কশায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৩৫)
শামীমা আহমেদ
-----মা'কে কেবিনে শায়লার সাথে রেখে রাহাত সারারাত কেবিনের বাইরের লবিতে বড় সোফাটায় বসে রইল। মাঝে মাঝে ঝিমুনিতে ঘুমে ভেঙে পড়ছিল। সারাদিনতো কম খাটুনি যায়নি! যদিও একজন পুরুষের জন্য এই খাটুনিটা খুব একটা বেশি কিছু না। কিন্তু শায়লাকে নিয়ে রাহাত যে ভীষণ ভয়টা পেয়েছে তা ভেবে বারবার তার গা শিউরে উঠছে! রাহাতের জীবনে সে তার আপুকে কোনদিন একটুও জ্বরে পড়তেও দেখেনি।আপু সারাজীবন অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস করেছে।এই ছিল আপার জীবনের গন্ডী। নাহ! খুব বেশিই চাপ নিয়েছে আপা। রাহাত বারবার একই কথা ভাবছে। আপার প্রতি তার এই উদাসীনতা দেখানো একদম উচিত হয়নি।আপার প্রতি তার অনেক অবহেলা ছিল। সব কাজ আপু উপর চাপিয়েছে। বাড়ির ছেলে হিসেবে তার কিছু দায়িত্ব নেয়া উচিত ছিল। রাহাত ঠিক করলো ইনশাআল্লাহ আপু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে আপুকে এত কাজের চাপ থেকে রেহাই দেয়া হবে। রাহাত নিজের ভেতরে কাজের একটা ছক তৈরি করে নিল।বাড়ির বাজার, ইউটিলিটি বিলস আর যাবতীয় কিছু এখন থেকে নিজেই দেখবে।
মায়েরও বয়স হয়েছে।তার দিকটিও দেখতে হবে। রাহাত আজ বুঝলো আসলেই সে দায়িত্ব নেয়ার মত বড় হয়েছে।মা আর আপু চিরকালই তাকে আদরে আহ্লাদে ছোট বানিয়ে রেখেছে।
রাতে শায়লা একটু সুস্থ বোধ করেছিল।মা আর রাহাতের সাথে একটু কথাও হয়েছে। আপুর মুখের হাসিতে
রাহাতের কাছে মনে হয়েছে যেন ফুল বাগানের ফুলগুলো হাসছে! ডাক্তারের এডভাইস মত শায়লাকে সহজপাচ্য খাবার চিকেন সুপ এনে খাওয়ানো হয়েছে। রাহাত লজ্জায় অনুশোচনায় আপুর চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না ।সবকিছুর জন্য মনে করছে সেই দায়ী। আমাদের বাঙালি সমাজে ছেলেরাই সংসারের দায়িত্ব নিবে আর বোনরা নিশ্চিন্ত মনে স্বামীর সংসার করবে। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে।আপুর জন্য এ বিষয়টি অনেক দেরি হয়ে গেছে।জীবনের একটা সময়ে পরিবারের আপনজনের চেয়েও অচেনা অন্য একটা মানুষ বেশি আপন হয়ে উঠে।এটাই প্রকৃতির নিয়ম।তার ভালবাসা মায়ার টানে পিতৃকুল তখন অনেক দুরের হয়ে যায়।আর তা এমনটি না হলে পিছুটানের মায়ায় কেউ সামনে এগুতে পারতো না। আপুকে যখন রাহাত স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছিল তখন আপুকে মনে হচ্ছিল ঝড়ের দাপটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়া ভীত সন্ত্রস্ত একটা ছোট্ট পাখির ছানা। সে যেন কারো নিবিড় সান্নিধ্যের আশ্রয় খুঁজছে। আপুর চোখ দুটোতে কি যেন না বলা কথা ভীড় করে আছে। আপু কাকে যেন খুঁজে ফিরছে।রাহাত বুঝতে পারছে আপুর ভেতরে এমন কিছু ঢাকা দেয়া আছে যা সে খুব সন্তর্পনে লুকিয়ে রেখেছে। কোন ভাললাগা অনুভুতিকে আড়াল করে রেখেছে। কোন স্পর্শের অপেক্ষায় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।এমন কোন অজানা কথা যা আপু মুখ ফুটে না বললেও চোখ মুখ তা প্রকাশ করতে চাইছে!
আপুকে স্যুপ খাইয়ে টিসু দিয়ে খুব যত্ন করে আপুর মুখটা মুছে দিলো। আপুকে একটু পানি খাওয়ালো।ভাইয়ের এমন যত্ন পেয়ে শায়লা যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিল! রাহাত আপুর চুলগুলো ঠিক করে দিলো।মা হাত পা বুলিয়ে দিলো।মা কেঁদে কেঁদে আকুল হলো। যেন আরেকটু হলেই শায়লাকে সে চিরতরে হারিয়ে ফেলছিল! রাহাত নার্সকে ডেকে রাতের ঔষুধগুলো খাইয়ে দিতে বললো। ঔষুধ খেয়ে শায়লা টুপ করে ঘুমিয়ে পড়লো।সম্ভবত ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। বাসা থেকে রুহি খালা রাহাত ও মায়ের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। মাকে অনেক অনুরোধ করে রাহাত খাওয়ার জন্য রাজী করালো।নিজেও কিছুটা খেয়ে নিলো। মাকে আরেকটি বেডে রেখে কেবিনের লাইট অফ করে রাহাত বাইরের সোফায় এসে বসলো।
রাহাতের হাতে দুটো মোবাইল ফোন ধরা। একেবারেই খেয়াল করা হয়নি। একটা ফোন শায়লার। হঠাৎ মনে পড়লো সন্ধ্যায় তো আপুর ফোনে একটি মিসড কল হয়েছিল।কলটা আর ব্যাক করা হয়নি! এখন কি ব্যাক করবে? রাত হয়ে গেছে।রাত এগারোটা বেজে গেছে।এত রাতে কাউকে কল করা কি ঠিক হবে? কিন্তু কি আর করা একা মানুষ সবদিক দেখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। যদিও একজন পুরুষের জন্য এটা এমন কোন খাটুনিই না কিন্তু আপুর সেই অবস্থায় মনে হতেই রাহাতের বারবার গা শিউরে উঠছে। যদি আরেকটু দেরি হতো তবে আজ অনেক বড় একটা অঘটন ঘটে যেতো!
যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই নায়লার হাজবেন্ড মূর্শেদ চলে এসেছিল।কিন্তু সেতো আর এতদিক দেখবে না। টাকা পয়সার সব রকম আশ্বাস দিয়ে ডক্টরদের সাথে কথা বলে চলে গেলো।দেরি হলে নায়লা আবার জানতে চাইবে।তাইতো বাসা থেকে কোন খাবার আনা গেলো না। মোর্শেদ বেশ লজ্জিত হচ্ছিল বারবার। মোর্শেদ ছেলেটি খুবই ভালো।অবশ্য একটি ছেলে তখনই ভালো হবে যখন তার পারিবারিক শিক্ষাটা মজবুত হবে।
রাহাত কল দিতে উদ্যত হতেই দেখা গেলো আপুর মোবাইলটা চার্জশূন্য হয়ে আছে। এখন আর কেবিনে গিয়ে চার্জে দেয়া সম্ভব না।মা বা শায়লার ঘুম ভেঙে যেতে পারে।দুজনেরই বিশ্রাম প্রয়োজন। কিন্তু শিহাব সাহেব নিশ্চয়ই খুব চিন্তিত হয়ে থাকবেন। উনি বলেছিলেন
নিয়মিতভাবে তাকে যেন শায়লার শারীরিক অবস্থার কথা জানানো হয়।কিন্তু কি আর করা! হয়তো উনি সারারাত খবরের অপেক্ষায় থাকবে। আসলে মানুষের হাতেতো সবটার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মোবাইল নাম্বারটা জানা থাকলে রাহাতের মোবাইল থেকে কল দেয়া যেতো।কিন্তু সেটাও তো নেয়া হয়নি। আচ্ছা কাল সকালেই কথা হবে।এখন আপুর সুস্থতাই সবচেয়ে বড় কথা।রাহাত মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করে নিলো, যে করেই হউক আপুর মুখে হাসি ফোটাতে হবে।খুব দ্রুতই আপুরকে তার সংসারে পৌঁছে দিতে হবে।বিষয়টি আপুর হাতে ছেড়ে দেয়া উচিত হয়নি। রাহাত নিজের লাইফ ক্যারিয়ার নিয়ে বেশি ডুবে গিয়েছিল।যাক কোন ঘটনা না ঘটলে মানুষের সচেতনতা আসে না।তবে আপুর যদি আজ একটা কিছু হয়ে যেতো? আপুর হাজবেন্ড নোমান ভাইকে তারা কী জবাব দিতো? নোমানের কথা মনে হতেই রাহাতের মনে প্রশ্ন এলো, আচ্ছা তবে এই যে কল করছে শিহাব নামে একজন ভদ্রলোক, তবে উনি কে? কখনোতো আপুর মুখে বা কলেজ ইউনিভার্সিটি লাইফে এই নামটি শোনেনি? তবে উনি কে? কেনইবা এমন উৎকন্ঠিত হয়ে বারবার আপুর খোঁজ নিচ্ছিল। নাহ! সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগছে। ফোনটাতেও চার্জ নেই।নয়তো কল করে কথা বলে জেনে নেয়া যেতো যে উনি কে? রাহাতের মনে খটকা বেঁধে গেলো ডাক্তারদের কথাটা। রাহাতের মনে পড়লো,,, হয়তো উনি মেন্টালি কারো সাথে ইনভলভড হয়েছেন! রাহাত দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে লাগলো।আপুর অসুস্থতার সাথে তবে কি এর কোন যোগসূত্র আছে? উফ, রাহাতের আর ত্বর সইছে না।কখন সকাল হবে আপুর ফোনে চার্জ দিয়ে শিহাব সাহেবের সাথে কথা বলবে। যতটুকু কথা হয়েছে লোকটিকে বেশ ভদ্রই লেগেছে আর উনি যদি অসুস্থতার কারনই হবেন তবে নিশ্চয়ই এতবার কল করতেন না? রাহাত এই রহস্যের জালে ঘুরপাক খেতে লাগল।মনে ভেতর অনেক ভাবনা দূর্ভাবনা আর অজানা আশংকা ভর করলো।নিরুপায় হয়ে রাহাত ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় রইল৷
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much