একটু পরেই গান থেমে গেল। শিখা বাথরুমের দিকে গিয়ে দেখল, লম্বা লাইন আছে ।সে আস্তে আস্তে ড্রয়িংরুমে এসে বসলো। আনমনে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছে।
এমন সময় বৌদির গলা শোনা যাচ্ছে। শিখা শিখা শি.ই.খ.আ। উঠে পড় অঞ্জলি আছে কিন্তু?'
শিখা সাড়া দিল'বৌদিভাই আমি উঠে গেছি'।
মাধুরী বলল 'বাথরুমে চলে যা।( চিৎকার করে )
শিখা বলল 'আমি লাইনে আছি।'
এদিকে নিউজ পেপার উল্টাতেই একটা ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল ।কাছে নিয়ে দেখল। আরে এ তো কল্যাবাবুর ছবি? কল্যান বোস ডিলিট উপাধি পেয়েছেন। শিখা ছবিটা বার বার দেখতে লাগলো আর ভাবলো কল্যানবাবুর কত গুন। এরকম লোকের সান্নিধ্য পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এমন সময় হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখে কল্যানবাবু। এ যেন শিশির স্নাত শিউলি ভোরে মনের ভেতরে যে ডাক দিয়েছিল, তার স্পষ্ট ধ্বনি শোনার জন্য ই যেন অপেক্ষমান ছিল।
শিখা বুঝে ওঠার আগেই কল্যান বলল 'ঘুম হয়েছে রাত্রে?'
শিখা বলল (মনের কথাটা লুকিয়ে) ' হ্যাঁ'
কল্যাণ বলল 'তাই? আপনার চোখ দুটো দেখে তো মনে হচ্ছে না ।মনে হচ্ছে সারারাত ঘুম হয় নি ।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ কেন? কার চিন্তা করছিলেন?'
শিখা একটু চমকে ওঠার মত বলল, 'আসলে একটু বেশি রাত্রে শোওয়া হয়েছে তো ,রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি।'
কল্যান বলল ' ঘুম না হলে মন মেজাজ ভালো থাকে না।'
শিখা বলল ' আচ্ছা বলতে পারেন, সকাল বেলায় গানটা কে করছিলেন?'
কল্যান বলল 'কেন গানটা আপনার ভালো লাগেনি?'
শিখা বলল 'অসাধারণ লেগেছে ।কিন্তু গানটা পুরোটা শুনতে পেলাম না ।এজন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, আফসোস ও হচ্ছে।'
কল্যাণ মুচকি মুচকি হেসে বলল ' আসলে শিল্পী মানুষ তো নয় ,এ জন্য সাহস করে পুরোটা গাওয়া হলো না।'
শিখা এবার দাঁড়িয়ে পরলো এবং উচ্ছসিতভাবে বলল 'আপনি গাইছিলেন ?অসাধারণ। অপূর্ব লেগেছে। এত ভালো গান করেন আপনি ?আপনার কত কোয়ালিটি আছে বলুন তো, একটু ধার দিতে পারেন?'
কল্যাণ বলল ,'একটু আধটু করা হোত আগে।'
শিখা বলল 'আপনি গানটা কিন্তু ছাড়বেন না। আপনি চালিয়ে যান।'
কল্যান বলল 'তাই?
শিখা বলল 'একদম।'
এরইমধ্যে বৌদি আবার চিৎকার করে ডাকে 'শিখা তোর কিন্তু রেডি হতে সময় লাগবে ।আজকে তো শাড়ি পরবি বলছিলি?'
শিখা বল 'হ্যাঁ ,যাই বৌদিভাই।'হুটোপুটি করে যাওয়ার
সময়ে শিখার দাদার সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। মনোজ ফোনে কথা বলতে বলতে ড্রইং রুমে র দিকে ঢুকছে তখন বলল ' হ্যাঁ র, শিখা, কবে যে তুই হাত পা ভাঙ্গবি, একটু দেখে শুনে চল।? ধরে তোলে আর বলে একটু বসে যা।'
অন্যদিকে সুরঞ্জন ফোনে কথা বলছিল ' মনোজ রেখাকে নিয়ে আয় না ,এখানে খুব মজা হবে?'
ওপার থেকে কণ্ঠ ভেসে আসছে 'কোথায়?'
সুরঞ্জন বলল 'আমার শ্বশুর বাড়ি। গেদে।'
মনোজ বলল 'তুই কি খেপেছিস ,আমি তোর শ্বশুর বাড়িতে যাব? তাছাড়া রেখার হবে না।'
সুরঞ্জন বলল 'মাধুকে দিয়ে ফোন করাচ্ছি।
মনোজ বলল 'কবে এসেছিস ?তার থেকে আমার বাড়িতে চলে আয়।'
সুরঞ্জন বলল 'ষষ্ঠীর দিন'।
শিখা কল্যাণের দিকে তাকিয়ে বলল ' আচ্ছা আমি যাই রেডি হয়ে নিই।'
সুরঞ্জন বলল 'বৌদি কিন্তু এবার রেগে যাবে। বৃষ্টি কিন্তু রেডি হয়ে গেছে। তুই এখনো রেডি হতে পারলি না। 'আবার সুরঞ্জন আর মনোজ কথা বলেই যাচ্ছে ফোনে। কল্যান ম্যাগাজিন পড়তে লাগল এবং নিউজ পেপারের নিজের ছবিটা দেখে খুব খুশি হল।
এমন সময় মন্ডপ থেকে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে যারা অষ্টমীর অঞ্জলি দেবেন ,তারা অবশ্যই প্যান্ডেল এসে হাজির হোন।
সবাই অষ্টমীর অঞ্জলি জন্য প্যান্ডেলে গিয়ে হাজির হল।
শিখা তখনও রেডি হতে পারে নি। কল্যান মণ্ডপে গিয়ে বারবার বাড়ির দিকে তাকাতে লাগলো।
হঠাৎই কল্যাণের নজর আটকে গেল শিখার দিকে ।শিখা সবুজ হ্যান্ডলুম শাড়ি, রেড সার্টিনের ব্লাউজ আর হ্যান্ডমেড জুয়েলারি পড়েছে। অষ্টমীতে ম্যাক্সিমাম শাড়ি লাল পেড়ে অথবা হলুদ শাড়ি পড়ে অঞ্জলি দেয় কিন্তু শিখা যেন একটু অন্য লুকে ধরা দিল। এ যেন স্বর্গের থেকে অপ্সরা নেমে এসেছে মনে হল কল্যানের। তৃষ্ণার্ত চাতকের বুকে শিখা যেন এক পশলা বৃষ্টি।
আর কাকতালীয়ভাবে দেখা গেল কল্যাণও সবুজ পাঞ্জাবি পড়েছে।
বারোয়ারি প্যান্ডেলে সকলে যেন কল্যান আর শিখাকেই দেখছে।
যথাসময়ে অঞ্জলি পর্ব শেষ হলে সন্ধি পূজার জন্য প্রস্তুতি চলছে । সন্ধিপুজোতে প্রত্যেকে মোমবাতি জ্বালছে।তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শিখা বলল 'একটা দিন তো আমিও জ্বালি।'
মাধুরী বলল 'এই কল্যাণ এসো প্রদীপ জ্বালো। প্রদীপের শিখায় সব মঙ্গল হোক ।তোমাদের পরের বার যেন জোড়ায় দেখি।'
মাধুর বৌদি সরজু বলল 'আমিও দুর্গা মায়ের কাছে এই প্রার্থনাই করছি রে মাধু। জোড়ায় দেখতে পারলে তবেই আমি খুশি।'
কল্যান বলল ' শিখা আপনি জ্বালান।'
দুজনে মিলে একসঙ্গে প্রদীপ জ্বাললো ,মায়ের কাছে প্রার্থনা করল।
এর ই মাঝে শিখার বৌদি কল্যানকে বলল ' আমি শিখাকে 'আপনি' করে ব'লো না তো ,ও অনেক ছোট।'
কল্যাণ বলল 'আসলে তা নয় বৌদি। এইটুকু সম্মান তো দিতেই হয় ।ঠিক আছে এরপর থেকে তুমি করেই বলবো।'
সন্ধিপূজা শেষে কল্যান মাধুকে বলল- 'বৌদি আশেপাশে কটা ঠাকুর হয়েছে ?'
মাধু বলল 'আগে তো বেশি হতো না ।এখন নাকি বেশ ভালই হয় ।দেখবে ?যাও না ঘুরে এসো। '
কল্যান বললো 'কিন্তু আমাকে তো একজন সঙ্গী দিতে হবে ।'
মাধু বলল' চেনা সঙ্গী নেবে? না অচেনা সঙ্গী নেবে?'
কল্যাণ বলল 'যেটা ভালো বুঝবেন বৌদি।'
মাধুরী বলল 'তাহলে এক কাজ করো ,তুমি বরং শিখা কে নিয়ে যাও ।গ্রামের পুজো ও দেখে নি কখনো। একটু ঘুরে আসুক।'
শিখা বলল 'আমি বৌদিভাই?'
মাধুরী বলল 'কেন তুই গ্রামের ঠাকুর দেখবি না? যা না ,কল্যাণের সাথে ।'
বৌদি বলল ' একটা বাইক দেবো?'
শিখা বলে 'বৌদি ভাই আমি কিন্তু বাইকে যাব না হেঁটে যাবো।'
কল্যান বললো 'পায়ে হেঁটে দেখার মজাই আলাদা সবুজ স্পর্শ করে গায়ে মেখে নেবো।শহর মানেই 'হাঁ করে সবুজ খায়'।
শিখা মনে মনে ভাবল কথায় কথায় শুধু কবিত্ব। এটাতো যতদূর সম্ভব শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা র লাইন। না বাবা বলবো না ।প্রফেসর মানুষ ।যদি ভুল ভ্রান্তি হয়।
মাধুরী বললো ' তা বেশ বেশ।'
কল্যান শিখা হাঁটতে শুরু করল।
কল্যান বলল 'হঠাৎ বি এড করতে গেলে কেন? ? তার চেয়ে 'নেট' বা 'সেট' পরীক্ষায় বসো।'
শিখা বলল 'হ্যাঁ ,আমি ভেবেছি। আসলে ভেবেছিলাম বি এড টা করে নেব । তার মধ্যে যদি এসএসসি টা হয় ট্রাই করবো।'
কল্যান বলল ''তুমি' নেট সেট 'এর জন্য ট্রাই করো।''
শিখা বললো 'কিন্তু আমি যে বি এড এ ভর্তি হলাম।
'কল্যাণ বলল 'ঠিক আছে। ভর্তি হয়েছ? কিন্তু পাশাপাশি এটা পড়ো ।সামনেই দেখবে বলে নেট সেট পরীক্ষা । ক'দিনের মধ্যেই বিজ্ঞপ্তি বেরোবে। আমি জানিয়ে দেবো কবে বেরুচ্ছে।
শিখা বলল 'জানাই হয় নি আপনার কোন কলেজ?'
কল্যান বলল 'বারাসাত কলেজ।'
শিখা বলল 'ও আচ্ছা।আপনারা কি সুন্দর কলেজে পড়ান ।আমারও খুব ইচ্ছে করে যে আমিও প্রফেসর ...।'
কল্যান বলল 'মনের ভেতরে থাকতে হবে উচ্চকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য।তা পূরণের জন্য তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে ।তাহলেই স্বপ্ন পূরণ হবে ।স্বপ্ন দেখতে জানতে হয় ।জানো তো শিখা?
আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে জানি না ।তবে তোমার জন্য শুভকামনা থাকলো।'
শিখা বলল ' হ্যাঁ, এখানে এসে আপনার মত ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়ে আমি ধন্যা।'
কল্যান বলল ' তাই বুঝি?'
শিখা লজ্জায় মাথা নীচু করলো।
কল্যান বলল 'গ্রামে দেখো কত সবুজ গাছপালা । আর বলে উঠল প্রাণ চায় , চক্ষু চায় সবুজ গালিচায় বসি দুজনায় '
শিখাও বলল 'একটু ওখানটা যাব। জায়গাটি কী সুন্দর। সবুজ আর সবুজ। দূর্বাঘাসে অনেকদিন পর পা রাখলাম । মনে হচ্ছে সবুজ ই মনের ক্লান্তি দূর করবে।'
কল্যাণ বলল '"ঠিক আছে চলো "।
শিখা বলল ' কিন্তু কে, কি ভাববে?'
কল্যান বলল 'তুমি মনের দিক থেকে কতটা নির্মল সেটা আগে জানা দরকার। তবে সামাজিক রীতি-নীতি ,সংস্কার মানুষ তো অস্বীকার করতে পারে না।আমি তোমার কটা ছবি তুলে দিই।'
শিখা বলল 'আপনি দাঁড়ান । আমিও আপনার কটা ছবি তুলে দিচ্ছি।'
কল্যান বলল 'আরে না, না। আমি ছবি তুলতে লজ্জা পাই।'
শিখা বলল .'এটা কিন্তু ভারি অন্যায় বললেন।
কল্যাণ বলল ' কেন?'
শিখা বলল-'কেন আজকের নিউজ পেপারে আপনার ছবি বেরিয়েছে তো?তাহলে কি করে ছবি তুললেন? কনগ্রাচুলেশন্স। ভেবেছিলাম সকালবেলায় ই আপনাকে অভিনন্দন জানাবো ।তার জন্য সরি জানাতে পারি নি বলে।'
কল্যাণ বললো 'আসলে ওগুলো তো দিতেই হতো।'
শিখা বললো 'এই ছবিটা যখন দেখবেন হাজারো ভিড়ের মধ্যে একবারও হলেও আপনার মনে পড়বে কোন একদিন শিখা নামে কোন মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।'
কল্যাণ বলল 'সে তো আমার এমনিই মনে থাকবে ।স্মৃতি হবে কেন?'
শিখা বল 'না ,আপনার সঙ্গে কি আমার দেখা হবে বলুন?'
কল্যাণ বললো 'পৃথিবীটা গোল ।দেখা তো হবেই ফোন আছে তো কথা হবে ।তোমার যদি পড়াশোনার ব্যাপারে কোন হেল্প লাগে ।তুমি আমাকে ব'লো আমি নিশ্চয়ই তোমাকে সহযোগিতা করবো।'
যেতে যেতে শিখা বলল 'পাশের ওই ঠাকুর টা কি সুন্দর হয়েছে, না ?এখানেও ডাকের কাজ হয়েছে। একটি কি সুন্দর সাবেকিয়ানা আছে তাই না? এ বাবা,
অনেকদূর এসে পড়েছি কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে। চলুন এবার ফেরা যাক ।ওই দেখুন বলতে বলতে বৌদি কল করেছে '
'হ্যালো'
মাধু বলল 'আরে আয়। ভোগ খাবি তো ?আর কতদূর যাবি ।চলে আয়। ভালো লাগছে?,'(হাসি সঙ্গে)।
শিখা বলল 'হ্যাঁ বৌদি ভাই যাচ্ছি।'
কল্যান বলে-' ফেরা যাক। চলো ।সবাই চিন্তা করবে।' 'কল্যান বলল ' একটা গান শোনাবেন যেতে যেতে।'
শিখা বলল 'তাহলে কিন্তু আমার সঙ্গে আনাকেও গান গাইতে হবে ।রাজি ?তবে গাইতে পারি।'
কল্যান বলল 'আমি?'
শিখা বলল '( কেন নয়?'
কল্যান বলল 'আমি তো তোমার মতো গাইতে পারি না ঠিক আছে চেষ্টা করছি।
'যদি বন্ধু হও,যদি বাড়াও হাত / যেন থামবে ঝড়...রাঙা সূর্য বলবে সুপ্রভাত।'
কল্যান বললো 'প্রকত বন্ধুর অভাব'।বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।'
শিখা বলল ' হ্যাঁ ,একদম।'
কল্যাণ বললো (আবেগ ভরে) 'এরকম বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ।প্রত্যেকের জীবনে এরকম একজন বন্ধুর দরকার ,যে সুখে- দুখে, বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকে নিঃস্বার্থভাবে।'
কল্যান এবার হাতটা শিখার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল 'যদি বন্ধু হও...?'
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"২৯ক্রমশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much