ইউএন মিশনে হাইতিতে গমন
১০তম পর্ব
আবাসস্হলে যেয়ে প্রথমে একটু হোছটই খেলাম, শারীরিকভাবে না হ'লেও মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্হতো হ'লামই বটে। তাই এমূহুর্তে কিছু না ব'লে ঠিক থাকতে পারছিনা। আশা যেখানে গগনচুম্বী- পাওয়াটা যদি হয় তার খানিকটাও কম, সেখানেই জন্মে নিরাশা আর না পাওয়ার যন্ত্রনা, আর তখনই অতৃপ্তিতে ভোগে মানুষ না পাওয়ার বেদনায় আর এই ফাকে টুক ক'রে শয়তানটি এসে বার বার দেয় মনে তখনি কুমন্ত্রনা। ঠিক যেন এমনটি ঘ'টেছিলো আমার সেদিন মনের গভীরে, আশাহত হ'য়ে নিজ পাওনাটা না পেয়ে যথামূহুর্তে-যথাস্হানে।
সাতাশটি বছর আগে ভাবুনতো, আমরা গেছি কত শত পাহাড়-
পর্বত, সাগর-নদী, বন-জঙ্গল, শহর-বন্দর আর রাজ্য-মহারাজ্য পেরিয়ে তাও আবার কল্পনার রাজ্যে, বলা যায় রূপকথার সেই দেশে আর যে দেশে স্বশরীরে হাজির হ'য়ে একজন বাঙালী হিসেবে থাকা খাওয়ার ব্যাপারে তার বাড়তি কি ধরনের উচ্চাকাঙ্খা থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। থাকার জায়গাটা প্রথম দর্শনেই মনটা যেন পাথরের মত ভারী ক'রে দিলো। ডবল ডেকার সাইজের দোতলা খাট, যেন মনে হ'লো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোন একটা সিনেমার দৃশ্যের হুবহু চিত্র বুঝি পূনরাবৃত্তি হ'য়ে চোখের সামনে এসে জীবন্তভাবে ধরা দিচ্ছে।
পর্বত, সাগর-নদী, বন-জঙ্গল, শহর-বন্দর আর রাজ্য-মহারাজ্য পেরিয়ে তাও আবার কল্পনার রাজ্যে, বলা যায় রূপকথার সেই দেশে আর যে দেশে স্বশরীরে হাজির হ'য়ে একজন বাঙালী হিসেবে থাকা খাওয়ার ব্যাপারে তার বাড়তি কি ধরনের উচ্চাকাঙ্খা থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। থাকার জায়গাটা প্রথম দর্শনেই মনটা যেন পাথরের মত ভারী ক'রে দিলো। ডবল ডেকার সাইজের দোতলা খাট, যেন মনে হ'লো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোন একটা সিনেমার দৃশ্যের হুবহু চিত্র বুঝি পূনরাবৃত্তি হ'য়ে চোখের সামনে এসে জীবন্তভাবে ধরা দিচ্ছে।
এখন বিষয়টি হলো কে দোতলায় থাকবে আর কেবা নীচ তলায়? দীর্ঘ পনের দিনের বসবাসের মামলা ব'লে কথা, একেবারে নেহায়েতই এটা কিন্তু কম সময় নয়। আসলে কোনো সমস্যাই কিন্তু সমস্যা নয়, সমস্যা মনে ক'রলেই সমস্যা। যাক, এ সমস্যা মূহুর্তের মধ্যেই সমাধান হ'য়ে গেলো। সেনাবাহিনীর চাকরীর বুঝি এই একটাই মজা! এ মূহুর্তে আমার ঐ ক্যাপ্টেন পদবীর প্রিয় জুনিয়ার অফিসারটি প্রকৃতপক্ষে কে ছিল সে কথাটি ঠিক আজ আর মনে নেই। সেদিন সেই সহৃদয় প্রিয় ক্যাপ্টেন পদবীর অফিসারটি এসে ব'ললো স্যার,"আমি দোতলায় থাকবো"। যাক মুশকিল আসান হলো কিন্তু মনটা বেশ খারাপ লাগতে লাগলো এই ভেবে যে, আমি না হয় নীচে থাকলাম কিন্তু আমার জুনিয়ার অফিসারটি তো ঠিকই কষ্ট পাবে।
লোকে আমাদের দেশকে গরীব দেশ বলে কিন্তু আমাদের মনটা অনেক বড়, বিশাল যেন সমুদ্রের মত। আমি যখন ১৯৮৫ সালে সবেমাত্র নতুন কমিশন পেয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে ২ লেঃ হিসেবে যোগদান ক'রেছিলাম তখন এধরনের ফৌজি খাট-পালঙ্ক মাস দু-তিনেকের জন্য মাত্র দেখেছিলাম কিন্তু তারপর আর এগুলো চোখে পড়েনি। এরা এত বড় উন্নত দেশের সেনাবাহিনীর লোকজন তারপরও বুঝি এর মায়া এখনও ছাড়তে পারেনি, এর কি রহস্য আর এতে কিইবা মহত্ব আছে আল্লাহ মাবুদই ভাল জানেন আর বুঝি ওরাই শুধুই জানে? যাক, যে কোন জিনিসের ভাল মন্দতো নিঃশ্চয়ই থাকবে বৈকি ?
লাগেজ ভ্যানে আমাদের লাগেজ ও অন্যান্য ব্যবহারিক সরঞ্জামাদী আসতে বেশ বিলম্ব হওয়ায় আমরা কিছুটা দেরীতে বিছানায় গিয়েছিলাম ঘুমোতে সেদিন রাতে। আসলে সেদিন রাতে বাংলায় যেটাকে বলে বারোটা বাজা, সত্যিই আমাদের সবার ঘুমের বারোটাই বেজে গিয়েছিলো। অনেকগুলো বাস্তব ও অনীবার্য কারণেই সেদিন এ হাল-অবস্হার সৃষ্টি হ'য়েছিলো আরকি!
একেতো লাগেজ দেরীতে আসা, খাওয়া-দাওয়ার একটা ভাল রকমের অনিয়ম, আবার অন্যদিকে পরিবারের অতি আপনজনদের থেকে হঠাৎ ক'রেই এক ধরনের সাময়িক বিচ্ছেদের কারণেই মনটা বড্ডই খারাপ ছিলো যার দরূন ঘটিত সবগুলো সমস্যা একসাথে ও একযোগে যৌথ প্রচেষ্টায় দেহের স্নায়ুকেন্দ্রকে সর্বদা সচল ও সবল রাখায় একবারে মোরগবাগ পর্যন্ত আমাদেরকে আর মোটের উপরেই চোখ বন্ধ ক'রতে দেয়নি।
ওহ, ঘুমের বারোটা বাজার অন্যতম মজার কারণটি এখন পর্যন্ত তো বলাই হয়নি। আপনারা কি একটু মালুম ক'রতে পারছেন ব্যাপারটা আসলে কি ঘ'টতে পারে? আসলে ঐ যে দোতালা খাটই এর জন্য দায়ী। খাটের উপরে কেউ যদি মুড়ামুড়ি ক'রে তাহলে নীচ তলার লোকটি কি শান্তিতে ঘুমাতে পারে? সবাইতো আমরা মানুষ তাই আমার যা হাল হ'য়েছিলো উপর তলার ব্যক্তিরও বুঝি একই হাল হয়েছিলো কারণ আমি তাকে সারারাত ধরে বিছানায় এদিক-ওদিক অসময়ে নড়ানড়ি-গড়াগড়ি ও মড়-মড় শব্দ করা শুনে অতি সহজেই বুঝে গিয়েছিলাম যে, সে বেচারাও আমার মত একই পথের পথিক এবং একইরূপে সমভাবে ভূক্তভোগী। সকালে উঠে আমার উপর তলার বাসিন্দাকে আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই সে আগ বাড়িয়ে বললো, "স্যার, গতকাল রাতে আমার এক মূহুর্তের জন্যে এক ছটাক পরিমাণও ঘুম হয়নি"।
যাহোক, সুবেহ্ সাদেকের সময় বিছানা থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়া সারার জন্য টয়লেটে গেলাম। এ আরেক জঞ্জাল স্হান ব'লে আমার মনের ভিতর প্রতীয়মান হওয়ায় পোর্টোরিকো তথা ক্যাম্প সান্টিয়াগো সম্বন্ধে আস্তে আস্তে বাজে ধারণার সৃষ্টি হ'তে লাগলো। প্রথমতঃ অফিসারদের জন্য আলাদা কোন বাথরুম বা টয়লেট কোনটির ব্যবস্হাতো নেই-ই তার সাথে বাথরুম আর টয়লেটেরে চরম বেহাল দেখে যেন দুঃখে-কষ্টে মনটা একবারে বিষন্নতায় ভরে গেলো। নিজের চোখে এর করুণ হাল দেখে মনকেও যেন মানাতে পারছিলাম না।
আজব জায়গায় আল্লার আজব চিজরা যেন এখানে বাস করে। হয়তবা এটাই তাদের কৃস্টি, এটাই সভ্যতা ও এটাই বুঝি তাদের রীতি। আসলে তাদের কোন দোষ নেই। টয়লেটের দরজার নীচে দশ ইঞ্চি পরিমান ফাক। "প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় পাশের টয়লেটের/বাথরূমের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে পরস্পরের কথোপকথন বা গল্প করার জন্যই বুঝি এই ব্যবস্হা"।
মজার ব্যাপার হলো টয়লেটের উপরিভাগও ম্যানহাইট পর্যন্ত উঁচু করা হ'য়েছে বা এটার উদ্ভব হ'য়েছে বোধ ক'রি সব ধরনের সাপোগেশন এড়ানোর জন্যই। আবার একই কায়দায় বাথরুম বা গোসলখানাগুলোও তৈরী করা হ'য়েছে যেন একজন পাতলা মানুষ বা তাল পাতার সেপাই শুধুমাত্র কোনভাবে ভিতরে দাঁড়িয়ে স্নানকার্য সমাপন ক'রতে পারে। কিন্তু ভাবুনতো তাহলে ডবল ডেকার সাইজ বা ভীমাকৃতির একজন মানুষের বেলায় তার হাল কি হ'তে পারে?
মনে মনে ধারণা ক'রলাম-বুঝি ইচ্ছা ক'রেই তারা ফন্দি-ফিকির এঁটে বাথরুম আর টয়লেট এরকম ছোট ক'রে রেখেছে। কিন্তু বিপত্তি তখনই ঘটলো যখন অধীনস্তরা ব'লতে শুরু ক'রলো যে, বাথরুমে পানি নেই, ওজু-গোসল ক'রবো কি ক'রে ইত্যাদি। যাহোক, সরেজমিনে নিজ চোখে দেখে এসে মনটা বেশ সত্যিই খারাপ হ'য়ে গেলো। স্হানীয় কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা ক'রে জানতে পারলাম যে, সমস্ত বাথরুম ও টয়লেটগুলো ইতোমধ্যেই ওভারলোডেড হ'য়ে গেছে।
প্রথম দিকে তারা সুর তুলে ব'লতে চেয়েছিলো যে, বাঙ্গালীরা বাথরুম-টয়লেটের ব্যবহারই জানেনা এবং না জানার ফলেই নাকি যতসব বিপত্তি আর কি! যাহোক, পুরা পৃথিবীটাই হলো, কথায় বলেনা "শক্তের ভক্ত আর নরমের জোম"। পরে তাদেরকে অবশ্য শক্তভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে, তারা এখনও বাঙালীকে পুরাপুরি চিন্তে পারেনি।
এভাবে তিন দিন গুজরান হলো আমাদের অতি কষ্টে। অবশ্য ওয়াটার ট্রেইলরে ক'রে তারা ২৪ ঘণ্টাকাল পানি মওজুত ক'রেছিলো। কিন্তু তোলা পানিতে কি সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব? গোসল, কাপড়কাচা, দৈনিন্দন প্রাতঃক্রিয়ার মত প্রত্যহ নিত্যনৈমিত্তিক কার্যক্রম সম্পাদনে যেন সভ্য জগতের মানুষেরা পানির ট্যাপ ও বেসিনের পানি ছাড়া এক মূহুর্তের জন্য ভাবতেও পারেনা।
যাই হোক, আমরা বাঙ্গালীতো, তারপর আবার বাংলাদেশের মিলিটারী, আমাদের এ ধরনের প্রশিক্ষণ তো আগেই দেওয়া আছে এবং এর চাইতেও কঠিন জীবনের সাথে আমরা নিত্য পরিচিত কিন্তু বিষয়টি আসলে সেটা নয়, বিষয়টি হলো আমেরিকার মত একটা সভ্য ও ধন্যাঢ্য দেশে এসে আমাদের এ হাল হবে তা যেন সাতে-স্বপ্পনেও ভাবিনি। সবই যেন বাঙালীর নিয়তির দোষ। আসলে "অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়"।
যাহোক, প্রথমদিন আমাদের ৫২ জন অফিসারদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো বিশাল এক হলরুমে। এটাই হলো আমাদের প্রশিক্ষণ তালিকায় প্রথম অধ্যায়। আজকের ক্লাসের বিষয়বস্তু হলো মিডিয়া হ্যান্ডলিং। ইংরেজী ভাষায় নাতিদীর্ঘ দু'টি পর্বে সকাল ১০টা থেকে শুরু ক'রে সন্ধ্যা অবধি ক্লাস চ'ললো ব্রিটিশ রয়াল আর্মি ও ইউ এস আর্মির গন্ডা দেড়েক মেজর আর লেঃ কর্ণেল পদবীর অফিসারদের তত্ত্বাবধানে।
ফিরলাম সন্ধ্যা নাগাদ নিজ আবাসস্হলে। হঠাৎ ক'রেই খবর আসলো যে, আমরা যারা আপনজনদের সাথে আইএসডি ফোনে কথা ব'লতে আগ্রহী তারা যেন বানব্যাট অফিসে এসে নিজেদের নাম রেজিষ্টারে এন্ট্রি ক'রে যাই। ছুটলাম অনতিদূরে ব্যানব্যাট অফিসে।
তিনদিন ইতোমধ্যেই গত হ'য়েছে আপনজনদের সাথে মনখুলে কোন কথা ব'লতে পারিনি আবার বাঙালীর প্রধান মেনু ভাতের মুখও দেখিনি। ভালো দিকটা হলো রাস্তার ধারে ধারে অত্যাধুনিক কায়দায় স্হাপিত ভ্যান্ডিং মেশিনে ০১ ডলারের ০১ টা কয়েন ঢুকানো মাত্রই ০১ টা কোক অথবা ০১ টা পেপসির ক্যান বেরিয়ে আসে-এটা এখানে এসেই প্রথম দেখলাম আর জানলাম।
একদিন টেলিফোন বুথে কয়েন ঢুকিয়ে কথা ব'লতে যেয়ে হঠাৎ ক'রেই বেলাইন হ'য়ে যাওয়ায় মনটা খুবই খারাপ হ'য়ে গিয়েছিল। অবশেষে, ব্যানব্যাট অফিসে এসে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মেজর সাখাওয়াতের দেখা পেলাম এবং সে বললো "স্যার, রেজিষ্টারে আপনার নামটা তোলেন। প্রত্যেক অফিসার ০৩ মিনিট ক'রে সময় পাবে আপনজনদের সাথে কথোপকথন বাবদ"। যাহোক, কি কারণে মেজর সাখাওয়াৎ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের সবার মধ্যমণি হ'য়ে গিয়েছিলো সেটা না হয় পরেই বলি।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much