ধারাবাহিক উপন্যাস
শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ৯৩)
শামীমা আহমেদ
খুবই অনিচ্ছা সত্বেও শিহাব দোতালার
হাসান সাহেবকে তার ঘরে প্রবেশের জন্য স্বাগত জানালো। যদিও এই মূহুর্তে শিহাবের মনের সবকিছু ভীষণ এলোমেলো হয়ে আছে তবুও সামাজিকতা মেনে হাসান সাহেবের সাথে কিছু কথা চালিয়ে যেতে হবে। বিল্লাল খাবারের ট্রে ডাইনিং টেবিলে রাখলো। হাসান সাহেব বিল্লালকে তার খাবার নেয়ার জন্য বাসায় যেতে বললে বিল্লাল বিদায় হলো। এবার শিহাব, হাসান সাহেবকে উদেশ্য করে বললেন, এসবের কী দরকার ছিলো ? আর আমি একা মানুষের জন্য এত খাবার !
এবার যেন হাসান সাহেব তার মনোবাসনা প্রকাশের একটা মওকা পেলো। খুবই বিগলিতভাবে বললেন, না, না,এ আর এমন কি।আজকের সামান্য আয়োজন। প্রতিদিন তো আর এমনটা হয়না।
সামান্য আয়োজন ! শিহাব অবাক হলো, এই যদি হয় সামান্য আয়োজন তবে অসামান্য বলতে কী বুঝবো ? শিহাব শুনেছে,
হাসান সাহেব একটা ওষুধ কোম্পানীতে চাকরী করেন।স্বল্প বেতনভোগী হলেও নানান হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সাথে তার দারুন সখ্যতা।সবার সাথেই কমিশন পাইয়ে দেয়ার আর নিজের পকেটে ভরার লাইনঘাট তার ভালই জানা। ছেলেকে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াচ্ছে যা ভীষণ ব্যয়বহুল।
শিহাব আরাফের কথাও একঝলক ভেবে নিলো।আরাফকেও স্কুলে দিতে হবে।আরাফের তিন শেষ হয়ে চা'রে পড়েছে।
হাসান সাহেব কিছু একটা বলার জন্য যেন উসখুস করছেন। কিন্তু অনেকরাত হয়ে গেছে।শিহাব এখনো খায়নি তাই কথা শুরুও করতে পারছে না। কিন্তু শিহাব বুঝতে পারছে এমনি এমনি তিনি তার বাসায় আসেননি।নিশ্চয়ই কিছু একটা বলার অভিপ্রায়ে এত কিছুর অবতারণা।
শিহাব তাকে সহজ করতে বলে উঠলো, হাসান সাহেব, কিছু বলবেন ?
না না তেমন কিছু না। আপনি খেয়ে নিন। আমি ড্রইং রুমে বসছি। বলেই তিনি উঠতে চাইলেন। শিহাব বললো,না,এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। সন্ধ্যায় ভাবী অনেক নাস্তা করিয়েছে। সেগুলোতে এখনও পেট ভরে আছে।
তক্ষুনি যেন হাসান সাহেবের শিহাবের সেই কথা মনে পড়ে গেলো, আচ্ছা তখন আপনি বলছিলেন আপনার পরিবারের কে যেন অসুস্থ ? আপনার মা ?
না, না, আমার মা ভালো আছেন। শিহাব যতই কথা সংক্ষিপ্ত করতে চাইছেন কিন্তু হাসান সাহেব বারবার আঠার মত লেগে থাকতে চাইছেন।শিহাব বুঝতে পারছে নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তার এখানে আসা।
তাহলে কে অসুস্থ ? আপনার বাবা ?
তার আবার প্রশ্ন।
এবার শিহাব তাকে শান্ত করতে জানালো, আমার ছেলে আরাফ। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কপালে কেটে গেছে। হাসপাতালে আছে।
শুনে হাসান সাহেব ভীষণ ব্যথিত হলেন। আহা ৷ এত ছোট বাচ্চাটা। তা শিহাব সাহেব বাচ্চার মাকে কি খবর দিয়েছেন ? শুনেছি উনি দেশের বাইরে থাকেন। শিহাব বুঝতে পারলো, সব খবরই সে রাখে তাহলে।
শিহাব বেশ স্পষ্ট করেই বললো, না জানাইনি।
এবার যেন তার আফসোসের পাল্লা বোঝাই হলো।আহা,মা ছাড়া বাচ্চাটা এমন ব্যথা পেলো। তা আমি শুনেছি, উনি এখানে এসেছিলেন। দুদিন থেকে চলেও গেছেন। আপনি নাকি তাকে চলে যেতে বলেছেন।
শিহাব এবার ভীষণ অবেক হলো!ঘরের কথা বাইরে জানলো কিভাবে ?
শিহাবের মনে কৌতুহল হতেই সে সন্দিগ্ধ মনে জানতে চাইলো, আপনি কিভাবে জানলেন এইকথা ?
হাসান সাহেব এবার যেন ধরা পড়ে গেছেন এমন অভিব্যক্তি দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে তার স্ত্রীর উপর তা চাপিয়ে দিলেন,, ইয়ে মানে,আপনার ভাবী বলেছে । যাওয়ার সময় আপনার মিসেস, বিল্লালকে বলে গেছে,উনি একেবারেই চলে যাচ্ছেন।বিল্লাল যেন তার স্যারকে দেখে রাখেন। এবার শিহাব বুঝতে পারলো,তাহলে বিল্লালই হচ্ছে সবকিছুর মেসেঞ্জার। শিহাব বুঝতে পারছে না, অন্যের ব্যাপারে মানুষের কেন এত কৌতুহল !
এবার হাসান সাহেব তার মনের কথাটা বলার জন্য যেন উপযুক্ত যুক্তিটা খুঁজে পেলেন। তিনি অকপটে বলেই ফেললেন, দেখুন আপনার স্ত্রী এত ছোট একটা বাচ্চা রেখে চলে গেছেন,আপনিও একা একা কষ্ট করছেন। এভাবে আর কতদিন থাকা যায় বলুন। ঘর সংসার তো করতে হয়। বাচ্চাটাকেও তাহলে কাছে এনে রাখতে পারতেন। শিহাব হাসান সাহেবের কথায় বেশ অবাক হচ্ছেন ! মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে এ দেশের মানুষ অনুমতি নেবারও প্রয়োজন মনে করে না।
হাসান সাহেব বলেই যাচ্ছেন, তা আপনার ভালোর জন্যই একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম।যদি সহজভাবে নেন তো বলতে পারি।
শিহাবের প্রান্ত থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই তিনি বলে চললেন,আমার শ্যালিকা চৈতীকে তো একটু আগেই দেখেছেন।
শিহাব কিছুক্ষন আগে হাসান সাহেবের দরজায় কথা বলার সময় একটি মেয়েকে দেখেছিল। তাহলে তার নাম চৈতী !
শিহাবের আর বুঝতে কিছু বাকী রইল না। হাসান সাহেবের আগমনের হেতু আর ইনিয়ে বিনিয়ে এত কিছু বলার পেছনের কারণ।
শিহাব ভাবলো, ঐটুকু মেয়ে মাত্র মাস্টার্স পড়ছে কেমন করে এরা আমার সাথে এমন সম্পর্ক ভাবে ? শিহাবের ভাবনা শিহাবের মনের ভেতরেই রইল।
হাসান সাহেব বললেন,নাহ,এখুনি কিছু জানাতে হবে না।আপনি সময় নেন। হাসান সাহেব হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, বলছিলাম কি,ওরা দুইবোন, এক বিল্ডিংয়ে থাকলে ভালোই হতো।বাপ মা মরা ওরা এই দুটি বোন। আর আপনাকেও আমি ভায়রা করে নিতে পারলে আমি খুবই খুশী হতাম! আপনাকে আমার খুবই পছন্দ শিহাব সাহেব।এতদিন হয় আপনি এখানে আছেন কোনদিন কোন খারাপ কিছু শুনিনি। এতসব কথা বলে এবার হাসান সাহেব শিহাবের ফ্ল্যাট থেকে বেরুনোর জন্য আগালো।পরক্ষণেই তিনি তার শ্যালিকার দুইটি থ্রী আর সাইজের রঙিন ছবি শিহাবের বিছানায় বালিশের পাশে রেখে গেলেন। শিহাব বাধা দিয়ে কিছু বলতে চাইতেই হাসান সাহেব শিহাবের বাসা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। শিহাব ভাবলো,এতো দেখছি আরেক মহা যন্ত্রণা ! শিহাব এগিয়ে গিয়ে ছবি দুটো হাতে নিলো। একটি ছবিতে ডাগর চোখের মেয়েটি রঙিন ঝলমলে শাড়িতে তার কলেজের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে, আরেকটি ছবিতে ঘরে সোফায় বড় বড় চুল ছেড়ে গালে হাত দেয়া ভঙ্গিমায় মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।শিহাব মনে মনে ভাবলো, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলেও আজো মেয়েদের বিয়ের পাত্র খোঁজে সেই সনাতন প্রথা রয়ে গেছে। শিহাব ছবি দুটো উল্টো করে তার সাইড টেবিলে রেখে দিলো। তবে একবার ভাবলো, এখুনি বিল্লালকে ডেকে ছবি দুটো ফেরত পাঠাতে।কিন্তু এতে তারা অপমানিত বোধ করতে পারেন। কাল সকালেই তবে ফিরিয়ে দেয়া হবে। শিহাব ছবি দুটো খাটের সাইড টেবিলে রাখতেই তার মোবাইলের দিকে চোখ পড়লো। হাতে নিতেই দেখতে পেলো,মোবাইল একেবারে ডার্ক এন্ড ডেড হয়ে আছে। তার মনে পড়লো হাসপাতালে থাকতেই ফোনের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। এসে আর হাসান সাহেবের জন্য চার্জে দেয়ার একটু সময় মিলেনি। আরাফেরও খবর নেয়া হয়নি।শিহাব দ্রুতই মোবাইল চার্জে লাগিয়ে দিলো। টেবিলের খাবার সব ফ্রিজে তুলে রেখে সময় দেখলো,রাত বারোটা। শিহাব একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।শায়লার কথা খুব মনে পড়তে লাগলো। শায়লা নিশ্চয়ই তার স্বামীর সাথে এখন গল্প করছে। কিন্তু কেমন করে শায়লা তাকে এভাবে ভুলে আছে? এ কথা ভেবে শিহাব ভেতরে অস্থিরতায় খুব ঘন ঘন সিগারেটে টান দিতে লাগলো।
রাহাত অনেকবার ফোন করেও শিহাবের মোবাইলে কল পৌছাতে পারেনি।বারবার তা বন্ধ পাচ্ছিল। রাহাত একথা শায়লাকে জানাতে শায়লা ভীষণ চিন্তিত হলো।সে নিজেও কয়েকবার ট্রাই করে শিহাবের মোবাইল বন্ধ পেলো। শিহাব বাইক চালিয়ে চলাচল করে। পথে কিছু হলোনাতো আবার ?
শায়লা অজানা আশংকায় কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন না ঘটে মনে মনে এমনটি ভাবছিল। বুবলী অনেক অনুরোধ করে শায়লার মুখে একটু খাবার দিয়েছে। শায়লা তার নিজের ঘরে সাজানো খাটের এক কিনারায় শুয়ে রইল। দেয়াল ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখলো রাত্রি বারোটা। শায়লা ভীষণ অবাক হলো, আজ দুপুরের পর থেকে শিহাব তার সাথে একেবারেই যোগাযোগে নেই । তবে কী আরাফ বেশী অসুস্থ হলো ?
শায়লা কিছুই বুঝতে পারছে না কি করবে ? সারাটাদিন নানান ঘটন অঘটনের মধ্যে দিয়ে কেটেছে।কিন্তু এমনি ভাবে শিহাব কোনদিনই নীরব থাকেনি। শায়লা শিহাবের অফিস থেকে পাঠানো শিহাবের কালো শার্ট পরা সেই সেল্ফিটির দিকে একমনে তাকিয়ে রইল।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much