স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পাতায় লেখক শামীমা আহমেদ'র নতুন ধারাবাহিক উপন্যাস "অলিখিত শর্ত"
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ১৮)
শামীমা আহমেদ
আপু, আম্মার রিপোর্টগুলো আজ নিয়ে এসো।আর আমাকে কল দিয়ে জানিও। ডাইনিং টেবিলে এ চায়ের কাপ হাতে তাড়াহুড়োয় রাহাত কথাটা শায়লাকে জানালো। শায়লা টেবিলের ওপ্রান্তে গভীর চিন্তামগ্ন।কি জানি রাহাতের কথা তার কানে পৌছুল কিনা!
রাহাত অফিসের জন্য তৈরি হতে নিজের রুমে চলে গেলো।সকাল আটটায় গাড়ি নিচে চলে আসে। না অফিস থেকে কোন গাড়ির ব্যবস্থা নেই। কয়েকজন কলীগ মিলে একজন কলীগের গাড়ি শেয়ার করে।সেই কলীগ একটু সেক্টরের ভেতরের দিকে থাকে।একে একে তিনচারজন কলীগকে সে তুলে নেয়।খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ওদের মাঝে। আসলে এরা সবাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।জীবনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ এই অবস্থানে। একটা উন্নত জীবনের জন্য কতই না পরিশ্রম রাতজাগা পড়াশুনা।প্রতিযোগিতায় নিজের শক্ত অবস্থান করতে দিনরাত্রিকে এক করা।ওরা কেউই ওদের অতীত ভুলেনি।কারো কারো জন্য অতীত একটা বিশাল শিক্ষাক্ষেত্র। বর্তমান সময়ে চোখ বন্ধ করে যখন অতীতের দিকে তাকায় আরো এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায় চলে দিবারাত্রির পরিশ্রম।প্রায়ই ওরা একসাথে খেতে যায়,বেড়াতে যায়। যার গাড়ি সেই বন্ধুকে, তার ফ্যামিলিকে মিলিতভাবে উপহার দেয়।
শায়লা আজ যেন অন্য এক ভুবনে বাস করছে! নানারকম রোমাঞ্চ আবার দূর্ভাবনায় আছন্ন হয়ে আছে। বয়সের এই জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন অনুভুতিও যে কল্পনাপ্রবণ করে তুলবে শায়লা কখনো ভাবেনি। সে কি নিজে থেকে সেধেই এই সিচুয়েশনকে ডেকে আনছে? তবে কেন এত দ্রুত সব কিছু ঘটে যাচ্ছে!যেখানে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চেয়েছিল, আজ শিহাবের এক কথাতেই দেখা করতে রাজী হয়ে গেলো।তবে কী শিহাবের প্রতি তার আস্থা জন্মেছে? শিহাব কি তার নিজের একাকীত্বে শায়লাকে সঙ্গী করতে চাইছে?কেনইবা সে এভাবে দেখা করার প্রস্তাব এগিয়ে দিলো?আর শায়লা তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করলো।
নীচ থেকে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠলো! রাহাত অফিস ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ওর অফিস গুলশানে।।একটু আগেই বেরুতে হয়।নয়তো বনানীর বিশাল জ্যামে আটকে যেতে হয়।রাতে আবার একসঙ্গে সবার ফেরা।
আপু আসি।মায়ের খেয়াল রেখো।বলে রাহাত দোতালা থেকে নেমে গেলো। দরজা লাগানোর শব্দে শায়লা নিজের মাঝে ফিরে এলো!
নাহ! এত আনমনা হয়ে যাওয়ার কি আছে। শুধু দেখা করতেইতো যাওয়া। অচেনা কোন যায়গায়তো নয়। কত অপরিচিত ডাক্তারের সাথেওতো কথা বলতে হয়।একসময় পরিবারের সব দায়িত্ব একার কাঁধে তুলে নিয়েছিল। একা একা অনেক পথ চলেছে। আজীবনের জন্য না হউক কিছুটা সময় কেউ সঙ্গ দিতে চাইলে কেন তা গ্রহন করবে না?ভেতরে ভেতরে নানান ভাঙা গড়ায় শায়লা এক পা দু পা করে নিজের ঘরে এলো। শিহাবের মেসেজ এসে আছে।
শুভ সকাল।
কেমন ঘুম হলো?
কখন বেরুচ্ছেন?
শায়লা মেসেজ সিন করলো। হাত কিছুতেই কিবোর্ড বাটনে যাচ্ছে না। মোবাইলটা মনে হচ্ছে অত্যন্ত ভারী।শায়লার হাত কাঁপছে!
শিহাবের কল চলে এলো।
কি হলো কোন রিপ্লাই নেই যে?
আমাকে ঠিক সময়টা না জানালে কিভাবে বের হবো?
ওপ্রান্তে শিহাবের খুবই সহজ করে বলে উঠা।
শায়লা কাঁপা গলায় বললো, সাড়ে নয়টা।
ওকে।তাহলে আমি নাস্তাটা করে শাওয়ারে ঢুকছি।ও আচ্ছা, আপনি কোথায় থাকবেন? মানে আপনার বাসার কাছাকাছি হয় এমন কোথাও।(কোন মহিলার বাসা কোথায় জানতে চাওয়া শিহাব মনে করে এটা ভীষণ একটা অভদ্রতা।)
আপনি সেখানে দাঁড়ালেন, আমি একটানে বাইকে চলে আসবো।শিহাবের কন্ঠে জিজ্ঞাস্য আছে কিন্তু কোন আবেগ নেই।শায়লাকে আসতে বলা হচ্ছে কিন্তু তাতে কো উচ্ছ্বাস নেই।যেন ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নেয়ার মত করে এসিস্ট্যান্টের কাছে সময় আর সিরিয়াল নম্বর, ফ্লোর নম্বর জেনে নিচ্ছে।
শায়লা হালকা গলায় বলে উঠল,
আপনিই বলুন কোথায়?
তাহলে উত্তরা মেডিকেলের সামনে একটা চায়ের টং ঘর আছে। আমি ওখানে সকালের চা খাই।ওদের ধোঁয়া ওড়া আদা লাল চা,,একেবারে সকালের আলসেমিটা কাটিয়ে দেয়।
শায়লা কিছুই আমলে নিল না।মাথার ওপর দিয়ে সব চলে গেলো।শুধু জায়গাটা জেনে রাখলো।
শায়লা আনমনে বললো, ঠিক আছে। আমি চলে আসবো।
ওকে বাই, বলে শিহাব ওপ্রান্তে মিলিয়ে গেলো।
শিহাবের দৃঢ় কন্ঠ শায়লাকে সাহস যোগালো। শিহাবের কেন এই দেখা করতে চাওয়া! শায়লা তার উত্তর খুঁজে ফিরে।
সে মনস্থির করে নিলো যে সে যাচ্ছে।
ওহ! শাড়ির কথাতো জানানো হলোনা।কিন্তু নিজেই তো ঠিক করেনি কোন শাড়িটা পড়বে।
মনে পড়লো কোটা শাড়িটার কথা। যেদিন
ছোটবোন নায়লার বিয়ের কথা পাকাপাকি করার জন্য মোর্শেদদের বাড়ি থেকে সবাই এসেছিল, সেদিন শায়লা সোনালী চিকন পাড়ের কালচে নীল রঙের একটা কোটা শাড়ি পরেছিল।খুবই সুন্দর লাগছিল তাকে। ওবাড়ির লোকজন সবাই
চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শায়লাকে দেখছিল।
শায়লা ঠিক করলো সেই শাড়িটাই পরবে।
শায়লা তার আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো।
মা এখনো ঘুমিয়ে আছে। মা উঠলে তার নাস্তা দিতে হবে।শায়লা গোসলে ঢুকে গেলো।
সাড়ে আটটা বাজছে। সময় আছে। গোসল সেরে রেগুলেটর ঘুরিয়ে ফ্যানের স্পীড বাড়িয়ে দিলো চুল শুকাতে। শায়লা এখন আর হেয়ার ড্রায়ারটা খুব একটা ইউজ করে না। এখন অফিসের তাড়া নেই। শায়লা শাড়ি পরে নিল।অনেকদিন পর।শেষ কবে শাড়ি পরেছিল মনে নেই।আয়নায় নিজেকে দেখে নিল। নীল শাড়িটায় তাকে বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।।আর কোন প্রসাধনী নয় শুধু কাঠমেরুণ লিপস্টিকটা দেয়া। ক'দিন আগেই আইভ্রুটা ফ্রেস করে আসা ছিল। শায়লা চুল আঁচড়ে ডাইনিং এ চলে এলো।
মা উঠেছে। মা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
শায়লা মাকে সহজ করতে বলে উঠলো,
আজ শাড়ি পরলাম মা।তুমি তো আমাকে শাড়ি পরা দেখতে চাও।তাই পরলাম। কেমন লাগছে মা?
মায়ের চোখে পানি এসে গেলো।
শায়লা মায়ের ওষুধের বক্স এগিয়ে দিল।।নাস্তার আগের ওষুধ খেয়ে নিতে।
শায়লা বারবার ডাইনিংয়ের বড় ঘড়িটা দেখছে। নয়টা বাজছে।
কাজের বুয়া রেনুর মা এলো।শায়লাকে শাড়ি পরা দেখে সে এতটাই আশ্চর্যান্বিত হয়েছে যে, তার চোখ দুটো যেন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে! মুখে মন্তব্যও বেরিয়ে এলো! "আফারে একদম পরির লাহান লাগতাছে! আহা আম্মা আফার কেমুন একটা বিয়ে দিলেন, জামাই রইল সাত সমুদ্দুর পাড়ে।এইসময় জোড়া কইতর একসাথে ঘুরবো কতই না সুন্দর লাগবো!"
শায়লা নিজের ঘরে চলে এলো। শিহাবের উপস্থিতি তাকে আছন্ন করে রেখেছে। শিহাবের মুখচ্ছবি চোখের পর্দায় ভাসে।সুদূর কানাডার হাতছানি আজকাল আর তাকে ভাবায় না।
শায়লা গতকালের হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে নিল।
ব্যাগটা আড়ং থেকে কেনা। তার চাকরীক্ষেত্রের কলীগরা তার বিদায়ে উপহার দিয়েছি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। শায়লা ব্যাগের চেইন খুলে টেস্টের রিপোর্টের মানি রিসিটটা আছে কিনা চেক করে নিলো।গতকালই সব পেইড করা। আজ শুধু রিপোর্টগুলো আনা। গতকাল এই সময়টাতেও শায়লা জানতো না আজ তার জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে! কার জন্য কোন সকাল শুভ বারতা নিয়ে আসে সেটা তো তার অজানাই থাকে।আমরাই কেউই কি কখনো জানি একটু পরেই আমাদের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে?
নয়টা পঁচিশ বেজে গেছে।শায়লা শেষ বারের মত আরেকবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিল।
মাকে জানিয়ে নীচে নেমে এলো। শায়লার পা চলছে না।ভেতরে হাতুরি পেটানোর মত বেদম শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম! শায়লা একটা রিকশা দাঁড় করালো।
কোথায় জাইবেন?
রিকশাওয়ালার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শায়লা রিকশায় উঠে বসলো।রিকশা চলছে উত্তরা সাত নম্বর সেক্টর পার্ক রোড থেকে বাংলাদেশ মেডিকেলের টি স্টলের দিকে..
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much