০৩ ডিসেম্বর ২০২০

শ্রীমতি মমতা রায় চৌধুরী'র গল্প



রিপূর্ণা


দূর হয়ে যা। অন্য লোক দেখে নেব। মিনাদেবীর চিৎকার শুনে পূর্ণা ছুটে এসেছে দোতলায়। ফুলি বলছে আগে আমার কথাটা তো শুনবা গিন্নি মা। কোলে ছোট বাচ্চা মেয়েটি ওই ধমকে কান্না জুড়ে দিয়েছে। পূর্ণাকে দেখে একগাল হেসে কোলে যাবার জন্য ঝুঁকে পড়েছে। ফুলি তো মেয়েটাকে রাগের বশে দিয়েছে এক চড় বসিয়ে। কোলে যাইবো,কাজই চইলা যাইবো আর কোল খুঁজতেছে। পূর্ণা বলল -আহা ফুলি বাচ্চা মেয়েকে কেউ এভাবে..... দাও আমার কাছে দাও। মিনাদেবী তো আরো রেগে আগুন। ওই যে আর একজন হয়েছে কাজের মেয়ে সোহাগী। বাজা মেয়েমানুষ, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে। কটুক্তি করে ফুলিকে আরেকবার শাসিয়ে বললেন- এরপর থেকে কাজে দেরি হলে একেবারে বিদেয় করে দেব। ফুলি তো কাঁদতে লাগলো। পূর্ণা সান্ত্বনা দিয়ে বলল -তুই তো জানিস মা ওরকম, তাহলে এত দেরি করে আসিস কেন? না গো বৌদি ,আজকে আমার বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটছে, এর লায়গাই তো, বলে চুপ করে যায়। পূর্ণা বলে -কী হয়েছে রে? বরের সাথে আবার ঝগড়া করেছিস? হ,কেন? তুমি তো জানো বৌদি ওই যে পাশের বস্তিতে পুটি আমার বরের মাথাটা খাইলো। আচ্ছা কও তো আমার কিসে কমতি আছে? চারডা পোলাপানের জন্ম দিছি। আর কি চাই? পুরুষ মানুষগুলার আসলে এক খাবারে ওগো পোষায় না। পূর্ণা আর কথা বাড়ায় না। ঠিক আছে তুই কাজ কর। লক্ষী আমার কাছে থাকুক। ও বৌদি,একটা কথা কমু। আমার মাইয়াডারে লইবা তুমি। তোমারে তো কত ভালোবাসে। দেখো, তোমার কাছে গেইলে আমার কাছে আসতেই চায় না। আর বাড়িতে গিয়া তো সারাক্ষণ বড়মা বড়মা। তুই যে কী বলিস না ফুলি, নিজের বাচ্চাকে  কেউ অন্যের কাছে দেয়। আমি সত্যি কইতাছি, তোমার কাছে থাকলে আমার লক্ষ্মী মানুষ হইয়া যাইবো। আমার তো আরো তিনডে বাচ্চা আছে? তোমার তো, বলেই থেমে যায়। পূর্ণার চোখে জল এসে যায়। সত্যি ,ভগবানের কী বিচার।যারা খেতে দিতে পারে না তাদের ঘরে এতগুলো বাচ্চা। আর যাদের সব আছে ,তাদের ঘরে শূন্যতা। এত বছরের বিবাহিত জীবনে এই শূন্যতা নিয়ে পূর্ণার জীবন কাটছে। সে ভাবতে থাকে ভবিষ্যৎটা কী তার এইভাবে অবলম্বনহীন শূন্যতায় ভেসে যাবে?এজন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে কম কটুক্তি তো তাকে শুনতে হয় না?কিন্তু তার স্বামী শংকর, পূর্ণাকে বোঝে । বলে,- এই নিয়ে  দুঃখ করো না। সংসারে সবাই সবকিছু পায় না। ভগবান যা চাইছেন ,তা ভালোর জন্যই করছেন। বরং যতবার পূর্ণা তার স্বামীকে বলেছে, তাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে। তাতে অন্তত তার সংসারে পরিপূর্ণতা আসবে। কিন্তু শংকর বলেছে আমি তোমাতেই পরিপূর্ণ, আমার কিচ্ছু চাই না। ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছিল। পূর্ণার বাবা-মা মেনে নেয়নি এত বছরেও। বাবার বাড়ি বড়লোক ছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল মেয়েকে কোন সরকারি ভালো চাকরি দেখে বিয়ে দেবেন। তাই ব্যবসায়ী ছেলেকে মেনে নিতে পারেন নি। আর শঙ্করের মা চেয়েছিলেন ছেলেকে মোটা টাকার বিনিময় বিয়ে দেবেন। তারা আরও দুটি ছেলের মোটা অংকের টাকা নিয়ে বউ ঘরে এনেছেন। তাই তাদের কুটোটি নাড়তে হয় না। অথচ পূর্ণাকে প্রায় সবকিছুই করতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও জয়েন্ট ফ্যামিলিতে শংকর কিছু করতে পারে না। অনেক সময় শংকর বলেছে-চলো তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকি। কিন্তু পূর্ণা রাজি হয়নি। সে বলেছে একদিন তার মা ঠিকই তাকে মেনে নেবেন।এইসব ভাবতে ভাবতেই ফুলিকে চা আর জলখাবার দিয়ে দেয় আর লক্ষ্মীর জন্য দুধ গরম করে দেয়। যদিও শাশুড়ি মা এর জন্য প্রচুর কথা শোনান। কিন্তু সে নীরবে এ কাজ করে যায়। শাশুড়ি মা এত কিছু করার পরেও লক্ষ্মীকে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত করতে পারেন নি। হাল ছেড়ে দিয়েছেন। ফুলির কাজ হয়ে গেলে লক্ষীকে নিয়ে চলে যায়। এরপর সে রান্না-বান্না সেরে সকলকে খাবার দিয়ে নিজের ঘরে নিজেকে একাকী পাবার জন্য ভাবতে থাকে।আজ দুদিন হল শংকর বাড়ির বাইরে ব্যবসার কাজে গেছে।আজকে তার ফেরার কথা।তাই সে ভাবতে থাকে আজকে সে নীল রঙের শাড়িতে ভালো করে সেজেগুজে থাকবে কারণ শংকর যতবার বাইরে থেকে আসে ততবার  পূর্ণাকে তাদের প্রথম দিনের শারদীয় সোনালী রোদ্দুরে নীল শাড়িতে প্রথম দেখেছিল। সেইরূপে এসে বারবার তাকে দেখতে চায়। বিয়ের এত বছর পরেও তাই এইটুকু চাওয়া বদলে যায়নি। আর শংকর গোলাপ ফুল আর জুঁই ফুলের মালা নিয়ে এসে পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে।এতকিছুর মধ্যেও এই উষ্ণতাটুকুই যেন তাদের বারবার আরো রোমান্টিক আরো কাছাকাছি এনে দেয়। পূর্ণা শংকরের জন্য সেই ভাবেই ধরা দেয়। আজ তার একটু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ফুলির কথাতে। সে ভাবছে একবার বলবে শংকরকে লক্ষীকে দত্তক নেয়ার কথাটা। কিন্তু কী ভাবে বলবে? আদপে কি মেনে নেবে? তারপর তার বাড়ির লোকজন ?এই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে দিতে থাকে আর শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করতে থাকে সকলকে ভাল রাখার জন্য। এমন সময় শংকর আসে কিন্তু শঙ্করের মধ্যে সেই উৎফুল্লতা নেই,কেমন যেন একটা চিন্তার পাহাড় নিয়ে বাড়িতে এসেছে। তার সামনে সহাস্যে নীলাভ শাড়িতে পূর্ণা। সে শুধু  হেসেছে কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণবন্ততার অভাব। পূর্ণা ভাবে তার সেই প্রিয় জুঁই আর গোলাপ ফুল কোথায়? কিন্তু মুখে কিছু বলে না। বরাবরই পূর্ণা একটু মুখচোরা। সে শংকর এর জন্য কফি নিয়ে আসে। শংকর কফি খেয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে যায়। পূর্ণার মনের বালুচরে হাজারো মেঘ এসে জড়ো হয়। মন ভালো করার জন্য কবিতার বই বের করে পড়তে থাকে। রাত্রিতে সকলের খাবার দাবার শেষ হলে শংকর বাড়িতে আসে। পূর্ণা তাকে খাওয়ার কথা বললে, সে বলে খেয়ে এসেছে। এই প্রথম ব্যতিক্রম পূর্ণাকে ছাড়া শংকর বাইরে থেকে খেয়ে আসে। পূর্ণা ভীষন কষ্ট পায়।মনে পড়ে  কলেজ লাইফের কথা।শংকর ওদের কলেজের সিনিয়র ছিল। প্রথম প্রপোজ করেছিল শংকর কলেজের সোশাল এর দিন। তখন হয়ত তাদের ভেতরে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে নি কিন্তু আস্তে আস্তে ছোট ছোট সহযোগিতা অনার্স ক্লাস শেষে গাড়ি না পেলে শংকর দায়িত্ব নিয়ে, নানা প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে পূর্ণাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া এসব করেছে।এরপর আস্তে আস্তে দুজনে কাছাকাছি আসে। গড়ে ওঠে ভালোবাসা। তারপর শংকর পারিবারিক ব্যবসার কাজে ঢুকে যায় আর পূর্না ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। কিন্তু শংকর মাঝেমাঝে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সঙ্গে দেখা করে এসেছে। এরপরই পূর্ণার উচ্চশিক্ষা শেষ হলে দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কিন্তু আজকে পূর্ণার মনে হচ্ছে তার এই পৃথিবীতে শুধু সে একা সেখানে শংকর কোথায়? অভিমানের ঘন মেঘ তার মন আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সকাল হলে সে উঠে দেখে তার বিছানার পাশে রাখা জুঁই ফুলের মালা আর গোলাপ ফুল। কিন্তু শংকর কোথায়? তাকে না বলে সে তো কোথাও বেরোয় না? পরে একটা চিরকুট লেখা দেখে তাতে লেখা আছে- চিন্তা করো না ,তুমি ঘুমাচ্ছিলে। তাই তোমাকে ডাকি নি। একটা বিশেষ কাজে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। পূর্ণা খুশিতে মন আকাশে ভেলা সাজিয়ে পাড়ি দিতে চাইছে অনেক অনেক দূর। এমন সময় বৌদি বলে ফুলি ডাকতে শুরু করে। ফুলির ডাকে সাড়া পেয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ফুলিকে বলে- কীরে আজ এত সকালে? ফুলি বলে- দুদিন ছুটি নেব।লক্ষীকে একটু রাখবে তোমার কাছে? সে রেখে যা কিন্তু ও কী রাত্রিতে থাকতে পারবে? হ্যাঁ পারবে। এরপর তো একা একাই থাকবে? কী বললি? কই কিছু না তো। শোন আজকের কাজ করবি তো? ফুলি বলে হ্যাঁ। তবে যাবার আগে ছুটি নেওয়ার কথা মাকে জানিয়ে যাস। ওরে বাবা, শুনেই তো মাথা খারাপ হয়ে যাবে? ঠিক আছে। লক্ষ্মীকে দুপুরের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে পূর্ণা । পূর্ণা লক্ষ্য করেছে লক্ষ্মী কি সুন্দর নিশ্চিন্তে আঁচল ধরে ঘুমোচ্ছে। পূর্ণা লক্ষীকে ঘুমন্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ আদর করল আর ভাবতে লাগলো এরকম লক্ষ্মী তো তারও হতে পারত? এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে শংকর ফিরে আসে এবং বলে একটা খারাপ খবর আছে। পূর্ণা বলে কী খবর। ফুলির অবস্থা ভালো নয়। ফুলিকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। কেন? ফুলি সুইসাইড এটেম করেছে। সে কী কথা? কেন? কী জানি ওদের মধ্যে কি হয়েছে? ওর বর নাকি আজকে প্রচন্ড মেরেছে। আমি হসপিটালে যাচ্ছি। শংকর বেরিয়ে গেলে পূর্ণা ভাবতে থাকে সত্যিই ফুলির যদি এদিক সেদিক হয়ে যায়, তাহলে কী হবে লক্ষ্মী আর অন্য বাচ্চাদের? ভাবতেই যেন চোখের সামনে বাচ্চাগুলোর দুর্দশার চিত্র জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে কিছুতেই স্থির হতে পারছে না।এদিকে শংকরকে ফোন করছে,ফোন ও ধরছে না। পাঁচতলা ফ্লাটের উজ্জ্বল সোনালী রোদ এসে পড়েছে ।এখনো অন্ধকার হতে বাকি আছে । পূর্ণার অজানা আতঙ্ক ও  ক্লান্তিতে শরীর যেন অবশ হয়ে আসছিল। ঠিক এই সময় শংকর পূর্ণাকে সেই খারাপ খবরটি জানায়। লক্ষ্মীকে পূর্ণা জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নেয়। চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকে। লক্ষী কচি দুহাতে তার চোখের জল মুছে দেয় আর বলে বড়মা কাঁদছো কেন? আমি আছি তো। কেঁদো না। রাত নটায় শংকর বাড়ি আসে এবং ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নেয়।তারপর নিজের ঘরে চলে আসে। পূর্ণা সব কাজ শেষ করে যখন রুমে আসে।তখন দেখে শংকর লক্ষীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর পূর্ণাকে কাছে টেনে নেয় আর বলে এরপর কী হবে এই বাচ্চাটার? পরের দিন লক্ষীর বাবাকে খবর দিলেও সে আসে না।এভাবে পাঁচ দিন কেটে গেলে, শংকর লক্ষ্মীদের বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে লক্ষ্মীর কথা বললে ,সে জানায়- লক্ষ্মীকে কোন হোমেটোমে দিয়ে দেওয়া হবে। অন্য বাচ্চাগুলোর করুণ অবস্থা দেখে শংকর বলে, ঠিক আছে ।হোমে দিতে হবে না ।লক্ষ্মীকে আমরা দত্তক নেব। লক্ষ্মীর বাবা বলে- তাহলে তো বেঁচে যাই। লক্ষ্মীর বাবার অদ্ভুত হাসিতে শঙ্করের মনে হল এই লোকটি বাবা হবার যোগ্য নয় সেই মুহূর্তে তার কাছে মনে হয়েছিল একজন পৈশাচিক ব্যক্তি। শংকর দ্রুতপদে বাড়িতে আসে আর পূর্ণাকে বলে লক্ষ্মী আজ থেকে তাদের মেয়ে হিসেবেই এ বাড়িতে থাকবে। কিন্তু পূর্ণা বলে তার বাড়ির লোকজন কেউ কী মেনে নেবে ? শংকর বলে -বাড়ির জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করেছ ।এবার নিজেদের কথা ভাবো। তোমাকে আমি পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দিতে চাই। খুশিতে পূর্ণা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে এবং বলে সত্যিই সে আজকে পরিপূর্ণা।পূর্ণা বলে সে মা হতে পেরেছে। অন্যদিকে শঙ্করের ফোন বেজে ওঠে। ফোনে কথা শেষে শংকর পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে আর বলে মিস্টার বোস তাদের বিজনেস অফারটাকে ডিনাই করেছিল কিন্তু আজই সেটা আবার একসেপ্ট করেছে। শংকর আরো বলে লক্ষ্মী তাদের জীবনে সত্যি সত্যিই লক্ষ্মী হয়েই এসেছে। আজ আমাদের শুধু খুশি আর খুশি।  পূর্ণা বলে আর কেউ তাকে বাজা মেয়েমানুষ বলতে পারবে না। তবে ফুলির জন্য তার কষ্ট হয় ।এই অকালে চলে যাবার জন্য। তবে যাবার আগে ফুলি লক্ষ্মীকে তার কাছে দিয়ে, তাকে পরিপূর্ণা করে দিয়ে যায়। আর এজন্যেই তার মনের বালুচরে আজকে শুধুই খুশির হাওয়া, শরতের সোনালী রোদ্দুর শিউলি পদ্মের সমারোহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much