০৮ ডিসেম্বর ২০২০

ফাতেমা ইসরাত রেখা এর বিজয় দিবস উপলক্ষে লেখা গল্প

 ছোটগল্প 

 


                      লাল সবুজের অন্তরালে 

                  দশ-এগারো বছরের কিশোর আদিব। মায়ের আঁচলের ছায়ায় বেড়ে উঠছিলো , বাবার ভালোবাসায় মুখরিত জীবন তার। হঠাৎ একদিন বাবা চলে গেলেন গভীর রাতে। ঘুম থেকে জেগে আদিব বাবাকে খুঁজে হয়রান। 

মা বাবা কোথায়? আমাকে না বলে বাবা কোথায় গেলো? 

তোমার বাবা মুক্তি আনতে গেছে সোনা, এত অবুঝ হইও না, মুক্তি নিয়ে ঠিক চলে আসবে। 

মুক্তি কি মা? ওটা দিয়ে কি করে? 

বাবা,তুমি এখনো ছোট ,অত কিছু বুঝবা না। তবে মুক্তি এলে আমরা আমাদের মতো চলতে পারবো, নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারবো, আমরা আর কারো হুকুমের গোলাম হয়ে থাকবো না। আমাদের অর্জিত সম্পদ কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।

 এসব তুমি কি বলো মা? আমি তো কিছুই বুঝি না। 

এখন তুমি এসব বুঝবে না। দেশ স্বাধীন হোক, তোমার বাবা ফিরে আসুক, তখন তোমাকে বাবা বুঝিয়ে বলবে, বলবে এই মুক্তির আন্দোলনের সব ইতিহাস। 

দেশে মুক্তিযুদ্ধ বেঁধে গেছে। চারিদিকে থমথমে ভাব, যেন সব মানুষ হাসতে ভুলে গেছে, পাক বাহিনীর ভয়ে কাঁদতেও ভুলে গেছে। কিশোরী যুবতী মেয়েছেলে, বৌদের মধ্যে অন্যরকম এক আতঙ্ক বিরাজ করছে। আস্তে আস্তে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ছে হানাদার বাহিনী ,ক্যাম্প তৈরি করে ঘাঁটি বানাচ্ছে। দেশীয় কিছু দোসর ওদের পিছনে পা চাটা কুকুরের মতো লেগে আছে।

 সুধীন বাবু, এ গাঁয়ের খুব নামকরা অঙ্কের মাস্টার। গতকাল তাকে ডেকে নিয়েছিলো ওদের ক্যাম্পে। কি বলেছে ওরাই জানে, মাস্টার বাবু তো মুখ খুলছে না। 

হঠাৎ আদিবের মা সাহানা আক্তারের সাথে রাস্তায় দেখা। মাস্টার মশাই কেমন আছেন?

আর বলিও না, এমন পরিস্থিতিতে কেউ কি ভালো থাকতে পারে? আমি মনে হয় মেয়েটাকে নিয়ে এখানে থাকতে পারবো না গো। ওরা আমাকে কাল ডেকে নিয়ে কি বলে, উর্দুতেতে কথা বলতে, ওদেরকে গ্রামের সব গোপন খবর বলতে। আমি তো তা পারবো না গো। 

আপনি ভাববেন না মাস্টার মশাই। আমাদের সাহসী ছেলেরা ওদের কোন ষড়যন্ত্র সফল হতে দিবে না। দেখবেন, একদিন আমরা ঠিক স্বাধীন হবো। আমরাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবো পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। 

চলে যান মাস্টার মশাই। দিন দশেক পরে গোপনে দেশ ছেড়ে যেতে চাইছিলেন রাতের অন্ধকারে। কিন্তু তাদের যাবার খবর পাকিস্তানী ক্যাম্পে পৌঁছে দেয় দালাল রহিম শেখ। সে রাতেই মাস্টারের মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায় ক্যাম্পে, মাস্টার মশাই ও তার স্ত্রীকে বেধড়ক মারপিট করে ফেলে রেখে যায়। মানুষ এত অসহায়! ভাবাই যায় না। 

শাহানার চোখে ঘুম নেই, স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছে , বড় ছেলেটাও কি সব ট্রেনিং নিচ্ছে গোপনে। না জানি কবে ওদের কথা জেনে যায় শয়তানেরা। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কেউ কড়া নাড়ছে। 

কে?  কে ওখানে? 

আমি গো ভাবি,  তমিজুদ্দিন। দরজাটা একটু খোলো। তোমার সাথে ভিনদেশী কমান্ডার সাহেব দেখা করতে চান। 

বুঝতে বাকী থাকে না শাহানার আর কিছু। এই নেড়ি কুত্তাটা আমার বাড়িটা চিনিয়ে নিয়ে এসেছে। আমিও দেখি কি করে তারা।

শাহানা উঠে ছেলেটাকে আড়ালে শুইয়ে দরজা খুলে দেয়, কি জন্য এসেছো এত রাতে? 

আপকা খসম কাহা হ্যায়? আপটা বেটা ভি দেখ নেহি রাহা, কাহা হ্যায় ও, উসকো বোলাও। 

তোমার স্বামী কই? বড় ছেলেটা কোথায়, তাকে ডাকতে বলছেন হুজুর। মূলার মতো দাঁত বের করে তমিজুদ্দিন হাসছিলো। ইচ্ছা করছিলো বটিটা এনে ওর ঘাড়টা দু'টুকরো করে দিতে। 

শান্ত হয়ে তবুও শাহানা জবাব দিলো, তারা একটু কাজে গ্রামের বাইরে গেছে, কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। 

জব ও লোক ফিরেঙ্গে, হামকো জরুর খবর দে না। 

আচ্ছা,বলে শাহানা বন্ধ করে দেয়। মনে মনে ভাবে, আমাদের স্বাধীনতা বুঝি দেখার সৌভাগ্য হবে না। 

চাচী, ক্ষুধা লাগছে, আমরা মাত্র তিনজন। একটু খাবার দিতে পারবা ? 

আয় ভিতরে, ওদের ডেকে কিছু শুকনা মুড়ি আর গুড় খেতে দেয় শাহানা। ট্রেনিং করতে গিয়ে দুদিন কিছু খাওয়া হয়নি । গ্রামে পাক বাহিনী ঢুকেছে খবর পেয়ে ওরা এখানে এসেছে কয়েকজন ছেলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখন হানাদারদের অবস্থান ও সংখ্যা বোঝার চেষ্টা করছে। গোগ্রাসে খাচ্ছিলো ওরা।

শাহানা ভয়ে থাকে কখন কে এসে যায়। তখনই পাক বাহিনীর কয়েকজন ছুটে এসে বলে তোর বাড়িতে মুক্তি আছে বের করে দে, নইলে ......

নইলে?  কি করবি? মুক্তি চাই তোদের? আমরা সবাই মুক্তি। এতক্ষণে ওরা লুকিয়ে বের হয়ে যায় পিছনের দরজা দিয়ে। শাহানা আগেই ওদিকটা দেখিয়ে দিয়েছিলো ওদের। 

শাহানা জানে, ওরা নিশ্চিত খবর না পেয়ে আসেনি। আর কিছু না ভেবে বুকের মানিককে বের করে দেয়, এই নে মুক্তি। 

ছেলে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে? কি করছো মা? 

বাবা আমায় ক্ষমা করিস। এটাই মুক্তি, দেশের জন্য স্বাধীনতা। 

বলতে বলতেই ওদের রাইফেলের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় কিশোর আদিবের ছোট্ট বক্ষ পিঞ্জর। তাতেও হায়েনাদের তৃপ্তি হয়না, ধরে নিয়ে যায় শাহানাকে। তারপর সে আর ফিরে আসে না। 

নয় মাস যুদ্ধ চলে, যুদ্ধে শত্রুর গোলার আঘাতে মারা যান শাহানার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা বীর সেনানী আব্দুল গফুর শেখ। ছেলে আদনান ফিরে আসে বিজয়ী বেশে লাল সবুজের পতাকা হাতে। ভাইয়ের রক্তে, মায়ের ইজ্জতে আর বাবার সংগ্রামী জীবনের বিনিময়ে নি‌ঃস্ব আদনান স্বপ্ন ভাঙা আর্তনাদে কুড়িয়ে আনে স্বাধীনতা। এ এক গৌরবগাঁথা। গর্বিত বাঙালি আদনান লাল সবুজের পতাকা হাতে তবুও  আগামীর স্বপ্ন বোনে।

1 টি মন্তব্য:

  1. আন্তরিক ধন্যবাদসহ কৃতজ্ঞতা দাদা, আমার গল্পটিকে আপনার পত্রিকায় স্থান দেয়ার জন্য।

    উত্তরমুছুন

thank you so much