একান্ত মনেই লিখে চলেছেন লেখক। তার নিত্যদিনের আসা যাওয়া ঘটনার কিছু স্মৃতি কিছু কল্পনার মোচড়ে লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন "।
উপন্যাস টানাপোড়েন
পর্ব (১৬)
লোভ
অনেক দিন টানা বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে।গতরাতে পার্থ ও সোমদত্তার চিন্তায় ঘুম হয় নি। সকালে একবার পার্থর খবর নেবে বলে সমদত্তাকে ফোন করলো।রিং হলে ওপারের গলা এলো 'হ্যালো'।
রেখা বলল 'পার্থ কেমন আছে রে?'
সমু বলল ' ভালো।'
রেখা আর কথা না বাড়িয়ে ঠিক আছে বলে ফোন ছেড়ে দিল। এমনিতেই রেখার অস্বস্তি হচ্ছিল সোমদত্তা সঙ্গে কথা বলতে। কারণ সকাল-সকাল রেখা তার মেজাজটাকে বিগড়াতে চায় নি। ফোন কেটে দিল। আজকে রেখাকে স্কুলে যেতে হবে। রিম্পা দির সঙ্গে এ কটা দিন সেভাবে ভালো করে কথা বলাই হয়নি।মনে হচ্ছে যেন এক যুগ রিম্পাদির সঙ্গে কথা বলা হয় নি ।মনটা ছটফট করছে। এজন্য স্কুলে যাবে । যে কটা দিন রিম্পাদির সংস্পর্শে থাকা যায়। সেই লোভটা রেখা কিছুতেই সামলাতে পারছে না ।তাই ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়েও স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। না হলে আজকের দিনটা রেস্ট নিতো। এদিকে সকাল-সকাল মনোজ গেছে পুটুর বাড়িতে ।খোঁজ লাগাতে কি হয়েছে? মনোজের আসার টাইম হয়ে গেছে কিন্তু আসছে না কেন ?এদিকে রেখাকেও স্কুলে যেতে হবে। রেখা দ্রুত হাতের কাজগুলো সেরে, স্নান করে ,পূজা পাঠ করে রেডি হয়ে নিল। মনোজ আসলে ওকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দেবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রেখা ভাবছে না আর দেরী করা যাবে না ।মনোজকে একটা ফোন করে নিল রেখা।
হ্যালো'। তুমি কখন আসবে? আমাকে ট্রেন ধরতে হবে তো?
মনোজ বলল 'তুমি বেরিয়ে যাও?'আজকে তো আমি অফিস যাব না।'
রেখা বলল ' ও দিকে পুটুর খবর কি?'
মনোজ বলল 'পুটু কদিন কাজে আসতে পারবে না?'
রেখা বলে 'তাহলে কি হবে?'
মনোজ বলল 'ওকে বলে এসেছি নিজে আসতে না পারলে অন্য কাউকে কাজে ঢুকিয়ে দে।'
রেখা বলল 'কী বলল?'
মনোজ বলল 'তুমি স্কুলে বেরিয়ে যাও, পরে কথা হবে।'
রেখা বললো 'একটা চাপ থেকে যাচ্ছে ।ঠিক আছে আমি স্কুলে চলে যাচ্ছি। তোমার ব্রেকফাস্টটা রাখা আছে ।খেয়ে নেবে ।দেখো বাড়িতে আছো বলে আবার ১টা বাজিয়ে দিও না বেকফাস্ট খেতে। আর দুপুরের খাবারটা ঠিক সময়ে খেয়ে নিও।'
মনোজ বলল ,'হ্যাঁ ,রে বাবা। আমি ঠিক সময়ে খেয়ে নেব ।তুমি অত টেনশন নিও না। আর সাবধানে যেও।'
রেখা বলল 'ঠিক আছে ।দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো।
না, এখন যদি না বের হতে পারে তাহলে এই ট্রেনটা সে মিস করবে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটল অটো অটো বলে।
অটোতে উঠে পরল ।বাবা আজকে অনেক ভিড়।রেখাকে যে লোকটার পাশে বসতে হলো তার গায়ের থেকে ভোটকা দুর্গন্ধ ,সঙ্গে ঘামের গন্ধ। রেখার যেন মনে হলো অন্নপ্রাশনের খাবারগুলো সব বেরিয়ে আসবে।রেখার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই ।যেতে হবেই। এরমধ্যে পাশে বসে থাকতে-থাকতে রেখা অনুভব করল অচেনা লোকটি যেন ক্রমশ সরে আসছে, আলতো করে ওর সাথে নিজের স্পর্শ ,আস্তে আস্তে কুনুটা যেন রেখার বুকের কাছে ।রেখা কিছু বলতে পারছে না ।শেষ পর্যন্ত রেখা অটোওয়ালাকে বলল ' একটু তাড়াতাড়ি চলুন না।'
অটোওয়ালা বলল 'এর থেকেও দ্রুত কি করে যাব দিদি ?আমার আটোতে তো আর এরোপ্লেনের পাখা লাগানো নেই।'
এই কথা শুনে সেই অসভ্য লোকটি হো হো হো্করে হেসে উঠলো।
রেখাও বুঝল যে সে বোকার মত কথাটা বলেছে ।অটোওয়ালা ঠিক তার গতিতেই যাচ্ছে কিন্তু রেখার মনে হচ্ছিল একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারলেই লোভী মানুষটার হাত থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে নিতে পারতো। এই জন্য তাড়া দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত অটো স্টেশনে থামলো। ততক্ষণে খবর হয়ে গেছে ট্রেন ঢুকছে ।অটোওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে ছুটতে শুরু করলো ওভারব্রিজ পার হয়ে যেতে হবে। যখন ওভারব্রিজ পার হলো তখন ট্রেন হুইসেল দিয়েছে এবার সে আরো দ্রুত ছুটতে শুরু করলো ।কোনরকমে সে ট্রেনটায় উঠলো ।সেই সময় ওর হুঁশ ছিল না যে ,তাকে লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠতে হবে। তাড়াহুড়োতে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়েছে। ভেতরের দিকে যাবার চেষ্টা করলো ভিড় ঠেলে ঠেলে কোন রকমে লাগেজগুলোকে নিয়ে একটা সাইড করে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।
ট্রেনের ভেতরেও সে লক্ষ্য করলো এই ভিড়ের মধ্যে তার পায়ের উপরে কোন একটি পা যেন ঘষছে ।তাকিয়ে দেখল সেই অটোতে বসে থাকা লোকটি। রেখা এবার আরো বেশি অস্বস্তি অনুভব করল। নিজের পা টা সরিয়ে নিল । কিন্তু কি রকম নির্লজ্জ লোকটা ।ঠিক রেখার পায়ের কাছেই আবার পা টা রেখেছে ।রেখা ভাবছে কি করে এই লোকটার পাশে এসে দাঁড়াল? রেখা ভাবতেই পারে নি। রেখা এবার সিটে বসে থাকা লোকদের জিজ্ঞেস করলো কে কোথায় যাবে ?এর মধ্যে একজন বলল ' পালপাড়া নামবে।'
রেখা বলল 'জায়গাটা বুক রইল।'
লোকটা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পরক্ষণেই চোখ বুজে ঘুমাতে থাকল।
অস্বস্তি ক্রমশ বাড়িয়ে দিলো পাশের ওই লোকটা। এবার রেখা বাধ্য হয়েই বললো ' দাদা একটু ঠিক জায়গায় পা রাখুন।'
লোকটি নির্লজ্জের মতো বলল 'আপনার প্রাইভেট কারে আসা উচিত ।এত ভিড়ের মাঝে একটু এদিক ওদিক হতেই পারে ।'
রেখা কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। কি বলছে এই লোভী মানুষ। রেখার পাশেই কি আবার বসবে..? ভাবতে পারছে না রেখা ।গা টা যেন ঘৃনায় ঘিন ঘিন করতে লাগলো। পুরুষ মানুষগুলোই কি এরকম কে জানে বাবা ।মেয়ে দেখতে পেলে তারা স্থির থাকতে পারে না ।
রেখা মনে মনে ভাবতে লাগল না না সব পুরুষকে দিয়ে বিচার করলে কি হয় ,এটাও একবার পুরুষদের প্রতি সহানুভূতির সঙ্গে ভাবল। এমনি সময় ট্রেন এসে পালপাড়ায় থামল ।রেখা তার নির্দিষ্ট বুকিং সিটে গিয়ে বসলো আর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অসভ্য লোভী মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলো না বলে ।কোনরকমে সে জায়গাটায় বসলো ।কিছুক্ষণ পর সে অনুভব করতে লাগলো সে যার পাশে বসেছে পাশে আরেকটি ভদ্রলোক ? না ভদ্রলোক বলবো না। আরেক লোভী ক্রমশ যেন রেখার গায়ে ঢুকে পড়তে চাইছে ।রেখা ভাবছে আজকের দিনটাই রেখার খারাপ ।তাই এই ধরনের লোভী মানুষদের চক্করে রেখাকে পড়তে হয়েছে ।অথচ মুখ ফুটে বলতে গেলে কি রকম কথা শোনাচ্ছে ।রেখা এবার পাশে থাকার লোকটির দিকে একটু বিরক্তি চোখে তাকালো ,বুঝিয়ে দিতে চাইল, যে কাজটি করছে মোটেই পছন্দ নয় ।বরং লোভী লোকটা একবারে রেখার দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে ইতঃস্তত বোধ করল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা যাচ্ছে পাশের লোকটি কনুই দিয়ে ধাক্কা মারছে। রেখা ভাবছে এ তো বড্ড জ্বালা হল ।পৃথিবীর সমস্ত পুরুষ মানুষগুলোই কি তাহলে এরকম? এমন সময় আরেক ভদ্রলোক তিনি নেমে গেলেন ।পাশে এসে বসল সেই অটোতে বসা লোভী কামাতুর লোকটা। রেখা ভাবল বসে থাকাটাই তার অসম্ভব ব্যাপার। দুটো অসভ্য লোভী মানুষের পাশে বসে রেখার তখন স্যান্ডউইচ হবার কথা ।তাই রেখা উঠে সে এগিয়ে গেল গেটের কাছে। ট্রেন চলেছে বাইরে সবুজ দিগন্ত মাঠ কদিনের বৃষ্টিতেও যে জল থইথই করছিল ।এক দিনের টানা রোদে জল যেন অনেকটা নিচে নেমে গেছে। ভালই লাগছিল প্রকৃতির এই কান্ড কারখানা ।কদিনের বৃষ্টিতে রেখা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল অথচ এই বৃষ্টি রেখার খুব পছন্দের। এরই মধ্যে ফোন বাজতে শুরু করল রেখা হাতরে হাতরে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করল ।দেখল ।রিম্পাদির কল। রেখা রিং ব্যাক করল রিম্পাদি 'হ্যালো 'বললো।
রেখা বলল 'ট্রেনে আছি ।স্কুলে যাচ্ছি।'
রিম্পাদি বলল 'আমি এটা জানার জন্যই তোকে ফোন করেছিলাম ।যাক সাবধানে আয় ।অনেক কথা জমে আছে ।তোকে কাছে পেলে সব বলবো।'
রেখা বলল আমিও তোমাকে আজকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলব।
রিম্পাদি বলল 'কেন রে কিছু অস্বস্তিকর ঘটনা?'
রেখা বলল 'একদম ঠিক ধরেছ।'
রিম্পা দি বলল কেন তোর কাছে সেফটিপিন ছিল না। তোকে তো অনেক আগে আমি এই টিপস দিয়েছিলাম। আরে অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে তো।'
রেখা এত অস্বস্তির মধ্যে ও হাসতে হাসতে বললো 'ঠিকই বলেছ ।তোমার টিপস কাজে লাগাই নি বলেই আজকে এতটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল ।এবার থেকে কথাটা মাথায় রাখবো।'
রিম্পাদি বলল 'আমার সঙ্গে একটা ঘটনা ঘটেছিল তোকে তো কবে বলেছি না? সেই চাঁদু সেফটিপিন এর জ্বালা কিরকম হাড়েহাড়ে বুঝতে পেরেছে ।বুঝেছিস ?বলেই দুজনে হাসতে শুরু করলো।
রেখা মনে মনে ভাবল সত্যিই রিম্পাদির কাছে আছে কিছু স্টক। এরইমধ্যে ট্রেন এসে থামল নির্দিষ্ট স্টেশনে। এক ধৈর্যহীন অতৃপ্ত যুবা ট্রেন না থামতেই নামতে যাচ্ছিল ।
এক ভদ্রলোক তাকে টেনে ধ'রে বলেন !'এত তাড়া কিসের ?এইজন্যেই তো যত অঘটন ঘটে।'
রেখা মনে মনে ভাবছে সত্যিই পৃথিবীতে কত ধরনের লোভ কাজ করে। কারোর ভেতরে কামলোভ ,কারোর ভেতরে আগে যাওয়ার লোভ, কারোর ভেতরে কাউকে ভালোবাসার লোভ, কারোর ভেতরে কাউকে বিশ্বাস করার লোভ, কারণ ইর্ষার লোভ। এই লোভ জিনিসটা বড্ড বেশি। আর এটা আছে বলেই একটা প্রতিযোগিতা চলে।
ধারাবাহিক উপন্যাস "টানাপোড়েন"১৬ ক্রমশ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much