একরাত্রি
( ১ম পর্ব )
রাত দুটা। কিন্তু এ বাড়ির একটি লোকও ঘুমাতে যায়নি। দুই বছরের ছোট্ট মেয়ে কুসুম সে পর্যন্ত গভীর চিন্তিত মুখ নিয়ে জেগে আছে। বাসার কাজের মেয়ে মরিয়ম সেও ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাঝখানে দাড়িয়ে ঘন ঘন হাই তুলছে। তার এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা অবশ্য কারোরই ভালোলাগছে না। তবু তাকে কেউ কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে এই বাড়িতে আজ আর কেউ কোনো কথা বলবে না । অদ্ভুত যাতনায় সবাই অপেক্ষা করছে আগামীকালের জন্য। আগামীকাল আফসারের মামলার রায় হবে।
আফসারকে খুব শান্ত লাগছে। রাবেয়া স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে কী ভাবল কে জানে ছোট্ট কুসুমকে কোলে নিয়ে বসিয়ে দিল তার কোলে। আফসার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবা শুরু করে দিল। তার সাজা হয়ে যাবে। পাঁচ বছরের জেল। যাবজ্জীবনও হতে পারে। সে এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু নিয়ে ভাবছে। অথচ অভিযোগ তেমন গুরুতর না। টাকা চুরির মামলা। ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছে সে- এমনই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ মামলায় কঠিন সাজা হওয়ার কোনো কারণ নেই। বড়জোর দু-এক বছরের…। আফসার সবই জানে। তবুও ছোট্ট কুসুমের চোখের দিকে চেয়ে একটা ভীষণ ক্ষণস্থায়ী সুখ আর তারপরই একে চিরতরে হারিয়ে ফেলার একটা তীব্র বেদনা অনুভব করল। জীবন তাকে দিয়েছে অনেক। এতদিন সে তা বোঝে নি।
রাবেয়া রাতে রান্না করেছিলো আজ। সহজ রান্না না। সে পোলাও করছে। পোলাওর সাথে আরও অনেক কিছু। এতসব কিছু সে করেছে শরীর খারাপ নিয়ে। আজ এমনকি মরিয়মকেও সাথে নেয়নি। রান্না করেছে একা একা। রান্নাঘরের দরজার ছিটকিনি দিয়ে। রান্নার মাঝখানে রাবেয়া ঝরঝর করে কেঁদেছে। তার এতদিনের দীর্ঘশ্বাসটাই বুঝি কান্না হয়ে ঝরে পড়ল আজ। তাদের টানাপোড়েনের সংসারে ভালো রান্না হয় কালেভদ্রে। ছেলেমেয়েরা যখন খুব করে ধরে আর তাতে আফসারও সায় দেয় রাবেয়া তখন রাগী গলায় বলে, পালা পার্বন ছাড়াই পোলাও কোর্মা খেয়ে টাকা নষ্ট করব? না, তা হবে না। এ বাড়িতে উৎসব কখনো আসে না। আনন্দ-ফূর্তি হয়না। নিরামিষ জীবন এখানে। এরই মাঝে তবু কোনো বৃষ্টি-বাদলে আফসার যদি দুহাজার টাকায় দুটি ইলিশ মাছ কিনে চোরের মত এসে রাবেয়ার সামনে দাঁড়ায় চোরা একটা সুখ পায় রাবেয়া। সে কাউকে জানতে দেয়না। নিজেকেও না।
মাছ ফেরত দিয়ে আস।
দুটোই ফেরত দেব? একটা থাক?
না, একটাও থাকবে না। এত দামি মাছ খাওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই।
আফসার কিছু টাকা গচ্চা দিয়ে মাছ ফেরত দিয়ে আসে। রাবেয়া তার তীব্র সুখের অনুভূতিটাকে নষ্ট করে।
রাতের খাওয়া সারা হয়ে গেছে আজ একটু সকাল সকালই । খাবার টেবিলে কেউ কোনো কথা বলেনি। টেবিল ভর্তি রান্নাবান্না দেখে ছেলেমেয়েরা বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল মেহমান হয়ে অন্য কোনো বাড়িতে দাওয়াত খেতে বসেছে। আরিফ পাতে খানিক পোলাও নিয়ে নাড়াচাড়া করল। সপ্না তার বড় ভাইকে অন্ধ অনুকরণ করে। সেও পাতে পোলাও নিল। তারপর দু ভাইবোন কীসের অপেক্ষায় থাকল কে জানে কেউ আর কিছু মুখে দিল না। রাবেয়া দেখেও দেখে নি। যেন আজকের দিনে এমনই হওয়া উচিত।
আফসার কিন্তু খুব খেল। অন্যদিন যা খায় তার চেয়েও বেশি। কত কষ্ট করল রাবেয়া। উৎসবে সে যা করে না আজ তাই করেছে। না খেলে কী করে হয়? রান্নাই শুধু যে করেছে রাবেয়া তা না, যত্ন করে সেজেছেও। সুন্দর নীল রঙের শাড়ি পরেছে। নিখুঁত ফোঁটা এঁকেছে কপালে। সেন্টও মেখেছে হয়ত। রান্নার ঘ্রানে তা বোঝা যায়নি। আফসারের কেমন লজ্জা লাগছিল। সচরাচর সাজে না যারা তারা কোনোদিন হঠাৎ সেজেগুজে সামনে এলে স্বামীরা বুঝি এমনই লজ্জা পায়। অর্থহীন কিছু সময়ের জন্য রাবেয়া কেন এমন রঙিন হল খুব জানতে ইচ্ছে করছিল তার। জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। রাবেয়ার দিকে চেয়ে শুধু একটা হাহাকারের হাওয়া বুকের মধ্যে বয়ে গেল । জীবনের এত স্বাদ সে বুঝি শুধু ফুরিয়ে যাবে বলেই।
ডাইনিং টেবিলটা ঘেঁষেই রাবেয়া দাঁড়িয়েছিল। সে সবার সাথে খেতে বসেনি। মনে মনে সে নিজেকে তৈরি করছিল একটা ভীষণ কঠিন সময়ের জন্য । আজকের দিনের কোনো মূল্য সত্যিই তার কাছে নেই। মনে তার আফসারের উপর রাগই জমেছে শুধু। এমন একটা মন নিয়ে সহজ স্বাভাবিক হওয়ার অভিনয় করে যাওয়া কঠিন কাজ। তারপরও তো সে চেষ্টা করল। সেজেগুজে সামনে এল। ভালোমন্দ রান্না করল। সামর্থ থাকলে হয়ত আরও কিছু করত। জীবনের ছন্দটাই বোধহয় এখানে।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much