ইউএন মিশনে হাইতিতে গমন
( ৬ষ্ঠ পর্ব )
মোঃ হাবিবুর রহমান
বিশ্রামের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু চোখ যেন কাঠ হ'য়ে গিয়েছিলো তাই শুধুমাত্র চোখ বন্ধ ক'রে নিজের মনকে বুঝ দেওয়া আরকি! মানুষের কোন কোন সময় এরকম সময় আসে বিছানার কথা মনে মনে চিন্তা ক'রলেই বুঝি ঘুমানোর আগেই ঘুম এসে যায় কিন্তু বিছানায় যেয়ে ঘুমতো আসেই না এমনকি জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের পরামর্শ অনুসরণ করে ১০০ থেকে উল্টোগুণে ০ (শুন্য) পর্যন্ত মনে মনে বার বার গুনতে-গুনতে মুখে ফেণা তোলার পরও কোনক্রমেই ঘুম আসেনা; কোনো কোনো সময় ঘুম যেন একেবারে নির্বাসনে যায় কিংবা ছয় মাসের জন্য ব্যাঙের মত একবারে শীতনিদ্রায় চ'লে যায়। ঠিক যেন এমনটিই হ'য়েছিলো সেদিন আমার।
এরই মধ্যে আবার বঙ্গদেশে কয়েকঘণ্টা আগে ফেলে আসা অতি আপনজনদের মলিন অবয়বগুলো মনের গভীরে বার বার ছায়াসদৃশ আবির্ভূত হ'য়ে অস্পষ্ট ছবির মত মনের মণিকোঠায় এসে ঘন ঘন কড়া নাড়ছিলো আর সাথে সাথে মনটা বিষাদে ভ'রে উঠছিলো। তখন সেই মুহূর্তে শুধু কেবলই মনে হ'চ্ছিল আহারে! টাকা-কড়ি তুই আমার কাছে অতি তুচ্ছ আর অতি নগণ্য!
বার বার কেবলই মনে হ'চ্ছিল আহা! যদি আপনজনদের সাথে কথা ব'লে অন্ততঃ একবার হ্যালো ব'লতে পারতাম তাহ'লে কতই না ভালো হতো! কিন্তু সে স্বপ্ন তখন বাস্তবে যে রুপ নেবে না তা জেনেও যেন শুধুমাত্র কল্পনার জগতটাই তখন উপভোগ করার নেশায় ধ'রেছিলো। যোগাযোগের বিড়ম্বটা আমার পরের ধাপে মার্কিন নেভী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্যাম্প সান্টিয়াগোর বাস্তবতায় চিত্রায়িত করার সুযোগ পাবো, ইনশাল্লাহ।
যাক, অনেক দর্শন বিষয়ক কথাবার্তা হলো কিন্তু এখনও তো আসল কথার একটা শব্দও শব্দায়িত হয়নি; এমনিতেই আজ আমার এক শ্রদ্ধেয়া ফেইস বুক বন্ধুর মন্তব্যে কলিজাটা ঝাজরা ও ক্ষত-বিক্ষত হ'য়ে গেছে, আমি নাকি বেশী কথা বলি, তাই আর না বাবা, ন্যাড়া বেল তলায় একবারই যায় কিন্তু স্বভাব কি অতি সহজে পাল্টায়?
এরই মধ্যে এরকম আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে কখন যে প্রায় তিন ঘণ্টা পার ক'রে ফেলেছি তা একেবারেই টের পায়নি। আবার মার্কিনী সার্জেন্ট সাহেব এসে বাংলাদেশের মিলিটারী সম্বন্ধে বাজে মন্তব্য ক'রবে ভেবে একেবারে তড়িঘড়ি ক'রেই নিজেকে মিলিটারী সাজে সাজিয়ে নিলাম।
হা, এইতো মার্কিনী ওস্তাদ বুঝি এসে গেছে, এখনই যেন তার সেই তিন-চার লাইন গদবাঁধা ইংরেজী শুনিয়ে দিয়ে আমাদেরকে ধন্য ক'রবে। হা, এইমাত্র কলিং বেল বেজে উঠলো, একই ভঙ্গিমায় বাপধনের মুখে তোতা পাখির বুলি উচ্চারিত হলো;
"Sir, I think you have enjoyed your rest hour, I am sorry sir, this is the time you need to hurriedly go to Honolulu International Air Port. Sir, please get down to the ground floor, your bus is ready, board on to the bus and soon we will move to airport, kindly do hurry up as the time is very short".
একজন সার্জেন্ট টোকাই ক'রবে বাংলাদেশী অফিসারদের? মান-সন্মান আর ইজ্জ্বতের ভয়ে তাই আমরা সব লেভেলের অফিসাররাই খুবই সিরিয়াস, তার সে সুযোগ পাওয়া থেকে তাকে বেশ কয়েকবারই ইতিপূর্বে বঞ্চিত ক'রেছি, এবারেও তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি যে, বঙ্গীয় মিলিটারী অফিসাররা কত সচেতন আর দায়িত্বশীল, আর এজন্যই বুঝি সেদিন বাংলাদেশের নামটি তারই মাধ্যমে অন্যান্য মার্কিনীদেরকে একটা অত্যন্ত পরিষ্কার ধারণা দিতে পেরেছিল যা হয়ত তারা তাদের জীবদ্দশায় আজীবন ধারণ ক'রবে।
যাহোক, নিজ কামরা থেকে নেমে সবাই বাসে উঠা মাত্রই যেন চালকের কেরামতিতে একেবারে ভোঁ-দৌঁড় দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। অতঃপর সেই মার্কিনী সি-৫, আকাশ পথের রাজা ইতোমধ্যেই তার প্রাথমিক ওয়ার্মাপ শেষ ক'রে শেষ দৌঁড় দেওয়ার অপেক্ষায় শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ কক্ষের আদেশের অপেক্ষায় যেন প্রহর গুণছে।
দায়িত্বপ্রাপ্ত পূর্বের সেই বাংলাদেশী সার্জেন্ট ইতোমধ্যে আমাদের সবুজ রংয়ের পাসপোর্টগুলো এক এক ক'রে হাতের ভিতর আবার গুজে দিয়ে বললো, "স্যার, এখন থেকে ঠিক আনুমানিক এগার ঘন্টা পর পোর্টোরিকো আন্তর্জাতিক এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করার ঠিক পূর্বমূহুর্তে আমি আপনাদের কাছ থেকে একইভাবে এটা সংগ্রহ ক'রে নেবো। ইমিগ্রেশনের জন্য এটার প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ এটা আপনাদের কাছেই সযত্নে নিজ হেফাজতে রাখুন"।
এরই মধ্যে পাইলট অতি সুকৌশলে জায়ান্ট আকাশযানটি কোনরকম ঝুটঝামেলা ব্যতীতই রানওয়ের মাঝামাঝি মাঝারী গতিতে নিয়ে আসতে সমর্থ হ'য়েছেন। আস্তে আস্তে যে গতি বাড়ছে তা প্লেনটির দৌড়ের ব্যস্ততা দেখেই অনুমান ক'রতে পারছিলাম।
হা, আকাশে উঠে গেছি, একেবারে হনুলুলুর ঠিক মাথার উপর দিয়ে উড়াল দিয়েছি। দোওয়া-দরূদ পড়ে আল্লাহপাকের নামে আকাশপথে পথ চলা শুরু হলো অজানা-অচেনা পোর্টোরিকো মার্কিনী অঙ্গরাজ্যের অভিমুখে। রেস্ট-রিফিট পূর্ণমাত্রায় হওয়ায় আমাদের মনটাতে বেশ ফুরফুরে ভাব বজায় থাকায় তখন পর্যন্ত আকাশ ভ্রমণটা বেশ মজাই লাগছিলো।
এরই মধ্যে অনেকটা হঠাৎ ক'রেই বুঝি সূর্যি মামা অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে সবাইকে একরকম ফাঁকি দিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিরুদ্দেশ হ'য়ে গেলো। তাই সূর্যি মামার এরূপ নিঃশব্দ প্রস্হানে আমরা সবাই এ মুহূর্তে যেন চরমভাবে ব্যথিত, বিমর্ষ ও হতবম্ভ হয়ে গেলাম।
চলবে............
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much