১৬ নভেম্বর ২০২১

শামীমা আহমেদ এর ধারাবাহিক গল্প "অলিখিত শর্ত" ১৪

 স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র  নতুন ধারাবাহিক  উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"



শায়লা শিহাব কথন 
অলিখিত শর্ত 
                                              (পর্ব ১৪)
   শামীমা আহমেদ 


                                                        জ দুপুরেও প্রতি সপ্তাহের মত রান্নাবান্নার বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।রাহাতের আজ ছুটির দিন।শুক্রবারও ছুটি থাকে কিন্তু সেদিন সে হালকা খাবারে অভ্যস্ত  আর সারাদিন  শুধু ঘুমিয়েই কাটায়। আর শনিবার দিন  থাকে খানাপিনায় মনযোগ। মায়ের হাতের  বিশেষ কিছু রান্নার জন্য সে সারা সপ্তাহ অপেক্ষায় থাকে। শুকনা মরিচ দিয়ে আলু ভর্তা, ঘন মশুর ডাল,কাঁঠাল বিচি আর  ছোট চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি, পটলের টক ঝাল মিষ্টির দোঁপেয়াজা, ইলিশ ভাজা,বড় কাতলের মাথা দিয়ে মুড়োঘন্টা,ডিমের কোরমা,ঝাল করে আলু মুরগির  মাংসের  পাতলা ঝোল,গরুর মাংস ভুনা আর শায়লার হাতের কিসমিস দেয়া ঝরঝরে পোলাও, রাহাতের প্রতি শনিবারের খাবারের মেনুতে এসব থাকতেই হবে।সারা সপ্তাহ অফিস করে এই একদিন মায়ের হাতের খাবার খেয়ে মনকে চাঙ্গা করে নেয়। নতুন সপ্তাহে কাজের জন্য নিজেকে তৈরী করে নেয়া। এই একই মেনু চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।রাহাতের একটিই কথা মা আর শায়লা আপুর হাতের এই রান্না ছাড়া আর কিছুই তার মুখে রুচে না। রাহাত শায়লার খুবই আদরের ছোট ভাই।খুবই বাধ্যগত একটি ছেলে।শায়লা ভাবে কতজনের ভাইয়েরা কতভাবে বখে যায়, চালচলনে উশৃংখল হয়, আচার ব্যবহারে বেয়াদব হয়, সঙ্গদোষে  মাদকাসক্ত হয়,মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে  কিন্তু শায়লার এই আদরের ভাইটাকে যেভাবে শায়লা গড়ে তুলতে চেয়েছে ঠিক তেমনটিই হয়েছে।শায়লার সব  কথা শুনেছে। বাবার শূন্যতাটা তাকে একেবারেই বুঝতে দেয়া হয়নি।খুব লক্ষী একটা ছেলে! ওর একই কথা, আপু কানাডায় চলে গেলে কে এত মজার মজার খাবার রান্না করে খাওয়াবে? শায়লা বলেছে  শীঘ্রই তোমার জন্য নতুন রাধুনীর খোঁজ করছি।তাকে সব শিখিয়ে দিবো।কিন্তু রাহাত চাইছে আপুর কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ হলে তবেই তার নিজের ব্যাপারে ভাববে।
খাবার শেষে মায়ের হাতের ঘন দুধের পায়েশের স্বাদ একেবারে সাতদিন মুখে লেগে থাকে। রাহাত অফিসে নিয়ে কলীগদেরও তা খাইয়েছে।সবার সেকি প্রশংসা! অবশ্য শায়লা মাকে রান্নাঘরে যেতেই দেয় না। চুপি চুপি নিজেই সব রান্না করে রাহাতকে জানায়, মা রান্না করেছে। শায়লা এত সুনিঁপুণ রান্না করে রাহাত একেবারেই তা ধরতেই পারে না। শায়লা রান্নায় মায়ের হাতটা পেয়েছে। 
মা আর শায়লা দু'পাশে বসে খুব যত্ন করে রাহাতকে খাওয়ালো। আমাদের সমাজে ছেলে সন্তানদের কদরই আলাদা! মেয়েরা যেদিন অর্থনৈতিকভাবে  আর পূর্ণ নিরাপত্তায় সমাজে চলতে পারবে সেদিনই এই বৈষম্য ঘুচবে।এ সময়ে কিছুটা অর্থনৈতিক মুক্তি মিললেও সামাজিক নিরাপত্তার কারণে আজো একটি মেয়ে পুরুষের সমান হতে পারেনি। রাত বিরাতে প্রয়োজনে বেরুতে হলে একটা ছেলে সন্তানের প্রয়োজন ভীষণভাবে অনুভব করতে হয়। 
বেশ  তৃপ্তি নিয়েই দুপুরের খাওয়া পর্ব শেষ করল রাহাত। আজ সন্ধ্যায় একটু বেরুবে।কলেজ ফ্রেন্ডদের সাথে একটা মিট আছে। ওরা সব উত্তরায় একই স্কুল কলেজ রাজউকে পড়েছে। আজ সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। শায়লারও নিজের ভাইকে নিয়ে গর্ব হয়।বাবা না থাকলেও সে তার ভাইকে মানুষের মত মানুষ করেছে।
দুপুরে মা একটু বিশ্রাম নেয়। শায়লা সবকিছু গুছিয়ে কাজের বুয়া রেনুর মাকে বক্সে খাবার দিল। ওরা কখনোই এখানে খায় না। বাসায় বাচ্চাদের রেখে আসে।যেটুকুই পায় তা সাথে করে নিয়ে যায়।
রেনুর মাকে বিদায় করতে গিয়ে শায়লা দরজা লাগাবে এরই মধ্যে নীচতলার রুহি খালাকে সিঁড়িতে দেখতে পেলো। শায়লার সাথে হাসি বিনিময় করে ওদের বাসায় ঢুকলো। মায়ের আর রেস্ট নেয়া হবে না আজ।এই যে এলো, গল্প শুরু হবে চলবে  সন্ধ্যা মাগরিব পর্যন্ত। শায়লা নিজের ঘরে চলে এলো।
শায়লা সেই যে সকালে রান্না ঘরে ঢুকেছিল, তখন থেকে মোবাইল ঘরেই পড়েছিল।হাতে নিয়ে চেক করতেই দেখা গেলো শিহাব সাহেবের মেসেজ।  তাও প্রায় আধ ঘন্টা আগের।এখন তিনটা তিরিশ বাজছে। শায়লা মেসেজ ওপেন করলো।
লাঞ্চ করেছেন?
শায়লা নিজের ঘরের দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় এলো। শায়লার বিছানার সাথে জানালা।এই নগর জীবন শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার বিলাসিতা!
শায়লা মেসেজের উত্তর দিলো
হ্যাঁ, এইতো লাঞ্চের পর আনুসাঙ্গিক সব সেরে এলাম।আপনি লাঞ্চ করেছেন? ভাবী আজ কি রাঁধল? 
কোন উত্তর এলো না।শায়লা অপেক্ষায়।
বিচ্ছিন্ন কিছু ভাবনায় মন চঞ্চল হয়ে উঠল !
টুং করে রেসপন্স এলো।
সেইতো কখন লাঞ্চ সেরেছি। এখন চায়ের তেস্টা পেয়ে গেছে।এক মগ লেবু চা করে নিয়ে এলাম। 
বাহ! লেবু চা আমারও খুব প্রিয়।
শিহাব একটু জ্ঞান ঝাড়ল,
---তবে লেবু চা খাবেন লাঞ্চের পর ভরা পেটে।কখনোই সকালে নয়।
হু, শায়লা আবার সেই প্রশ্নটি রাখল
ভাবী কী রাঁধল আজ?
শিহাবের সরল উত্তর
ভাবী নেই, আমিই রাধুনি।
শিহাব শায়লাকে দ্রুতই খুব আপন করে  নিয়েছে।তাই সে আর শায়লাকে কথার লুকোচুরিতে রাখতে চাইল না।যেটা সত্য সেটাই জানালো।তবে সব নয়।এখুনি নয়।শায়লা ভাবতে পারে সিঙ্গেল সেজে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য গল্প ফেঁদেছি।
ভাবী নেই কেন?
সে গল্প আরেকদিন বলবো।
আপনি এখানে একাই থাকছেন?
হ্যাঁ, আমার একার সংসার।
এবার শায়লার একটু চাপা আতঙ্ক কাজ করলো মনে! লোকটি কি তাহলে খারাপ কেউ যে বউ চলে গেছে কিংবা সংসার গ্রামে রেখে এসে বলছে ব্যাচেলর?
শায়লা একটু শংকিত হলো। কথা কি আর চালিয়ে যাবে?কিন্তু মনের ভেতর কোথা থেকে যেন একটা ভালোলাগা ঢেউ বয়ে গেল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ং বিধাতাই সিদ্ধান্ত নেয়ার বুদ্ধিমত্তাটা তৎক্ষনাৎ দিয়ে দেন।ভেবে নিল, না সেতো কোন ভনিতা করেনি।পরিচয়ের দুদিনের মধ্যেই সত্যটা বলেছে।এখন ইচ্ছেটা আমার কথা বলবো কিনা?
শায়লা সহজভাবেই জানতে চাইল, তা কী কী রাঁধলেন? 
কী কী? নাহ, এভাবে মেনু হিসেবে নয়,সহজ উপায়ে যা করা যায় সেরকম একটা কিছু।
তা কতদিন যাবৎ এই জীবন চলছে?
তা প্রায় তিন বছর।
তিন বছর? ভাবী কি অভিমান করে আছে, তাহলে তাকে মান ভাঙিয়ে নিয়ে আসুন। 
এবার শিহাব একটুক্ষণ চুপ থেকে লিখল--
আচ্ছা এ প্রসঙ্গটা কি এখন বন্ধ রাখা যায়?
শায়লা খুবই লজ্জিত বোধ করলো।
লিখলো, অবশ্যই।
শিহাব জানালো, আজ বিকেলের পর সন্ধ্যায় একটি বেরুবো। বন্ধুদের সাথে একটু চা পানের আড্ডা আছে।
শায়লা এবার ভীত হয়ে গেলো!ভাবলো, আবার হোটেল বারে যাওয়ার অভ্যাস টভ্যাস আছে নাকি? কি জানি লোকটির গতিবিধিতে আমার ভয়ই লাগছে।
কি হলো চুপ কেন? 
না আপনি বলুন শুনছি।
আজ কী কী রাঁধলেন? ভাই সাহেব কেমন বাজার করেন? 
শায়লা কথাটা প্রথমে বুঝতে পারেনি,আর যখন বুঝলো, হাত ফস্কে লেখা হয়ে গেলো
ভাইকে কোথায় পাবো?
মা আর ছোট ভাইকে নিয়েই আমার এইসব দিনরাত্রি।
কেমন করে যেন সত্যটা বলা হয়ে গেলো।
আসলে মিথ্যে দিয়ে কোন সুন্দর সম্পর্ক হয় না।সে যদি 'সততায় শিহাব' হতে পারে আমি কেন তবে 'সত্যবাদী শায়লা' হতে পারবো না?
পাশের ঘর থেকে মায়ের ডাক ভেসে এলো।
নিশ্চয়ই রুহি খালার পানের ডাব্বা আনতে হবে তার বাসা থেকে।
শায়লা শিহাবের কাছে একটু সময় চেয়ে নিলো।
শিহাব জানালো তবে এখন আর না।রাতে কথা হবে।বন্ধুর কল এসেছে।
ঠিক আছে বলে শায়লা দরজা খুলে ঘর থেকে বের হলো। 



                                                                                 চলবে.....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much