উপন্যাস
টানাপোড়েন ১৭৫
হঠাৎ মেঘ
মমতা রায়চৌধুরী
এক টুকরো হাসি মেঘ সরাতে পারে, এক টুকরো খুশিই মনের অলিন্দে চাঁদ উঠাতে পারে। আজকের ব্যস্ত দিনে সেই এক টুকরো হাসি যেন মেঘলা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় দূর বহুদূর। মাসি কাজ করে চলে যাবার পর নচিকেতার গানটা শুনছে"যার কথা ভাসে ,মেঘলা বাতাসে তবুও সে দূরে তা মানি না ।
জানি না ।
জানি না ।
কেন তা জানি না
দূরে দূরে মেঘ যাচ্ছে পুড়ে মন মিললো স্মৃতি দু'ডানায়….,।,,"
রেখার মনও এই মেঘলা দিনে জীবন পারের ওপারেতে যে ধুলো জমে আছে ,এক পশলা বৃষ্টির পরে সে যেন হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো সঞ্চয় করতে থাকে। স্মৃতিরা যখন ভিড় করে আসে ধীর পায়, শুকনো পাতার ওপর যেন কারও নুপুরের আওয়াজ শুনতে পায় ।যখন ভাবছে যার উষ্ণ আঁচে এখনো সেই ভালোবাসা বেঁচে আছে অথচ সেই মানুষটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন সময় মনোজ ডেকে উঠলো "রেখা, রেখা রেখা রেখা আ. আ. আ'।'
হঠাৎ চিৎকারে রেখার স্মৃতিগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়। সম্বিৎ ফিরে পায়। রেখার ড্রয়িং রুম থেকেই সাড়া দেয় 'কি হয়েছে?'
"দেখো এসে কি হয়েছে?"
রেখা তাড়াতাড়ি মনোজের ঘরে ঢোকে। মনোজের দিকে তাকিয়ে '," কি?"
মনোজ রেখা কে ইশারায় দেখায়?
রেখা বলে কি হয়েছে?
মনোজ রেখাকে দেখায়..।
রেখা দেখছে তুলি একটু বমি করেছে?
মনোজ বলে এআবার কখন ঢুকেছে?
গতকাল রাত থেকেই তো আছে।
সেকি?
মনোজ আশ্চর্য হয়ে গেল।
আসলে কালকে ওদের গেটটা বন্ধ ছিল।
মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে ওরা একসা হয়েছিল।
তুমি জান না মা আসলে কি গন্ডগোল টা বাধবে?
রেখা চুপ করে আছে।।
রেখা বলল' আমি কি করি বলো তো?
মানে কালকের ওই রকম পরিস্থিতি দেখার পর ও যদি আমার রুমে চলে আসে তাহলে আমি কি
পারি তাড়িয়ে দিতে? আমি তা পারি না।
কি অসহায় ভাবে কুঁইকুঁই আওয়াজ করছিল।
যা ভালো বোঝো করো। মনোজ রেগেই বলল।
ঠিক আছে আমি বমি পরিস্কার করে দিচ্ছি।
রেখা ওই জায়গাটিতে ভালো করে ধুয়ে দিল।
তারপর রেখা মনেজের ।
তুলি একবার তাকিয়ে দেখে নিল।
তারপর মাথাটা আবার নামিয়ে চোখ
বুঝ ল ।
মনোজ বলল "একে আর তোমার নাওটা ক'রো না। এ কিন্তু আর যাবে না রুম থেকে।"
রেখা বলল " তাহলে কি করব?"
"ওদেরকে ভয় দেখাও যাতে ঘরে না ঢুকে।'
'তুমি বলছো একথা? তুমি? 'রেখা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
মনোজ কেমন করুন দৃষ্টিতে রেখার দিকে তাকিয়ে রইলো ।
রেখা বুঝতে পেরেছে মনোজের অবস্থাটা ।
রেখা কথা না বাড়িয়ে মনোজকে চা এনে দিল তারপর তুলিকে ডাকলো 'তুলি ,তুলি, তুলি' চলো বাবা ,বাইরে চলো।
কি সুন্দর ডাকের সঙ্গে সঙ্গে তাকালো ।তাকিয়ে রেখার কথামত গেটের বাইরে চলে আসলো।
রেখা মনে মনে ভাবছে এরপর যদি সত্যি সত্যি তুলি রুমে এসে থাকে আর রেখা কি করবে?'
রেখা আর কোন কিছু ভাবতে পারছে না। সে সবকিছুই ভগবানের উপর ছেড়ে দিয়েছে যখন হবে ,তখন দেখা যাবে।
তাছাড়া রেখা তো ওদের কে মেরে বার করবে
না ।কখনোই না। তাতে যতই ঝড় আসুক না কেন?
ভাবতে ভাবতেই রেখা মনোজকে বলল
"তুমি অফিসে যাবে তো?"
"আর কখন যাব লেট হয়ে গেল?'
'তুমি কি আজকাল অফিসে এভাবেই যাও ,যখন মনে হল তখন গেলে ।মনে হলো না গেলে না।
আদপে অফিসে যাও তো? বলতে চাইছি অফিসে কোন গন্ডগোল হচ্ছে না তো?"
কথাটা শোনার পর মনোজ কেমন যেন একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেল।
রেখা মনে মনে ভাবল "কথাটা বলে কি ঠিক করল?
আর কোন কথা না দীর্ঘায়িত না করে স্নান করতে গেল। কারণ রেখাকে তো স্কুলে যেতে
হবে ।পরীক্ষা শুরু হয়েছে। সেকেন্ড হাফ বলে এতটা টেনশন ছিল না। এখন যদি সব কাজ গুছিয়ে নিজেকে তৈরি না করতে পারে তাহলে ট্রেন পাবে না।
রেখা বাথরুমে ঢুকে সাওয়ারের কলটা জোরে করে দিয়ে, জলের শব্দ আর নিজের ভেতরের নৈঃশব্দ্য শব্দগুলোকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। জীবনের যে পাতায় ধুলো পড়ে গেছে ধীরে ধীরে, বাতাসেরাও যেখানে আজ অসহায়। তবুও রেখার মনে হয় শুকনো পাতার নূপুর কেউ যেন তাকে ডেকে যায়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে মনে মনে ভাবছে কি কি কারণে মনোজ এসব বলছে, শাশুড়ি মা বাড়ীতে পা দিলেই ,সেদিনই কুরুক্ষেত্র বাঁধাবেন । কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনের মত তো মনোজের সারথি নেই ।কে সামলাবে?"
কে বা শিখন্ডী হয়ে দাঁড়াবে?"
গোপালের ভোগ চাপিয়ে রেখা ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে বসলো। আর লাঞ্চ প্যাক করে নিল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজাতে সাজাতে রেখা ডাকলো' কিগো শুনছো?"
মনোজ কোন আওয়াজ দিচ্ছে না।
আবার ডাকল কি গো শুনছো?
রেখা তখন বাধ্য হয়ে মনোজের ঘরে গেল।
গিয়ে দেখে বিছানায় বসে বসে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। সারাঘর ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ।
রেখা বুঝল শুধুমাত্র তুলির কারণে মুড অফ নেই অন্য কিছু একটা বড় সরো ব্যাপার ঘটেছে মনোজের মনের ভেতরে ,যে কথাগুলো শেয়ার করতে পারছে না।
একা একাই মনের ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে মরছে।
রেখা পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য বলল"ঠিক আছে তোমার কথাই থাকবে ।মা আসার আগে তুলিকে রুমের বাইরে রাখা হবে।
এবার খুশি তো?'
মনোজ কোন উত্তর না দেয়াতে রেখা আবার বলল"কিগো শুনতে পাচ্ছ না?"
মনোজ একটু ম্লান হাসলো।
রেখা বলল "জল খাবার খাবে চলো অনেক বেলা হয়ে গেছে।"
"হ্যাঁ, চলো।'
মনোজ ব্রাশ করে একটু ফ্রেশ হয়ে আসলো। তারপর খেতে খেতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল আর ফোন ঘেটে যেতে লাগলো।
রেখা বুঝতে পারছে বড়োসড়ো একটা ঝড় আসতে চলেছে আবার ।কিন্তু ঝড় টা কোন দিক দিয়ে আসবে সেটা আঁচ করতে পারছে না।
আসন্ন বিপদের কথা ভেবে রেখার গা শিউরে উঠলো।
তবুও মনে সাহস নিয়ে বললো তোমার কিছু সমস্যা হচ্ছে আমাকে বল না?
কথা বললে সমস্যা গুলো থেকে বেরিয়ে আসার অনেক সময় সমাধানের রাস্তা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
মনোজ বলল'কই কিছু হয়নি তো?
তুমি জোর দিয়ে বল আমি বুঝতে পারছি তোমার ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে বলো না কি হয়েছে?
আমি তো তোমার অর্ধাঙ্গিনী ।তোমার সুখেতে যেমন আমার অধিকার আছে ,তোমার দুঃখেতে কষ্টতে আমার অধিকার আছে ,সে গুলোকে ভাগ করে নেবার।
মনোজ রেখার গাল দুটোকে ধরে একটু হাসলো তারপর বলল 'তুমি স্কুলে যাবে তো?'
"হ্যাঁ যাবো তো?"
"ঠিক আছে তোমাকে আমি স্টেশনে ছেড়ে দেবো।"
"তুমি বাড়িতে এভাবে একা একা মন খারাপ করে বসে থাকব আমার তো স্কুলে যেতেও ভালো লাগছে না।"
মনোজ কোন কথার উত্তর দিল না।
রেখার একটু চাপ বেড়ে গেল আদপে স্কুলে যাওয়া ঠিক হবে কিনা ওকে একা রেখে,।
রেখা একবার বড়দিকে ফোন করবে কিনা মনে মনে ভাবতে লাগল।
তারপর ভাবলো ফোনটা করেই দেখি। বড়দির ফোন নম্বরটা ডায়াল করল। রিং হতে লাগলো। সম্ভবত বড়দি ফোনটা ধরেছেন বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন"হ্যালো।
"আমি রেখা বলছি বড়দি।,"
হ্যাঁ বল?'
বলছি আজকে স্কুলে না গেলে কি খুব অসুবিধা হবে?'
'কেন বলোতো কিছু হয়েছে নাকি?."
'না মানে বড়দি আজকে একটু বাড়িতে থাকলে পরে খুব উপকার হত।'
ঠিক আছে অসুবিধা নেই ।তোমার যখন একান্তই দরকার বাড়িতে আজ ছুটি নিয়ে নাও ।তাছাড়া এখন তো হোম সেন্টার হয়েছে।
তাছাড়া সেকেন্ড হবে একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা আছে।'
"অত চাপ নেই।'
রেখা বলল
"ঠিক আছে বড়দি ।'
তারপরই ভাবতে লাগলো নীল আকাশে হঠাৎ করে মেঘ ঘনিয়ে আসলে যেমন বেমানান লাগে ঠিক তেমনি জীবনাকাশেও হঠাৎ করে মেঘ ঘনিয়ে আসলে সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়।