমন আছেন শিহাব ভাইয়া ? রাহাত খুবই নমনীয় ভাষায় কথা বললো।
শিহাব রাহাতকে তার মনের দৃঢ়তা প্রকাশ করতে জানালো, আমি এই মূহুর্তে খুব ভালো আছি। আমি শায়লার জন্য অপেক্ষায় আছি।এটাই আমার সবচেয়ে মধুর সময় রাহাত। আর তুমি এটা খুব ভালো করেই জানো তোমার আপু আমার কাছে কতখানি ভালোবাসার। রাহাত নিজেকে যেন সবকিছুর জন্য অপরাধী ভাবছে।তবুও পরিবারের সম্মানের দিক বিবেচনায় তাকে এতটা  কঠোর হতে হয়েছে,জানালো রাহাত।
শিহাব তাতে এতটুকুও বিচলিত না হয়ে বললো, তুমি চিন্তা করোনা রাহাত, তোমার আপু আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারবে না কোনদিন। সংসার করাতো দূরের কথা।
রাহাত এবার যেন ভেঙে পড়লো।  যদিও শিহাবকে রাহাতের নিজেরও খুবই ভালো লাগে কিন্তু তার কিছুই করার নেই। রাহাত বললো, ভাইয়া,  আপনার আর আপুর সম্পর্কটা যদি আপুর বিয়ের আগের হতো তাহলে আমি নিজেই আপুকে আপনার হাতে তুলে দিতাম। কিন্তু একজন বিবাহিতা নারী অন্যের দাবীদার। সেটাতো আমি ছিনিয়ে নিতে পারি না।
শিহাব যেন শায়লার হয়ে আজ তার বক্তব্য রাখছে। শিহাব আবার বলতে শুরু করলো, 
রাহাত শায়লার বিয়েতে তোমরা নিজেদের স্বার্থটাই দেখেছো। তাইতো শায়লার মত না নিয়ে ওকে তোমরা বিয়ে দিয়েছো। বিয়ের আগে না পরে জানিনা, আমি শায়লাকে ভালোবাসি।আর শায়লাও আমাকে ভালবাসে।সে কানাডা যেতে চায়না। সে দেশে থাকতে চায়, সে  আমাকেই চায়। আমরা এক হবোই। 
এবার রাহাত ভীষণভাবে ভীত হয়ে গেলো।সে হাত জোড় করে শিহাবের কাছে নানান আকুতি রাখছে। আমাদের পরিবারের মান সম্মান নষ্ট হবে শিহাব ভাইয়া, ছোট বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজন বোনকে কথা শুনাবে। আত্মীয় স্বজনের কাছে আমরা ছোট  হয়ে যাবো। সেই দূরদেশ থেকে নোমান  ভাইয়া আসছে তার স্ত্রীর প্রতি তার পূর্ণ অধিকার আছে। সে এবার আপুকে নিয়ে যাবে।
শিহাব রাহাতের কথা খন্ডন করে বললো, সে কি শায়লাকে স্ত্রী হিসেবে নিবে না তার দুই সন্তানকে লালন পালনের জন্য নিবে ? হ্যাঁ, আমারো সন্তান আছে। তবে শায়লাকে আমি আগে ভালোবেসেছি তারপর আরাফের মা করে নিতে চেয়েছি। এখানে আমরা দুজন দুজনকে আগে চেয়েছি শুধু ভালোবেসে।
রাহাত বলেই চলেছে, শিহাব ভাইয়া একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। বাসা ভর্তি মেহমান এসেছে, নোমান ভাইয়া আজ আসছেন তাকে অপমান করা কোন ভদ্রজনোচিত কাজ হবে না 
শিহাব ভাইয়া। 
সে আমি জানতে চাইনা।তোমাদের উচিত ছিল তাকে দেশে আসতে নিষেধ করা।  শিহাব রাহাতের প্রতিটি কথা খুব ঠান্ডা মাথায় খন্ডন করে দিচ্ছে। সে রাহাতকে জানালো, দেখো রাহাত,  তোমার আপু আমার সাথে অনেকবার দেখা করেছে। আমিও তাকে দেখতে চেয়ে আসতে বলেছি। আমি চাইলে কিন্তু তখন তাকে আটকে ফেলতে পারতাম।আমি জোর করলে তোমার আপু থেকে  যেতো।আর সেটাই হতো  তোমাদের পরিবারের জন্য  অসম্মানের। আর তুমি যখন বুঝতে পেরেছো  আমি আর শায়লা পরস্পরকে ভালবেসেছি, ভাই হিসেবে তোমার উচিত ছিল নোমান সাহেবকে বুঝিয়ে বিয়ের সম্পর্কটা ওখানেই শেষ করা। কিন্তু তুমি তোমরা বেচারী শায়লাকে সেই দূরদেশে ওর চেয়েও অনেক বয়সের ব্যবধানের এমন একজনের সাথে বিয়ে দিয়েছো। তুমি নিজে ভাল থাকবার জন্য  শায়লার মন মত কোন কিছুর দিকে তাকাচ্ছো না। এটা খুব অন্যায় হচ্ছে।
কিন্তু শিহাব ভাইয়া এগুলো এখন বলে আর কি হবে ? 
কেন ? শায়লা তোমাকে বলেনি নোমান সাহেবকে আসতে নিষেধ করে দাও। তোমরা সেটা শুনোনি। তবে জেনে রাখো, শায়লা আমার এবং সে আমার সাথেই তার বাকী জীবন কাটাবে। সে নামলেই আমি তাকে বাইকে তুলে নিবো। আমার  বাসাতেই নিয়ে যাবো।তোমাকে ঠিকানা জানাবো বোনকে দেখে আসবে।
আমি সবকিছুতেই খুব স্বচ্ছতা পছন্দ করি রাহাত। শিহাবের কথাগুলোতে রাহাত ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিল। 
রাহাত বুঝতে পারছে না কিভাবে শিহাব ভাইয়্য এতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে। তবে কি ভালবাসার শক্তি সবকিছু জয় করার সাহস যোগায়। শায়লা আপুও যেন পরিবার স্বামী সব কিছুকে উপেক্ষা করছে।রাহাত বুঝতে পারছে না সে এখন কি করবে ?  আর কয়েক ঘন্টা পরেই নোমান সাহেব চলে আসছেন। এখন শিহাব ভাইয়াকে কি দিয়ে থামাবে? তবে রাহাত ভাবছে, সে চাইলে এখুনি শায়লাকে শিহাবের হাতে তুলে দিতে পারে।কিন্তু বৃদ্ধ মা, আত্মীয়স্বজন, পারিপার্শ্বিকতা মান সম্মান কিভাবে এগুলোর মোকাবেলা করবে ? অপরাধবোধে রাহাতের মনের ভেতর কুরে করে খাচ্ছে। সে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো !
হঠাৎই  শিহাবের মোবাইল বেজে উঠলো ! ওপারের খবর শুনে ধবধবে উজালা শিহারের মুখখানি নিমেষেই কালো অন্ধকারে ডুবে গেলো।
রাহাত ওপ্রান্তের খবরটা জানতে উদগ্রীব হয়ে রইল।


চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much