একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
টানাপোড়েন (২১)
বোধোদয়
দিনকে দিন বুম্বা কেমন বেয়ারা হয়ে যাচ্ছে দেখো।রাতে খাবার টেবিলে কথাটা পারলো সুরূপা।কিন্তু সুধাময় কোনো উত্তর দিলো না।
সুরূপা আবার বলল ' কি বলছি, শুনতে পাচ্ছ না?'(একটু ঝাঁঝের সুরে )।
এবার সুধাময় খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল।
এবার আরো জোরে সূরূপা চেঁচিয়ে বলল 'সন্তান কি শুধু আমার?'
সুধাময় জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। কোন কথার জবাব দিচ্ছে না।
এতে সুরূপা আরো রেগে যায়। আর বলে 'এই সংসার থেকে আমাকেই চলে যেতে হবে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।'
এবার সুধাময় বলল 'তুমি বুঝতে পেরেছ বলো ,সুরুপা ?'আজ তোমার জন্যই এসব হয়েছে।'
এবার সুরূপা ক্রোধান্বিত হয়ে বলল' 'আমার জন্য হয়েছে?'বলেই কেঁদে ফেলল।'
সুধাময় বলল 'ভেবে দেখো পাঁচ বছর আগের কথা। তখন কি বুম্বা এরকম ছিল? প্রতিটা দিন কেটেছে তাদের কত আনন্দে। তোমার তো সেগুলো পছন্দ হয় নি।'
সুরূপা কেঁদে কেঁদে বলল 'কেন আমি ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে কি ভুল করেছি?'
সুধাময় বলল 'এখন তো সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছো। তুমি সঠিক ছিলে ,না বেঠিক?'
সুরূপা বলল 'হ্যাঁ তুমি তো এখন আমাকে এসব বলবেই। তাহলে তুমিই বা কেন এসেছিলে কলকাতায়?'
সুধাময় বলল 'অফিস থেকে ফেরার পর রোজ তুমি আমার কানের কাছে এক গান গাইতে। গ্রামে থেকে নাকি তুমি তোমার ছেলেকে মানুষ করতে পারবে না ।শুধু কি তাই ,আমার বাবা -মার জন্য নাকি তোমার ছেলে বিগড়ে যাচ্ছে? রোজ অশান্তি, রোজ । রোজ অশান্তির থেকে বনবাস ভালো..?'
সুরূপা বলল 'আমি কলকাতায় ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছি ,ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছি। প্রতিটি মা চায় তার সন্তানের ভালো হোক। আমিও চেয়েছি।
সুধাময় বলল 'কেন গ্রামে থেকে কি ছেলেকে মানুষ করা যেত না? শুধুই
বলতে আমার বাবা-মা তোমার কাছে বাড়তি? আর আমিও সন্তান হিসেবে মা-বাবাকে সঠিক মর্যাদা না দিয়ে চলে এসেছি।'
সুরূপা বলল 'তাহলে তুমি কেন তোমার বাবা-মার সঙ্গে থাকলে না?'
সুধাময় বলল 'হ্যাঁ আমি থাকি আর আমার হাতে হাত করাটা পড়ুক তাই না? তুমি যে কত নাটক করতে পারো? ভগবান ছাড়া আর কারো জানার উপায় নেই। শুধু কি তাই? ছুটির দিনগুলোতে বুম্বাকে নিয়ে একটু গ্রামে যেতাম ঠাকুমা দাদুর কাছে, এটাও তোমার অপছন্দের।'
সুধাময়ের ভেতরের তীব্র জ্বালা থেকে আরো বলতে লাগলো'বুম্বার শৈশব থেকে শুরু করে কৈশোর পর্যন্ত তার সার্বিক বিকাশ হবার জন্য যা যা দরকার তার ঘাটতি ছিল। এইজন্য আজ বয়সন্ধির সময় ছেলেকে নিয়ে এত ভোগান্তি।কলকাতায় এসে ও কি সেরকম বন্ধুবান্ধবকে পেয়েছে? দুদিন স্কুল থেকে ফিরে ও মন মরা হয়েছিল বলো। অথচ ছুটির দিনে যখন ওকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতাম সেখানে গিয়ে ওর আনন্দ-উচ্ছ্বাস যেন আকাশ ভেঙে পড়তো। তুমি সেগুলো বন্ধ করে দিলে।
সব সময় বাঁধা নিষেধ। আজ তোমার ছেলে কোন বাঁধাই মানে না। কারো কথাই শোনে না। তুমি মা এখন তুমি শাসন করো। তখন পেরে উঠছ না, অমনি আমাকে দোষারোপ করতে শুরু করলে না?'
সুরূপা বলল 'আমার কথা ও শোনে না। তাই বলছিলাম তুমি যদি একটু ওকে বলতে?'
সুধাময় বলল 'আমি কি বলবো, বলো তো ?আমি তো জানি ওর চাহিদা পূরণ হওয়ার জন্য কত কিছুর অভাব ছিল। আমরা বাবা -মা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি। শুধু তাই নয় আমার বাবা -মাকে অবহেলা করে আমি চলে এসেছি ,এর যন্ত্রণা তো আমাকে ভোগ করতেই হবে সুরূপা ।
সুরূপা নিরুত্তর তার কথা বলার ভাষা নেই।
সুধাময় বলল আমারও ভুল আছে শুধু তোমার একার নয় ,আমি যদি সেদিন তোমার কথা শুনে কলকাতায় না আসতাম। তাহলে বোধহয় এ দিনটা দেখতে হতো না।'
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধাময় বলে 'দেখি ওর সাথে কথা বলে ও কেন এরকম করছে।'
সুরূপা যেন আশার আলো দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঘ্র ভাবে বলে ওঠে 'হ্যাঁ ,আমি তো সেই কথাই বলছি। তুমি একটু দেখো নিশ্চয়ই আমার ছেলে তোমার কথা শুনবে। জানো তো আজকে ভাত খায় নি।'
সুধাময় ব্যাকুল ভাবে বলল 'তুমি এতক্ষণে আমাকে বলছো? কোথায় ও?'
বেরিয়ে গেছে সেই সন্ধ্যেবেলায় এখনো ফেরে নি। সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। কি হবে আমি ভেবেই পাচ্ছি না। ওকে যখনই বলতে যাই বাবু ,একটু ভালো করে পড় ।বোর্ডের পরীক্ষা আছে। ভালো রেজাল্ট না করতে পারলে ,তুই তো তোর কোন আশাই পূর্ণ করতে পারবি না।
তাতে ছেলে বলল ' করোণা পরিস্থিতিতে বোর্ডের পরীক্ষা হবে নাকি? স্কুল কি খুলছে ।'
সুরূপা বলল 'পরীক্ষা হবে না তোকে কে বলেছে যদি পরীক্ষা হয় ।তখন কি করবি?'জানো, তখন চুপ করে থাকে। আর বলে বেশি বকো না তো।'
সুধাময় বলল 'কোথায় গেছে জানো?'
সুরূপা বলল 'রাজদীপদের বাড়ি।
সুধাময় বলল 'বড় চিন্তায় ফেললে সুরূপা। রাজদীপ ছেলেটা মোটেই ভালো নয়। ওর অনেক বদ গুন আছে।বুম্বাকে গ্রাস না করে?'ফোন নম্বর আছে?
সুরূপা বলল 'না '।
সুধাময় চিন্তিত ভাবে বলল 'রাত নটা বাজে।'কোবিদ পরিস্থিতিতে এতক্ষণ বাইরে থাকা উচিত নয়। তাহলে আমাকে ওর বাড়ি যেতে হবে।'
সুরূপা বলল 'না ,আজকে রাজদীপদের বাড়িতে থাকবে।'
সুধাময় বলল 'তুমি কি করে জানলে?"
সুরূপা বলল 'একটা আননোন নম্বর থেকে কল এসেছিল ।আমি রিসিভ করেছি ।তখনই একথা বলল।'
সুধাময় বলল সুরূপা ছেলেকে রাজদীপের সংস্পর্শ থেকে ফেরাতে হবে।
সুরূপা বলল 'কিন্তু কিভাবে?"
সুধাময় বলল 'কালকে রাজদীপ এর বাড়ি থেকে ফিরলে ,বুম্বার সাথে কথা বলবো। পরশুদিন মহালয়া আছে। দেখি বাবা-মায়ের কাছে যাবো একবার। বুম্বাকেও নিয়ে যাবো।'
সুরূপা এই প্রথম শ্বশুর-শাশুড়ির ওখানে যাওয়ার কথা শুনেও চুপ করে রইলো।( মাথা নিচু করে)।
সুধাময় ভাবতে থাকে মহালয়ার দিন ভোর বেলায় গ্রামে কত সুন্দর কেটেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের রেডিওতে কন্ঠ শোনার জন্য, ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে রাখা। তারপর সব বন্ধু-বান্ধব মিলে বাজি পটকা ফাটানো,তারপর তর্পণ দেখার জন্য নদীর নদীতে ভিড় জমানো ,শৈশবের সেই সোনালী দিনগুলোর কথা ভেবে চোখে জল চলে এসেছিল। তাই গানটা বড্ড মনে বাজে ' 'দিনগুলো মোর সোনার খাঁচায় রইল না'। অথচ আজকের প্রজন্ম মহালয়ার গুরুত্বই বুঝতে পারে না। মহালায়া কখন আসে, কখন যায়। কিছুই বোঝে না।ওদের দোষ নয়। আজকের সমাজবাস্তবতার এক নিষ্ঠুর দলিল।পারস্পরিক সহানুভূতি ,সমানুভূতি,ভালোবাসা এইগুলো এদের মধ্যে এখন দেখা যায় না। যেগুলো আমাদের গ্রামেতে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে থেকে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যে সুখানুভূতি পাওয়া যায় ।শহরেতে তা নয়।
হঠাৎই ফোনে ক্রিংক্রিং আওয়াজ করে উঠল সুধাময় বলল ' দেখো তো কার ফোন?'
সুরূপা বলল হ্যাঁ দেখছি। হ্যালো''কে বলছেন?
ওপার থেকে সারা আসলো 'আমি রাজদীপ এর বাবা বলছি। আপনারা একবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবেন?
কথাটা শুনে সুরূপা বলল 'কেন কি হয়েছে?'"
রাজদীপের বাবা বলল 'বুম্বার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ।আমরা ওকে হসপিটালে এডমিট করেছি। আপনারা তাড়াতাড়ি চলে আসুন।"
কথাটা শুনেই সুরূপা সেন্সলেস হয়ে যায়। অপরদিক থেকে ফোনে " হ্যালো হ্যালো 'হয়ে যেতে লাগল।'
ওদিকে ভাসাভাসা কথা সুধাময়ের কানে এসেছে ।ফোনে কোন কথাবার্তার আওয়াজ না পেয়ে বলে ,সুরূপা কি হয়েছে?' সাড়া না পেয়ে সুধাময় যায় পাশের ঘরেতে।'
সেখানে গিয়ে দেখে সুরূপা সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
সুধাময় তাড়াতাড়ি সেন্স ফিরানোর জন্য যা যা করণীয় ।সবকিছু করে ।
সেন্স ফিরলে সুরূপা বলে"আমার বূম্বা কোথায়? আমার বুম্বাকে আমার কাছে এনে দাও ।ওই বাড়িতে গেলে ওর ক্ষতি হবে ।আমি তোমাকে বলছিলাম না?'
সুধাময় বলল বলো ,কি বলেছেন উনি? '
সুরুপা বলল 'বুম্বার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ।হসপিটালাইজড। সুধাময় বলল 'এক্ষুনি যেতে হবে।'
বলেই গাড়িটা বের করল।
সুরূপা বলল ' আমিও যাব'।
সুধাময় বলল 'তোমাকে যেতে হবে না।'আমি ফোনে তোমাকে সব জানাবো।'
সুধাময় চলে যাবার পর সুরূপা বসে বসে ভাবতে লাগলো সত্যিই গ্রামের বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি মাকে নিয়ে তারা ভালই ছিল। কি কুক্ষণে যে তার মতিভ্রম ঘটেছিল ,কে বলতে পারে? আজ মনে পড়ছে তার শাশুড়ি মা কত যত্ন করে নাতি বুম্বাকে পছন্দের জিনিস খাওয়াতেন। এমনকি সুরুপাকে কত স্নেহ করতেন । অথচ নিজের ইগোর জন্য আত্মীয় পরিজন ছেড়ে আজ বনবাসে।আর তার ছেলেটিও অমানুষ পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তাই সুরূপা ভেবে স্থির করে নেয় ।তার ছেলের সুস্থ হয়ে ফিরলে তার দাদু ঠাকুমাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে হবে। সে যে ভুলগুলো করেছে, তার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই চেষ্টাই করবে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"২১ ক্রমশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much