০৯ জানুয়ারী ২০২২




শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৫১)
শামীমা আহমেদ 

রিশতিনার প্রশ্ন শুনে বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে শিহাব বললো,
---আমি ভালো আছি। তা তুমি হঠাৎ দেশে?
---হ্যাঁ, এসেছি একটা জরুরী প্রয়োজনে।শিহাব তুমি সত্যি করে বলো কেমন আছো?
রিশতিনা এই নিয়ে তিন তিনবার জানতে চাইল, শিহাব কেমন আছে।কিন্তু কেন এই জানতে চাওয়া? সেতো অন্য একটি জরুরি কাজে দেশে এসেছে।শিহাবের জন্যতো নয়!
চার চারটি বছর শিহাবের কিভাবে দিন হয়েছে, রাত কেটেছে, কতটা যন্ত্রনায় অপমানে ক্ষোভে তার প্রতিটি প্রহর কেটেছে।তার হিসেব কি আর এই এক মূহুর্তে দেয়া সম্ভব?
শিহাব নিজেকে বেশ শক্ত করে নিয়ে বললো,তুমিই বলো কেমন থাকতে পারি?
রিশতিনা এক মূহুর্তও অপেক্ষা না করে বলে উঠলো, আমি জানি আর এই সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী। সে আমি ভীষণভাবে বুঝতে পারি। নিজের উপর আমি নিজেই দোষারোপ করি। সেদিন যদি,,,
----থাক সেসব কথা।
কেন থাকবে শিহাব?তোমারতো কোন দোষ ছিলনা। আমিই তোমার জীবনটা ওলোট পালোট করে দিয়েছি।
--আচ্ছা এখন রাখতে চাইছি।আমাকে আর কল না দিলে খুশি হবো।
রিশতিনা যেন এ কথাটি একেবারেই আমলেই নিলো না।
সে বলেই চললো,,,তুমি তো এখন উত্তরা থাকো।সেক্টর ১৩ তে বাসা।কুশল সেন্টারে অফিস।গাজীপুরে ফ্যাক্টরি,, সবাই জিগাতলায় থাকলেও তুমি একাই এখানে থাকছো।তোমার সেই বাইকটা এখনো আছে।শীত গ্রীষ্মে,ঝড় বৃষ্টি জল ঝড়ে চলার সঙ্গী হয়ে আছে। শুধু জানিনা,সেখানে কোন নতুন
যাত্রী সঙ্গী হয়েছে কিনা? 
---এত কিছু তুমি কেন বলছো?রিশতিনা,তুমি তোমার নতুন জীবন নিয়ে সুখে থাকো।আমি এখন রাখতে চাইছি।
রিশতিনার থমথমে কন্ঠে বুঝাই যাচ্ছে ও প্রান্তে রিশতিনার ভেতরেও অনেক জমানো কথার ভার।অনুরোধের সুরে বললো,
শুধু আরেকটা কথা বলবো,
কী বলবে?
রিয়াজ কেমন আছে?
রিয়াজ?রিয়াজ কে? শিহাবের কন্ঠে যেন রাজ্যের বিস্ময়! 
আমাদের ছেলে।আমি তো তাকে আপন করে পেলাম না।আমার নামের সাথে মিলিয়ে আমি ওকে রিয়াজ নাম দিয়েছি।
সে তোমার ইচ্ছে। শিহাব চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,তুমি আমার এত খোঁজ খবর কিভাবে পেলে? আর কেনইবা তা রাখছো।
সবই তো শেষ, কেন এত আগ্রহ আর?
---রোমেল ভাইয়ার কাছ থেকে আমি নিয়মিত  তোমার খোঁজ খবর নিয়েছি।তোমার ভাল মন্দে দূর থেকে হলেও শুভকামনা করেছি।
রোমেল? আমার বন্ধু রোমেল? শিহাবের বিস্ময়ের সীমা রইল না!
হ্যাঁ, রোমেল ভাইয়া।সে আমার কাজিন। সে আমাকে সবসময় তোমার খবর জানিয়েছে।
----তোমার এটা করা ঠিক হয়নি।তোমার লেখাপড়ায় ক্ষতি করে।
রিশতিনা বুঝতে পারে শিহাবের অভিমানটা অনেক গভীরে। রিশতিনার তাইতো সহজ স্বীকারোক্তি, 
শিহাব,আমি তোমাকে এখনো ভুলতে পারিনি, পারবোও না কোনদিন।
কিন্তু তোমার এটা ঠিক হচ্ছে না রিশতিনা।
আমি এখন রাখবো।তুমি আমাকে আর কল দেবে না।
একটা কথা ছিল।
শিহাব যেন শুধুই শুনে যাওয়ার জন্য বললো,
কি কথা আবার?বলো,
আমি তোমার সাথে দেখা করে তা বলতে চাই।যক্স
শিহাব নিজেকে ভীষণভাবে সংযত রেখে শুধু বললো,সেটা সম্ভব নয়।
কেন নয়? আমি এক সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছি।তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
রিশতিনার সাথে কথা বলায় শিহাব যেন বারবার শায়লার কাছে অপরাধী হয়ে যাচ্ছে।
তার অনেক কষ্টের রাত পেরিয়ে আজ শায়লার কাছে থিতু হতে চাওয়া।শায়লাকে আপন করে আগামীর স্বপ্ন বোনা। শিহাব তবুও কথস চালিয়ে যাচ্ছে।
তুমিতো আমাকে একা ফেলে গিয়ে  দূর থেকে আমার সব খোঁজই নিয়েছো।আমার মনের কষ্টের কতখানি লাঘব করতে পেরেছো তাতে?
শিহাব আমি পরিস্থিতির স্বীকার।আমি তোমাকে সব খুলে বলবো।আমি শুধু একটিবার তোমাকে দেখতে চাই।শুধু 
একটিবার।এই জীবনে আর কোনদিন তোমাকে বিরক্ত করবো না।
কাল দুপুরে আমি গুলশানের ফোর সিজন্সে লাঞ্চে অপেক্ষায় থাকবো।
হঠাৎই মেসেঞ্জারে শায়লার কল বেজে উঠলো।রিশতিনার কথায় ছেদ পড়লো। 
ওপ্রান্তে রিশতিনা বলেই চলেছে,,
শিহাব, আমাদের ভালবাসা, আমাদের সন্তানের কসম দিয়ে বলছি,আমি এই একটিবার শুধু তোমাকে দেখবো। তোমাকে দেখার জন্য আমার প্রাণটা জিইয়ে রেখেছি।
তুমি আসবে আমি অপেক্ষায় থাকবো।
বলেই রিশতিনা শিহাবের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ফোন কেটে দিলো।
শিহাব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো।খুব অল্পদিনের হলেও রিশতিনা তার বিবাহিত স্ত্রী, তারই সন্তানের মা।এটাতো অস্বীকার করার উপায় নেই। বৈধ মতেই তাদের বিয়ে হয়েছিল।যদিও রিশতিনার বাবা তা মেনে নেয়নি বলে আজ তারা বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাচ্ছে।তার প্রতি রিশতিনার সেই আবেগতো আগের মতই আছে।তাতে সাড়া দেয়া কি অন্যায় হবে?
আইনগত ভাবে ভাবলে তারতো পূর্ণ অধিকার আছে তার প্রতি, তার সন্তানের প্রতি।
সাথে সাথে আরাফের মুখটা ভেসে উঠলো! মনে হলো,কে যেন আরাফকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে! শিহাব পাশে থাকা বালিশখানি আঁকড়ে ধরলো। 
মেসেঞ্জারে বারংবার শায়লার কল আসছে।শিহাবের মনের ভেতর রিশতিনার অতীত স্মৃতি আর আজকের কথাগুলো কেমন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।কিছুতেই সে স্বাভাবিক হতে পারছে না।মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে চড়ে সে সেই ঝিগাতলার দিনগুলোতে ফিরে গেছে আবার একটু আগে রিশতিনার কথাগুলো কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।শিহাব দুই হাতে কান চেপে ধরলো।সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো!  উফ! কি অসহ্য যন্ত্রণা!  একদিকে সদ্য বিয়ে হওয়া দুজনার বিচ্ছেদ,এরপরই সন্তান আগমনের খবর! রিশতিনার বাবার বাড়িতে বন্দী জীবন।শিহাব এক নিদারুন গোঙানিতে সারারাত ছটফট করেছে।ক্রুদ্ধ রিশতিনার বাবা তাকে যে কোন মূহুর্তে এরেস্ট করানো হুমকি।শিহাবের  মায়ের ছেলের দুশ্চিন্তায় শয্যাশায়ী হয়ে যাওয়া।মায়ের প্রাণ বাঁচাতে শিহাব তার জীবনের সব অন্যায় মেনে নেয়।
শুধু আরাফকে পেয়ে সে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন খুঁজে পায়।
একের পর এক আঘাতে শিহাব পুরোনো পরিবেশ ছেড়ে উত্তরায় চলে এসে সবকিছু ভুলে থাকবার চেস্টা করছিল।প্রতিটি বিকেল সন্ধ্যা তার একাকীত্বের সাক্ষী হয়ে আছে। কোন অনৈতিক সম্পর্কে সে জড়ায়নি।ভদ্র ঘরের সন্তান হওয়ার কারণে একার জীবনেও সমাজে নিজেকে ভালো প্রমান করতে হয়েছে।
মেসেঞ্জারে শায়লার কল বেজেই যাচ্ছে।একটার পর একটা দীর্ঘ রিংটোন। 
শিহাব অবচেতন মনে হাত বাড়িয়ে শায়লার কলটা রিসিভ করলো।
ওপ্রান্তে শায়লা শিহাব,শিহাব করে ডেকেই যাচ্ছে।শিহাবের কানে যেন কিছুই পৌছাচ্ছে না।
শায়লা অস্থির হয়ে উঠলো!সে বলেই চলেছে,শিহাব তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো?কল রিসিভ করছিলে না কেন? কথা বলছো না কেনো? তুমি কি অসুস্থ? 
শিহাবের নীরবতায় শায়লা ছটফট করতে লাগলো।বেশ অনেকক্ষন পর শিহাব কথা বলে উঠলো। 
না মানে হ্যাঁ, একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঠিক আছে।ঘুমিয়ে পড়ো।আমি রাখছি।
না শায়লা,না তুমি রাখবে না,তুমি যাবে না,তুমি আমার পাশে থাকো।তুমি পাশে থাকলে আমার ভালো লাগে।শায়লা বেশ অবাক হলো!
মনে হচ্ছে শিহাব কেমন যেন ভীত সন্ত্রস্ত। মনে হচ্ছে সে কোন অন্ধকার যায়গায় একা দাঁড়িয়ে আছে।শায়লাকে সে পাশে পেলে ভরসা পাবে।
শায়লা বুঝতে পারছে না,এমন  আবেগহীন কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শিহাব কেন এসব বলছে?
শায়লা কথা দাও,আমাকে ছেড়ে তুমি কোনদিন যাবে না।আমার আরাফকে তুমি বুকে আগলে রাখবে। 
শায়লা বুঝতে পারলো অতীত নিয়ে শিহাব ভীষণ ভেঙে পড়েছে।শায়লা বুঝে নিলো শিহাবকে এগুলো থেকে বের করে আনতে হবে।
শায়লা শিহাবকে আস্বস্ত করতে চাইল।তাকে শান্ত করতে সে এই প্রথম শিহাবকে ভিডিও কল করলো।
শায়লাকে দেখে শিহাব একটু শান্ত হলো। শায়লা বলেই চলেছে,তুমি মন খারাপ করোনা।আমাকে আরাফের কাছে নিয়ে চলো।দেখো আমি কেমন করে তাকে আপন করে নেই।
শায়লা ভাবলো,আমরা কেবল মাতৃস্নেহের কথাই জানি,একজন পিতাও যে সন্তানের হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে কতটা ভীত হয়ে উঠতে পারে,শিহাবকে দেখলে তা বুঝা যায়।
শিহাব কেমন যেন আদুরে গলায় বলছে,শায়লা তোমার কোলে মাথা রেখে আমার ঘুমাতে মন চাইছে।তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছো।আমি পরম নিশ্চিন্তে তোমার মাঝে সবটুকু নির্ভরতায় সারারাত ঘুমিয়ে থাকতে চাই। শায়লা,কবে আমার এই কাঙ্ক্ষিত রাতটি আসবে? তুমি আমি সারারাত গান শুনবো।দুজনে গল্প করবো।তুমি আমার হাতটি ধরে রাখবে শক্ত করে। আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই একটু একটু ঘুমাবো।আর চোখ মিটমিট করে তোমাকে দেখবো।
শিহাবের কথাগুলো শুনে শায়লার চোখ জলে ভরে উঠলো। এমন স্বপ্নতো সেও দেখে।তাইতো,কবে আসবে তাদের এমন দিন? 
শিহাব  নিজেকে বুঝাতে পারছে না,কিভাবে আজকের এই রাতটা কাটবে।রিশতিনা বারবার তার স্বাভাবিক জীবনকে এলোমেলো করে দেয়।আর শায়লা বারবার তা গুছিয়ে দেয়।
শিহাব খুব কঠিনভাবে মনকে জানিয়ে দিলো,কোনভাবেই  রিশতিনার সাথে সে দেখা করবে না। নয়তো আবার না জানি কোন
ঝড় এসে শায়লাকে নিয়ে সাজানো স্বপ্নটা তছনছ করে দেয়। এমন ভাবনায় শিহাব নিযেকে একটু স্থির করে নিলো। হঠাৎই একটা মেসেজের শব্দ! 
শিহাব তাকাতেই দেখলো, শায়লার একটা খুব সুন্দর ছবি শিহাবের মেসেজে ঢুকলো। বিকেলের আলোতে শায়লাদের বাড়ির ছাদে তোলা।খোলা চুলে কাজল আঁকা চোখে একটা হলুদ শাড়িতে বিকেলের সূর্যের আভায় শায়লাকে যেন  একটি অপ্সরীর মত লাগছে!
হঠাৎ কোন অবাক করা কিছু দিয়ে যেমন ছোট্ট শিশুদের কান্না থামানো যায়,শায়লার ছবিটাতেও শিহাব যেন তেমনি আগ মূহুর্তে এতকিছু ঘটে যাওয়া নিমেষেই ভুলে গেলো! মুগ্ধ হয়ে সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল।শিহাবের চোখে মুখে যেন এক আলোর দ্যুতি খেলে গেলো!শিহাব চট করেই মোবাইলটায় চুমু বসিয়ে দিলো আর বলে উঠলো,,, শায়লা, আই লাভ ইউ,,আই লাভ ইউ আ লট!
শিহাবকে শান্ত করতে পারায় শায়লার মাঝেও স্বস্তি ফিরে এলো।শায়লা একগাদা লাভ রিএক্ট পাঠিয়ে গুড নাইট জানালো।
আজ রাতের মত বেঁচে থাকার অবলম্বন পেয়ে শিহাব যেন হালকা পালকের মত হয়ে উত্তাল  সাগরেও স্বপ্নডিঙায় ভাসতে শুরু করলো।


 চলবে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much