শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ২৯)
শামীমা আহমেদ
উল্কা গতিতে,প্রায় এক নিমেষেই রেস্টুরেন্ট "থাই এমারেল্ড" এর সামনে এসে শিহাব বাইক থামালো।আর বাইক থামতেই শায়লা ব্যাকসিট থেকে নেমে হাতের শপিং ব্যাগগুলো আর শাড়ি ঠিক করে নিলো। শায়লা তার হ্যান্ডব্যাগ ও শাড়ির কুচিগুলো ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল। শায়লা বুঝতে পারছে না কেন এভাবে সব কিছু হচ্ছে।
তবে সব ভাবনা সে শিহাবের উপর ছেড়ে দিলো।জীবনের কোন একটা সময়ে সাহসী হয়ে উঠতে হয় আর সেটাই থাকে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। শিহাব বাইকটি পার্ক করে শায়লার দিকে তাকালো। শিহাব একমনে তাকিয়ে রইল। শায়লাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে।
যদিও এভাবে দৃষ্টি দিয়ে সে কোনদিনই দেখেনি।
বরাবরই একজন ভদ্র মহিলাকে যেভাবে সম্মান জানাতে হয় সেটাই করেছে শিহাব। তবে আজ শাড়িটির রঙটায় শায়লাকে খুব মানিয়েছে।লিপস্টিকও বেশ মিলিয়ে দেয়া। সাইড ব্যাগটি গোল্ডেন রঙের রোদের আলোয় চকচক করছে।বাহাতে কালো বেল্টের ঘড়িটাই যেন হাতের অলংকার হয়ে আছে।শিহাব এগিয়ে এলো। শায়লা পরবর্তী নির্দেশনার অপেক্ষায়। শিহাব রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। শায়লা আজ শিহাবের পাশাপাশি হেঁটেই এগিয়ে গেলো। একটা অধিকার জন্মালেই কেবল পাশাপাশি হাঁটা যায়।
ঢোকার দরজায় অভ্যর্থনায় স্বাগতম জানানো হলো। ভেতরের স্পট লাইটগুলোতে একটা মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। শিহাব শায়লা রেস্টুরেন্টের মাঝামাঝি একটি টেবিল ফাঁকা পেয়ে এগিয়ে গেলো। মৃদু আলো আঁধারিতে সবার চাপা স্বরে কথা বলা আর ওয়েটারদের ব্যস্ততায় চলাচল। একেবারে লাঞ্চের পিক টাইম চলছে।শিহাব শায়লাকে বসতে অনুরোধ জানালো। যেহেতু শিহাব আজ হোস্ট তাই তাকেই কাজটি করতে হবে। আচার ব্যবহারে শিহাব বেশ মার্জিত। শায়লা এ ক'দিনের পরিচয়ে সেটা বেশ বুঝেছে। অভিনয় দু'একদিন করা যায়।কিন্তু যেটা যার মজ্জাগত সেটা আপনিতেই বেরিয়ে আসে। শায়লা শিহাব মুখোমুখি বসলো।শায়লার ভেতরে একটু ইতস্তত ভাব এলেও পরক্ষণেই পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিলো। তার প্রতি শিহাবের
যতখানি আস্থায় আজ তারা এখানে এসেছে তার প্রতিদানে শিহাবের সম্মান রক্ষা করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ওয়েটার এগিয়ে এলো। শিহাব মেনু চার্ট দেখে নিজের জন্য একটা থাই স্যুপ আর কোক অর্ডার করলো আর শায়লা কিছু বলার আগেই শিহাব শায়লার জন্য একটা ফুল কোর্স লাঞ্চ অর্ডার দিলো।শায়লা চোখের ভাষায় বাধা দিতে চাইলেও শিহাবের দৃঢ়তার কাছে নীরব রইল।
শিহাব শায়লাকে জানালো আজ সকালে বেশ নাস্তা করা হয়েছে।ইন ফ্যাক্ট একেবারেই ক্ষুধা নেই।তবুও লাঞ্চ টাইম কিছু খাচ্ছি।তবে তুমিতো শপিং করে ক্লান্ত আরো সময় হয়তো বাইরে থাকবে।একটু ভরপেট কিছু খেয়ে নাও। আর তাছাড়া,বলেই শিহাব একটু থামল।শায়লা শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলো।শিহাব বুঝতে পেরে কথা এগিয়ে নিলো। তাছাড়া আজ আমরা বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানে বসবো। তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে শায়লা।তোমার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা কথা বলবো। শায়লা ভেতরে শংকিত হয়ে উঠলো! কি বলতে চাইছে শিহাব? সে কি কোন সিদ্ধান্তে আসতে চাইছে, সেকি তবে রিশতিনার শূন্যতাটিতে আমাকে ভাবছে। শায়লার ভেতরে অস্থিরতা উঁকি দিচ্ছে।
শিহাব তাকে আশ্বস্ত করলো,না,না, তেমন ভয়ের কিছু নয়। তোমার আমার এই চলমান সম্পর্কটা ভালভাবে বুঝে নিতে।
শায়লা এবার কথা বলে উঠলো! কি রকম?
দেখো শায়লা, বর্তমান যুগে মোবাইলের কারণেই তোমার আমার পরিচয়।আর সময়ের সাথে আমরা একসাথে চলছি দেখা হচ্ছে কথা বলছি।কথায় কথায়া আমরা আমাদের নিজেদের জানিয়েছি, পরিবারকে চিনিয়েছি, সময়ে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোও কেউই লুকাইনি। তবে,তুমি আমি কেউই অনুভুতিহীন নই। দুজনার মনের ভেতর নানান ভাবনার উঁকি দিতেই পারে। আমি তা অস্বীকার করিনা।কেননা যার যেখানে শূন্যতা সে সেটা সবসময়ই চাইবে পূর্ণ করতে।আমরা সবাই ভালোবাসার কাঙাল।তোমার আমার অতীতে যা ঘটে গেছে তা আমাদের দুজনারই নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। কিন্তু সেটাকে অস্বীকারও করা যাবে না। তাছাড়া তুমিও একটা বন্ধনে আবদ্ধ।কানাডায় একজন তোমার অপেক্ষায়। পরিচয়ে শুরুতেই বলেছিলাম আমার প্রতি
অন্য কিছু চাওয়া পাওয়ার আশা করা যাবে না। সম্পর্কটি বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা তুমি ছাড়া আর কোন মেয়ের সাথে আমি কথা বলি না।
শায়লা একমনে সব শুনে যাচ্ছিল।শিহাব কি বলতে চাইছে শায়লা বুঝলেও সে শেষটা শোনার অপেক্ষায়।
শিহাব বলেই চলেছে, তবে তোমাকেও যে আমি কোন দূর্বল মূহুর্তে কাছে পেতে চাইনি মিথ্যে করে সেটা বলবো না। আর যখনই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছিল আমি খুব বুঝতে পারলাম তোমাকে আমি নিজের করে পেতে চাইছি। আর ভেতরেও তাই নানান ইচ্ছারা ডালপালা মেলছে। একজন পুরুষ হয়ে এই একাকী জীবনে কাউকে পেতে চাওয়া নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়।ঠিক তখনই আমি ভেবে নিলাম,নাহ, ভাবনাটা ঠিক হচ্ছে না। নিজেকে থামাতে হবে। তবে চলার শুরু হতে হয়তো সময় লাগে কিন্তু একবার তা চলতে শুরু করলে আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
টেবিলে খাবার চলে এলো। শায়লার আর কিছুই ভালো লাগছে না। সে বেশ বুঝতে পারলো শিহাব কি বলতে চাচ্ছে।শিহাব বেশ গুছিয়েই সব বলেছে। ছেলেরাতো কতভাবেই মেয়েদের সাথে মিথ্যে ভালবাসার অভিনয় করে আনন্দ ফুর্তিতে সময় কাটায়।তারপর আরেকজনকে পেলে তাকে ছেড়ে যায়।কিন্তু শিহাব কখনোই তাকে সেভাবে,,,
এই যে আজো এত সুন্দর করে, সুন্দর একটা পরিবেশে এনে সব গুছিয়ে বলছে, শায়লা ভাবছে এ সম্মানটাইবা কয়জন দেখায়!
তবে এই যে দুজনের আকুলতায় একই সময়ে একই অনুভব হওয়া সেখানেতো
দুজন একই সাড়া পেয়েছি।কেন তবে সেটা হলো।কেন তবে শিহাবের যে রাতে প্রচন্ড জ্বর এলো শায়লার তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে হলো।কেন তবে একটা অজানা অচেনা মানুষ এত দ্রুত আপন হয়ে গেলো। কেন সে শিহ্যবের উপস্থিতি টের পায়,কেন দুজনের মান অভিমানে অভিযোগ করা,,
কথাগুলো শায়লার ভেতরে তোলপাড় করছে।
কিন্তু ওপ্রান্তে শিহাব যে থামছে না, সে বলেই চলেছে,,
শায়লা,আমাদের পথ ভিন্ন তবুও মনের যে আকুলতায় আমরা কাছে এসেছি সেটা মিথ্যে নয় আর কোনদিন তুমি বা আমি সেটা অস্বীকার করতে পারবো না।তবে সেটা এখানে এ পর্যন্তই থামাতে হবে শায়লা। আমরা শুধু খুব ভালো বন্ধু হয়েই থাকবো।
চাওয়া পাওয়ার ধাপ থেকে একটি ধাপ দূরে থাকবো। তবে পরিচয়টা থাকুক আজীবন।
শায়লা গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।
শায়লা তুমি কিছু খাচ্ছ না। সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শায়লা খেয়াল করলো টেবিলে স্যুপ সার্ভ করা হয়েছে। শিহাব হাত আগাতেই শায়লা স্যুপের কমন বাটি থেকে শিহাবের বাটিতে ক' চামচ স্যুপ তুলে দিলো সাথে নিজের জন্যও নিলো।শিহাব এক দৃষ্টে শায়লার দিকে তাকিয়ে রইল। শায়লার চোখ জলে ভরা। তবুও মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা।শিহাব বেশ বুঝতে পারছে শায়লার ভেতরে কি চলছে। শিহাব ভুলেই গেছে সে কোথায় বসে আছে।কল্পনায় সে শায়লাকে তার বাসার ডাইনিং এ ভাবছে।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much