শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব৩৪)
শামীমা আহমেদ
----ফোনে শায়লার খবরটা পেয়ে কথা বলা শেষ করে শিহাব বেশ অস্থিরতায় ভুগতে লাগলো।শায়লা এখন শিহাবের বিল্ডিংয়ের ঠিক পেছনের হাস্পাতালটিতেই আছে।শিহাবের ইচ্ছে করছে এক ছুটে শায়লার কাছে চলে যেতে । শায়লার হাত দুটো ধরে নিজের উপর সমস্ত দায় নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে শায়লা আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে।আমার বুঝা উচিত ছিল আমাকে নিয়ে কতটা গভীরে তোমার ভাবনা,কতটা নির্ভরতা আস্থা। শায়লা আমি অনুতপ্ত, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।আর কোনদিন এমনটি হবে না।শিহাব অস্থিরতায় ঘরের ভিতর শুধু এদিক ওদিক পায়চারী করছে।সে এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এইতো বাসার খুব কাছেই হস্পিটাল,চাইলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে শায়লার কাছে চলে যেতে পারে।কিন্তু শায়লার পরিবার পরিজন বিষয়টি কিভাবে নিবে? আমাদের সমাজে কোন বিবাহিত মেয়ের ছেলে বন্ধু থাকাটা সহজভাবে দেখা হয়না। তাছাড়া সেতো শায়লার কোন স্কুল কলেজেরও বন্ধু না।কীভাবে পরিচয় দিবে নিজেকে।তারাও নিশ্চয়ই শিহাবের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাবে। উফ! শিহাবের মনে হচ্ছে সে খাঁচায় বন্দী একটা পাখি।কেবলি ডানা ঝাপ্টে চলেছে।তাকে ভালোবাসার পরীক্ষায় শায়লা কিন্তু ঠিকই জিতে গেলো! আর শায়লার প্রতি শিহাবের আকুলতাটা শিহাব চাইলেও প্রকাশ করতে পাছে না।শিহাবের দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে কি করবে ভেবে কোন কূল কিনারা করতে পারছে না। আর যদি হাসপাতালে সাহস নিয়ে চলেও যায় আত্মীয়স্বজনরা নানান কানাঘুষা করবে।সামনে শায়লার কানাডায় যাওয়ার বিষয়টিও আছে। আমাদের সমাজে সবকিছুতে মেয়েরাই ভিকটিম হয়।শায়লার কোন ক্ষতি হউক সেটা তো শিহাব চায় না।কিন্তু এই অবস্থায় শিহাব খুব ভালো করেই জানে এটা ডাক্তারী কোন চিকিৎসায় ভালো হবার নয়। খুব প্রিয়জন কাউকে ভেবে ভেবে মনের ছোট্ট কোণে অবচেতন মনেই একটা স্বপ্ন জাল বুনে।কল্পনায় একটা ছোট্ট গৃহকোণ সাজায় খুবই নিঃশব্দে, নির্জনতায় কল্পনায় তার সাথে পথ চলে,কথা বলে, একান্তে একটু সময় কাটানোতে জীবনের অনেকখানি প্রানশক্তি ফিরিয়ে আনে। এই ধরনের চাপা স্বভাবের মেয়েরা সবকিছুকে নিজের ভেতরে চালান দেয় যা বাইরে থেকে বুঝবার কোন উপায় থাকে না। তাইতো একসময় তার আউটবার্স্ট হয়! শিহাব শায়লাকে পুরোপুরি বুঝেছে।তার অনুভুতির সাথে শায়লার অনুভব দুজনার অজান্তেই কখন যে মিলেমিশে গেছে তা আজ বুঝা গেলো। কাল রাতে শায়লাকে তার একটা ফোন কিংবা মেসেজ দেয়া
উচিত ছিল ।
শায়লার এই পরিণতির জন্য শিহাব বারবার নিজেকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে।হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো!
শিহাবের মনে হলো তার ভেতরে কে যেনো খাঁমচে ধরলো।নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আসবে শায়লার। শিহাব উন্মাদের মত ছুটে গিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। শায়লার ফোন থেকে কল।নিশ্চয়ই শায়লা নয়।
শিহাব কল রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় হ্যালো বলতেই রাহাতের কন্ঠ ভেসে এলো। শিহাব ভাইয়া! এইমাত্র আপুর জ্ঞান ফিরেছে। সামান্য একটু চোখ মেলেছিল।
আহ! শিহাবের পৃথিবীর ঘূর্ণনটা যেন থামলো।পায়ের তলায় কিছু অনুভুত হলো।
উফ! কি ভয়টাই না সে পেয়েছিল!মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শিহাব তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চললো। আর এমন ভুল সে কখনোই করবে না।তার বুঝা উচিত ছিল শায়লা খুব কোমল মনের একটি মেয়ে। তবে সেতো শায়লার ভালোই চেয়েছিল।কিন্তু তার বিপরীতে যে এমনটি হবে শিহাব তা একবারো মনে আনেনি।
রাহাত ওপ্রান্তে বলেই চলেছে,,,তবে আপুকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।
ডাক্তাররা কী বললেন?
,বলেছেন নার্ভাস ব্রেকডাউন আর ভীষণ একটা শক থেকে এমনটি হয়েছে। শিহাবের চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে এলো!কেবলি সে বারবার বলছে শায়লা আমি কখনোই এটা চাইনি। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। শায়লার সাথে প্রথম দিনের সেই দেখা হওয়ার ক্ষণটা শিহাবে খুব করে মনে পড়ছে।কালচে নীল শাড়িতে একটা মায়াবতী মুখের মেয়ে তার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে,,সেই যে কফি লাউঞ্জে লজ্জাবনত শায়লা কিছুতেই শিহাবের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না, সেদিন বাইকের পিছনে শিহাবের পিঠের উপর শায়লার অমন করে নিজেকে সঁপে দেয়া! শিহাবের সমস্ত শরীরে এক শিহরণ খেলে গিয়েছিল যেন! পাশাপাশি চলতে গিয়ে শায়লার প্রতিটি পদধাপ শিহাবের পায়ের ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলা,শায়লা যে তার এই একাকী জীবনে কতখানি প্রানস্পন্দন তা কখনোই মুখ ফুটে বলা হয়নি, শায়লার আবাহন শিহাবের জন্য যে কতটা কাঙ্ক্ষিত শিহাব কখনোই তা বুঝতে দেয়নি। কেন আরো কিছুদিন আগে শায়লার সাথে তার পরিচয়টা হলোনা বারবার শিহাব এই আক্ষেপটাই করে চলেছে।
শিহাব দ্রুত কাপড় পালটে নিলো। সে এক্ষুনি শায়লার কাছে যাবে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো তাকে দেখে শায়লা যদি উত্তেজিত হয়ে উঠে তবে তো হিতে বিপরীত হবে। শিহাব নিজেকে সংযত করলো। সে রাহাতের কাছ থেকেই শায়লার খবরাখবর নিবে। শিহাব মোবাইল স্ক্রিনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলো।
হাসপাতালে মা অবিরল ধারায় কেঁদেই চলেছেন। শায়লা তার প্রথম সন্তান। কতটা আদরেই না তাকে বড় করেছিল। অথচ এই পরিবারের জন্য মেয়েটি তিলে তিলে নিজেকে শেষ করেছে,একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।মা আজ নিজেকে, নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করছে। রাহাত বারবার মায়ের মাথায় হাত রাখছে। মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।মন শক্ত করতে বলছে।নায়লাকে খবরটা দেয়া হয়নি।এ সময় হঠাৎ এমন কোন দুঃসংবাদ দেয়া ঠিক না। নায়লার হাজবেন্ড মূর্শেদকে রাহাত মেসেজে জানিয়ে রেখেছে।মূর্শেদ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে।
ডাক্তারদের রাউন্ড শুরু হয়েছে। শায়লার কেবিনে ডাক্তার আসলেন। মায়ের কান্নাকাটি দেখে তাকে আশ্বস্ত করলেন। মা চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে। রাহাত বুঝতে পারছে না কানাডার ব্যাপারেই কী আপু এতটা ভেঙে পড়েছে?
ডক্টররা নার্স ও জুনিয়র ডাক্তারদের যথাযথ ইন্সট্রাকশনস দিয়ে রাহাতের সাথে কথা বলতে চাইলেন।
রাহাত ডক্টরদের সাথে ডিসকাশন রুমে গেলেন।
ডক্টর শায়লার ব্যাপারে জানতে চাইলেন।
পেশেন্ট মিস শায়লা উনি কি বিবাহিত?
জ্বি
উনার হাজবেন্ড কোথায়?
আপুর হাজবেন্ড কানাডায় থাকেন।আপাকে নেয়ার প্রসেস চলছে।
প্রসেসটি দ্রুত করুন।সম্ভবত তাদের দূরত্বটা তাকে একাকীত্বে ভুগাচ্ছে অথবা,,,
অথবা মেন্টালি সে কারো সাথে ইনভলভড হয়েছেন। আর এর টানাপোড়েনেই পেশেন্ট মানসিকভাবে কোন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। ইনশাআল্লাহ উনি সুস্থ হয়ে উঠলে যার সাথে উনি খুব ফ্রি এমন কাউকে দিয়ে তার সাথে খোলামেলাভাবে কথা বলান।সমস্যাটা কোথায় তা জানার চেস্টা করুন।তবে সর্বোপরি আমাদের এডভাইস হচ্ছে দ্রুতই তাকে তার স্বামীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।মেয়েরা স্বামী সংসার সন্তান--- এ বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশী সুস্থ থাকে।
রাহাত সব কিছু শুনে ডাক্তারদের আশ্বস্ত করলেন আপার কানাডা যাওয়ার ব্যাপারটি সে খুব দ্রুতই দেখবে।
রাহাত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আপা সুস্থ হয়ে উঠলেই যত দ্রুত সম্ভব কানাডার বিষয়টি দেখবে।কিছুতেই আপুর এই অবস্থা কাম্য নয়। আপু আমাদের জন্য অনেক করেছে।এবার আপুর দিকে আমাদের দেখা উচিত।
ডাক্তাররা কী বললো শোনার জন্য কেবিনের ভেতরে মা উদগ্রীব হয়ে আছেন। রাহাত ভেতরে যেতে উদ্যত হতেই মোবাইলে শিহাবের কল এলো। পরক্ষনেই রাহাত তাকিয়ে দেখলো নিচ তলার রুহি খালা রীতিমতো এক ভ্যান ফল নিয়ে এসে হাজির হয়েছে। রাহাত রুহি খালাকে এগিয়ে নিয়ে কেবিনে ঢুকল।
শিহাবের কলটি পুরো এক রাউন্ড রিং হয়ে থেমে গেলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much