০৮ মার্চ ২০২২

মমতা রায় চৌধুরীর ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব ১২৪




উপন্যাস 

টানাপোড়েন১২৪
রোদ্দুর হোক অবেলায়
মমতা রায় চৌধুরী




সময় বয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায় ঢেকে গেছে 
বেলা ।তাই স্বপ্ন দেখতে ভয় লাগে। কি হবে স্বপ্ন দেখে এই অবেলায়? তবুও পোড়ামন স্বপ্ন দেখে 
রোদ্দুর ডাকটিকিট নিয়ে বেঁধে রাখবে তাদের এক আঁচলে। তাই রেখা ভালোবাসার 
কাঙাল ।ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
  সকালে উঠে রেখা কাজ করতে করতে এসবই  ভাবছে। তার শাশুড়ি মা  তাকে এখন মেনে নেবে তো? গতকাল এসেছেন ওনারা ।কালকে সেইরকম খারাপ ব্যবহার কিছু করেন নি। যদিও ননদের কথার মধ্যে লঙ্কার ঝাল মেশানো ছিল। কিন্তু রেখা সেগুলোতে মনে রাখেনি।
সকাল থেকে নতুন উদ্যমে শাশুড়ি মাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শীতকাল শাশুড়ি মার কষ্ট হবে তাই আগেই গিজার চালিয়ে জল গরম করে রেখেছে ,বাথরুমে গিয়ে যাতে ঠান্ডা জল স্পর্শ করতে না হয়।
সারারাত একটা উত্তেজনা কাজ করেছে এবার বোধহয় মায়ের ভালবাসাটুকু ফিরে পাবে। রেখার মা তো কবেই স্বর্গে চলে গেছেন। মায়ের প্রতিচ্ছবি শাশুড়ি মার মধ্যে দিয়েই খোঁজার চেষ্টা করছে । 
সকাল সকাল আজ কলিংবেল বাজছে' জয় গনেশ, জয় গনেশ, জয় গনেশ দেবা।'
লেখার আজকে নতুন রুমে ঘুম হয়নি তারপর একটা ভাব নাতো ভেতরে ছিল একটা আশার ভাবনা তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলেছে।
মাসিকে দেখে এক গাল হেসে বলেছে 
"মাসি সকাল-সকাল এসেছ ,বেশ ভালো হয়েছে।'
'আর বোলো না আজকে এক জায়গায় যাব। তাই তাড়াতাড়ি আসলাম।'
'বেশ করেছো। এসো এসো ভেতরে এসো।'
সকালে কাজের মাসি এসেছে ।কাজের মাসিকে বুঝিয়েছে।
'মাসি এখন থেকে তোমাকে একটু এক্সট্রা কাজ করতে হবে ।তার জন্য তোমাকে তার পারিশ্রমিক দেয়া হবে।'
'কেন গো তোমাদের আবার বাড়তি কাজ কি হলো এইতো দুটি প্রাণী।'
'হ্যাঁ গো, এখন থেকে আমার শাশুড়ি মা থাকবেন তো, তাই উনার কাপড় জামাগুলো কেঁচে দেবে ঠিক আছে। আর যদি কিছু বলেন সেগুলো একটু করে দিও।
"হ্যাঁ গো ,বৌমা তুমি বলছো, আর করে দেবো না?
উনি আবার আমার সাথে খ্যাচ খ্যাচ করবেন না তো বৌমা?'
"ও মাসি যদি দুটো কথা বলেও থাকেন, তুমি কিছু মনে ক'রো না ।বয়স হয়ে গেছে তো। আমার শাশুড়ি মা খুব ভালো মানুষ।'
'ঠিক আছে, বৌমা। তুমি এত সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে ,তাই হবে।'
ইতিমধ্যেই শাশুড়ি মা ঘর থেকে বেরিয়ে রেখাকে এমন শাড়ি পড়িয়ে দিলেন তাতে উনার ভালো মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে গেল আর রেখা জীবনেও ভুলতে পারবে না।
'সকালে উঠে কাজের বউ এর কাছে আমার নামে নিন্দা করছো বৌমা?
'এক দিনও হলো না এসেছি বাড়ীতে, এর মধ্যে নিজের স্বরূপটা দেখিয়ে দিলে?'
'মা আমি..।'
রেখা কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল সেটা সম্পূর্ণ করতে দিল না।
তবুও রেখা ব্যাপারটা বোঝার জন্য আরেকবার বলতে যাচ্ছিল
 'মা আমি…।'
শাশুড়ি মা হাত তুলে রেখার দিকে দেখিয়ে বললেন-
'আর তোমাকে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না বাছা।আমি সব শুনেছি।'
'না মাসিমা বৌমা সেরকম….।'
কাজের মাসিও বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিল,.
'এই তুমি কাজের বউ।। কাজের লোকের মতো থাকো ।আমাদের মধ্যে কথা বলতে এসো না তো?
যতসব আদিখ্যেতা।'
কাজের মাসি ও রেখা দুজন দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আর চোখের ইশারায় বুঝাতে চাইলো এসব কি হচ্ছে?
'একেতে রামে রক্ষা নেই সুগ্রীব দোসর 'এবার
ননদ এসে ফোড়ন দিল।
'শুনলে মা, কেমন কাজের লোকের কাছে তোমার নিন্দে করছে । তোমার এ বৌ ঠিক হবার নয় গো মা?'
"তাইতো দেখছি মনু এমন মেয়েকে বিয়ে করে আনলো সংসারে। আমার হার মাস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিল।'
মনোজ ঐএসব কথা কাটাকাটির মাঝে এসে উপস্থিত হলো
'কি হলো তোমরা সাতসকালে চিৎকার করছো কেন ?এটা বাড়ি না অন্য কিছু?'
'তোর বৌকে জিজ্ঞেস কর না?'
মায়ের দিকে তাকিয়ে মনোজ' বললো ' কি বলছো, তুমি এসব?'
কাঁদতে কাঁদতে বলল'' আমি ঠিকই বলেছি রে ,তুই আমার কথা বিশ্বাস করবি না, তাই 
তো ? মেয়েকে কাছে টেনে নেয় বললেন 'মনামির কাছে শোন।'
'হ্যাঁরে ভাই তোর বউ আর কাজের মাসি দুজনে মিলে কুটকাচালি করছিল।'
মনোজ বলল' রেখা ওরকম মানসিকতার মেয়ে নয় ।
মনামী বলল 'দেখলে মা, কেমন গায়ে ফোসকা পড়ে গেল।
'হ্যাঁ ,তা একটু পড়লে বটে।
অকারনে তোমরা অনেক কথা বলছো।
মনোজের কথাগুলো  রেখার কানে আসলো।
যত সব মেয়েলী কুটকাচালি।মনোজ কথাগুলো বলে চলে গেল।
রেখা তো ওখানে ধপ করে বসে পড়েছে, মাথায় হাত দিয়ে।
কাজের মাসি কাজ করে এসে বলল 
'বৌমা এখানে বসে আছো ?যাও চা খেয়ে নাও।'
' মাসি তোমাকেও চা দেয়া হয়নি ।তুমি বসো, আমি চা বানিয়ে আনছি'। রেখা কথাগুলো যখন বলছে তখন ওর  কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে, চোখের কোনে জল।
মাসি বলল " ও বৌমা , রোজই তো  চা খাই, আজ না হয় নাই খেলাম।'
"চলো বৌমা দরজাটা লাগিয়ে দেবে আমি 
যাই ।দেরী হয়ে গেল।"
"চলো মাসি '
মাসি যাবার সময় গজগজ করতে করতে বলল "এত ভালো বৌমা, কারণে-অকারণেই কথা শোনানো। বৌমা শাশুড়ির নামে প্রশংসা করল। কত ভালো মানুষ বলে আমার সামনে পরিচয় দিল।
আর শাশুড়ি মা দেখো… '।
দরজার কাছে এসে মাসী বললো
' বৌমা যাও ,ভেতরে যাও। চা করে খেয়ে নাও গা।'
রেখা দরজা বন্ধ করতে করতে ও দিক থেকে মনোজের চেঁচানোর আওয়াজ পেল। কিন্তু কোন আওয়াজ দিল না ।
মনোজ আবার তার  আর্তি প্রকাশ করল
'রেখা ,রেখা, রেখা .আ. আ. আ।
রেখা মনোজের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বলল "কি বলছ?'
আজকের চা টা কিছু হবে,না হবে না?
'কেন চা হবে না কেন?'
সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি এতটা বেলা হলো এখনো চা পেলাম না।
"একটু ওয়েট করো এখনি পাবে' বলেই রেখা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
ঘরের মধ্যে শাশুড়ি মা আর ননদ বসেছিল।
দুজনাই ঝোপ বুঝে কোপ মেরে দিল।
"সে কিরে তোকে কি এত বেলা করেই চা খেতে হয় নাকি?'
মনোজ কোন কথার উত্তর দিলে না।
মনামী বলল' 'চাকরি করা বউ এনেছো ,অত কিছু চাইলে হবে?'
খোঁচা মারা কথা হৃদয়ে তীর বিদ্ধ হয়।
সব কথাগুলোই রেখার কানে গেল।
রেখা গতরাত্রে যে আশা নিয়ে বুক বেঁধেছিলো তা যেন ভষ্মে ঘি ঢালার মতো হলো।
তবুও চেষ্টা করছে সোনা মিললেও মিলতে 
পারে।
ওদিকে রেখার গলার আওয়াজ পেয়ে মিলি আর ওর বাচ্চারা চিৎকার শুরু করেছে।
মনোজের মা বলল
' তোকে বলেছিলাম না ,যে ওই অসভ্য , অপয়া জীবগুলোকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবি।'
মনোজ বলল '-কি বলছ মা তুমি ,।ওরা অবলা জীব। আর ওরা অপয়া হতে যাবে কেন? ওরা প্রভুভক্ত জীব।'
মনামী বললো' এসব কথা বলো না মা ।তোমার বৌমার কাছে এরা চোখের মনি। এইজন্যই তো ভাই কিছু বলতে পারেনা ।চাকরি করা মেয়ে না?'
সব কথাগুলোই রেখা শুনতে পাচ্ছে। আসলে রেখা শুনিয়েই বলা হচ্ছে।
রেখা চা করতে করতে ভাবছে আজ স্কুলে যাবে কিনা? আজ স্কুলে গেলে তো আর রক্ষে নেই। এমনি অশান্তি শুরু হয়ে গেছে।
তবুও মনে মনে ভাবছে এখানে সব মেনে চলার দরকারটাই বা কি সে তো ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারে কিন্তু না রেখার বিবেক বলে একটা কথা বলে যদি মিলেমিশে শান্তিতে থাকা যায় সেটাই ভালো। যদি নিজেকে কিছুটা সেক্রিফাইস করতে হয়, সেটাই ভালো।
চা করে কাপগুলো সাজিয়ে নিয়ে গেল ঘরে। মনোজকে দিল ,শাশুড়ি মাকে দিল, ননদ কে দিল।
তারপর রেখা  মিলিদের কাছে গেলো ওদের কিছু খাবার নিয়ে।
এরমধ্যে মনোজ গিয়ে বলল' তুমি আজকে স্কুলে যাবে না?'
'কি করব বলো স্কুলে যাব, কি যাব না?'
' তুমিই জানো স্কুলে যাবে, কি যাবে না?
তবে এটা বলতে পারি মা, দিদিরা এসেছে আজকে না গেলে ভালো হয়  এবার তুমি বিবেচনা কর, কি করবে,?"
রেখা কোন কথা বললা না।
 মনোজ বলল 'তোমাকে তো জিজ্ঞেস করছি তুমি কিছু বলছো না?"
রেখে শুধু মনোজের দিকে তাকিয়ে রইল।

মনোজ বিরক্ত হয়ে বলল' এখন দেখছি তুমি বোবা হয়ে গেছো।
 নাকি, আমার সাথে কথা বলতে তোমার কষ্ট?'
রেখা বলল আমি স্কুলে গেলে তোমার ভালো লাগবে তো?
আমার ভালো লাগা, না লাগা তোমার কী এসে যাবে?'
আমার তো অনেক কিছু এসে যায় কিন্তু তোমার কি কিসে, কি এসে যায় _সেটা এখনো বুঝতে পারলাম না।'
'দেখো রেখা এরকম  বাঁকা বাঁকা কথা বলো না তো। আমার ভালো লাগছে না।'
'সেজন্যই তো চুপ করে ছিলাম।'
মনোজ ওখান থেকে চলে গেল গজ গজ করতে করতে।
রেখার দুচোখের জল পড়তে লাগলো।
রেখা ভাবছে সময় যত বয়ে যাচ্ছে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে বেলা ।স্বপ্নগুলো তাই অবেলায় পড়ে থাকে অনাদরে আর এই স্বপ্নের ঘোরে কোন ঝড় উঠবে 
কিনা, বাতাসে কোন ফুলের গন্ধ ছড়াবে কিনা?
তার মন দোলাচলাতায় দুলছে।
তবু ভাবছে শুধু বেঁচে থাক অভিমানগুলো নতুন কপাল ছুঁয়ে ।তবু প্রান ভরে দেখি আকাশে মেঘের আনাগোনা , মেঘ আসুক এলোকেশে। যদি বেঁধে রাখতে যদি পারি। তারপরেই আলসে পিয়ন ডাকটিকিট দিয়ে যাক রোদ্দুরের। মিল আর তার বাচ্চাদের আদরে ক্লান্ত প্রভাতের স্মৃতিগুলো
দূরে সরিয়ে প্রত্যাশায় থাকে রোদ্দুর নিশ্চয়ই তার জীবনে আসবে নতুন প্রভাত হয়ে। ফিরে পাবে মায়ের ভালোবাসা, স্বামীর বিশ্বাস -ভালোবাসা ভরা এক আকাশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much