শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত
(পর্ব ৫৫)
শামীমা আহমেদ
রাহাতের সাথে কথা শেষ করে তাকে বাসায় নামিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে শিহাবের প্রায় রাত সাড়ে দশটা বেজে গেলো। সপ্তাহ শেষে দুজনে একসাথে আজ বেশ কিছুটা সময় কাটালো "টেবিল টপ" রেস্টুরেন্টটায়। শিহাব রাতের মত কিছু খাবার খেয়ে নিয়েছে। সেখানে রাহাতকে ডিনার করাতে চাইলেও একেবারেই রাজি করানো গেলো না।রাহাত জানালো,সারাদিনের ক্লান্তির পর সে বাসায় ফিরবে।মা আর শায়লা আপুর সাথে রাতের খাবার খাবে।শিহাব জানালো,আমার জন্যতো এখানে আর কেউ অপেক্ষায় নেই। আমাকে এভাবেই জোড়াতালি দিয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে।এভাবেই মানিয়ে নিতে হচ্ছে।
রাহাত শিহাবের কষ্ট বুঝতে পারলো।তাকে আশ্বাস দিলো, শীঘ্রই আপু আপনার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষায় থাকবে। দিনশেষে আপনি যখন ঘরে ফিরবেন আপু আপনার দরজা খুলবে। আপনাকে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতে কাপড় এগিয়ে দিবে।আপনার পছন্দের খাবার রান্না করবে।আপনারা একসাথে বসে কফি খাবেন।একসাথে ঘুরে বেড়াবেন! রাহাতের কথায় শিহাবের চোখ চকচক করে উঠছিল! সুন্দর আগামীর আশায় তার মনে স্বপ্নেরা উঁকি দিচ্ছিল।শিহাব বুঝতে পারলো হয়তো এতদিন সে রাহাতের মতই কাউকে মনে মনে খুঁজছিল যার কাছে মন খুলে সব কথা বলা যায়। যে তার না বলা কথাগুলোর বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এগিয়ে আসবে।চমৎকার কিছু সময় কাটলো দুজনের। শিহাব মনের ভেতর অপার এক আনন্দ নিয়ে আজ ঘরে ফিরলো।মনে হলো সত্যিই পৃথিবীটা খুবই সুন্দর! এখনো সব বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে ভালবাসার জন্য মানব হৃদয় উদ্বেলিত হয়।এখনো নিঁখাদ ভালোবাসার মূল্যায়ন হয়। তার মনে হলো নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে সে কোন ভুল করেনি।হয়তো এমনই হয়,খারাপ সময় খুব বেশিদিন থাকেনা।শুধু শক্ত মনে দুঃসময়টাকে মোকাবেলা করতে হয়।শিহাব শায়লাকে ভেবে স্বপ্নের দোলায় দুলছে আজ।মনে হচ্ছে শায়লা তাকে ঘিরে আছে।শায়লার নিঃশ্বাস,শায়লার মাঝে গোলাপের সুরভির উন্মাদনা খুঁজে পাচ্ছে। খালি ঘরটাতে ঢুকেও শিহাবের মনটা আজ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে আছে! যেন ঘরময় শায়লার উপস্থিতি সে টের পাচ্ছে।যেন এক্ষুনি শায়লা এসে বলবে, আহ! শিহাব,কত ক্লান্ত তুমি আজ, এ কথা বলেই হাতটা এগিয়ে সবকিছু নিয়ে শিহাবকে ভারমুক্ত করবে। আর শিহাব শায়লার অমন অপরূপ মায়াভরা কান্তির মুখাবয়াবে তাকিয়ে দিনের সব ক্লান্তি ভুলে যাবে। চট করে সে এক টানে শায়লাকে বুকে টেনে নিবে।শায়লার শত আপত্তিতেও একটি গাঢ় চুম্বনে তাকে আবেশিত করবে। শায়লার ছাড়িয়ে নেয়ার শত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে শিহাব শক্ত করে তাকে বুকের সাথে বেঁধে রাখবে। যেন কত যুগের জমাটবাঁধা ব্যথার বরফ শায়লার বুকের উষ্ণতায় গলতে শুরু করবে।
রাহাত আজ এমনি করে শায়লাকে কাছে পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছে।বয়সে ছোট হলেও রাহাত সবই বুঝতে পারছে।শিহাবের মন চাইছিলো রাহাতকে অতীতের সব খুলে বলতে কিন্তু রাহাত যেন শিহাবের সব কষ্ট বুঝে নিয়ে তা লাঘব করার জন্য নিজেকে প্রত্যয়ী করে তুললো। শিহাব ভাবলো,
রাহাতের মত এমন একটা ছোট ভাই আছে বলেই শায়লাকে পাওয়ায় আর কোন বাধা থাকলো না। আর শায়লার মত বোন যার আছে সেই ভাইতো পৃথিবীর ভাগ্যবানদের একজন। এমনি নানান ভাবনায় শিহাব মনের অজান্তেই নিজেকে শায়লার পরিবারের একজন ভেবে নিলো। বহুদিন শিহাব নিজ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।মা,বাবা,আরাফ, ভাবী,ভাতিজা, ভাতিজি, ভাইয়া সবাইকে ভীষণভাবে মিস করছে আজ। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা নিজেদের বাড়িঘর এলাকা সব ফেলে এসে অচেনা মানুষজনের সাথে থাকতে হচ্ছে।তবে শিহাব আশায় বুক বাঁধলো,শায়লাকে নিয়ে আবার তাদের পরিবার হাসি আনন্দে মেতে উঠবে। রিশতিনার সেই ঘটনাটির পর শিহাবদের পরিবারের আনন্দ যেন থমকে আছে।শায়লার প্রতি শুধু শিহাবের অগাধ বিশ্বাস শায়লা সবাইকে আপন করে নিবে,মা ভাবী তারাও শায়লার আপনজন হয়ে উঠবে! শিহাবের মনে হলো চারদিকের ছড়ানো ছিটানো সব দুঃখ কষ্ট গুলো যেন নিমেষেই দূর হয়ে যাচ্ছে, এক সুখের হাতছানিতে সবকিছু এক কেন্দ্রে একীভুত হচ্ছে। শিহাবের মনের ভেতর নানান কথার ঝড় উঠেছে।শায়লাকে সব বলতে হবে।আজ রাতেই শায়লাকে সব বলবে সে।
শিহাব ফ্রেশ হয়ে স্লিপিং স্যুট পরে নিলো। ঘুমানোর আগে এক কাপ র'কফি হলে দারুন হতো।কিন্তু আলসেমিয়ে তা আর হলোনা।এখন শায়লার দিকেই মনের পাল্লা ভারী হয়ে আছে।কাল সকালে শায়লাকে নিয়ে জিগাতলার বাসায় যাবে। শায়লার সাথে এ ব্যাপারেও একটু কথা বলে নিতে হবে।ওকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিতে হবে।তবে বাসার সবকিছু আগে থেকে জানাবে না,তাহলে শায়লার কাছে কোন কিছুই নতুন মনে হবে না। আরাফের সাথে শায়লার প্রথম দেখা হওয়ার ক্ষণটার জন্য শিহাব উদগ্রীব হয়ে আছে। শায়লাকে বলবে কাল তুমি সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি পরবে।শিহাবের মায়ের সবুজ রংটা খুব পছন্দ।
শিহাব ঘড়ি দেখলো। রাত প্রায় বারো টা ছুঁইছুঁই।নিশ্চয়ই শায়লা অপেক্ষায় আছে।শিহাব দেখেছে যত রাতেই শায়লাকে সে নক দেয় না কেন,শায়লা থেকে তার রিপ্লাই আসবেই।কিভাবে যে ঘুমায় বুঝিনা! সে নাকি জেগে জেগে ঘুমায়! এ এক অদ্ভুত জীবনযাপন!
শায়লা ঘুমিয়েছো?
উহু,,
কেন ঘুমাওনি?
তোমার জন্য অপেক্ষায়।
আমি যদি নক না দিতাম?
সারারাত অপেক্ষায় থাকতাম।জেগে থাকতাম।
কি বলো? এমনটি করলে শরীর খারাপ করবে।
হউক,তোমার জন্য আমি জেগেই থাকবো।
তারপর সারাদিন ঘুমাবে? তাহলে সংসার দেখবে কে?
রাতজেগে থাকাটাই আমার আসল সংসার বুঝলেন জনাব।
শিহাবের হাতে মেসেজ লিখে যেন মন ভরছে না। লেখায় কি আর সব অনুভুতি প্রকাশ করা যায়? শিহাব কল দেবার অনুমতি চাইল।
শায়লা সম্মতি জানাতেই মেসেঞ্জারে শিহাবের মুখটা ভেসে উঠলো।যে মুখটা দেখবার জন্য শায়লা দিনরাত অপেক্ষায় থাকে,কিছুদিন না দেখলে আকুল হয়ে উঠে,একটিবার দেখবার জন্য মন ছটফট করতে থাকে।
শায়লার নীরবতায় শিহাব কথা বলা শুরু করলো,
শায়লা তুমি কি বুঝতে পারছো আমরা একটু একটু করে কোনদিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
কোনদিকে আবার? ভাললাগছে এটাইতো সব! এই যে কথা বলছি, আর কি লাগবে ?
নাহ,এটাই সব না। কাল আমাদের পরিবারের সবার সাথে পরিচয় হবে এরপর তুমি শুধুই আমার হবে,শুধুই আমার।
কথাগুলো বলতে বলতে যেন শায়লাকে তার খুব কাছে পাওয়ার অনুভুতিতে শিহাব ওপ্রান্ত থেকে অস্ফুট এক মায়াজড়ানো কন্ঠে শায়লাকে জড়িয়ে নিতে চাচ্ছে।বারবার বলছে,শায়লা আমি টের পাচ্ছি তুমি আমার খুব কাছে চলে এসেছো। আমি তোমার সবটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছি ।
শায়লা বুঝতে পারছে না শিহাবের এই মনের অবস্থায় তার কি করা উচিত। তার ভেতরেও অনেক কিছু ভেঙে মুচড়ে যাচ্ছে। অনেক অপ্রকাশিত অনুভুতির প্রকাশে শায়লাকে আপ্লুত করে তুলছে। দেহের শিরা উপশিরায় রক্তের স্রোত বাড়ছে। হৃদ কম্পনের আওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছে,আর তা ক্রমশই বেড়ে চলছে। শায়লা বুঝতে পারছে না কেন তার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না।অন্ধকারেও শায়লার চোখ শিহাবকে দেখতে পাচ্ছে।মনে হচ্ছে শিহাব তার খুব কাছে এসে বসেছে।খুব কাছে,নিঃ শ্বাসের দূরত্ত্বে তাকে উষ্ণতায় বাঁধতে চাইছে। শায়লা শক্ত করে চোখ বন্ধ করে অনুভবের পূর্ণতায় এক সুখানুভবে নিজেকে ভরিয়ে নিলো।
দুজনেই কিছুক্ষন নীরব রইল। শায়লা কল কেটে দিলো। বেড সুইচে ঘরে আলো জ্বালালো। মুখে হাত বুলিয়ে দেখলো বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। নিজেকেও কেমন যেন নিস্তেজ লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ! শায়লা পাশে রাখা এক গ্লাস পানি গলায় চালিয়ে নিলো।ভীষণ ইচ্ছে করছিল,এখন শিহাবকে কাছে পেতে। হঠাৎই আয়নায় চোখ পড়লো শায়লার।নিজেকে দেখে নিযেই লজ্জা পেয়ে গেলো।শায়লা দ্রুত ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে দু'হাঁটুর উপর মাথা গুঁজে বসে রইল।ভেতরে এক চাপা উত্তেজনা।যেন শিহাবের ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব! শায়লার ভেতর থেকে কান্নার সাগর উগড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।নিজেকে অসহায় লাগছে।শিহাবের কাছে আশ্রয় খুঁজে ফিরছে। শায়লা মনের অজান্তেই কয়েকবার শিহাব শিহাব বলে ডেকে উঠলো।কিন্তু শব্দগুলো যেন কন্ঠ থেকে বেরুলো না তবুও শায়লার এ ডাক যেন শিহাবের কানে গিয়ে ঠিকই পৌছুলো।
তক্ষুণি শিহাবের মেসেজ এলো।
শায়লা কি করছো?আমি তোমার ডাক শুনেছি।এইতো আমি, দেখো তাইতো সাড়া দিলাম!
শিহাব এক মূহুর্ত দেরি না করে আবার মেসেঞ্জারে কল দিলো। শিহাবের ভরাট কন্ঠে
শায়লা ! ডাকটিতে শায়লা যেন আরো বেশি আবেগাপ্লুত হলো! শায়লা বুঝতে পারে না, কেন, যত রাত বাড়ে আর ততই আবেগের এমন চেপে বসা। এমন আবেগী কন্ঠে নিজেকে সঁপে দেয়া।বাইরে রাতের আঁধার যতই ঘন হতে থাকে চাওয়া পাওয়ার প্রাবল্য ততই যেন ঘিরে ধরতে থাকে ।মনে হয় যেন শত্রুপক্ষের প্রবল আক্রমণে প্রতিপক্ষকে জয় করে নিতে চাইছে।শায়লা বুঝেনা, দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকা অনুভুতিগুলি যেন রাত হলেই প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ওদের পাওনাগুলো বুঝে নিতে চায়। বিনিময়ে জীবনাতিপাতে বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।শায়লা জীবনের এই বাঁকগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।কেন দিন আর রাতের এই বৈষম্যের খেলা? কেন একজন মানুষের ক্সছেই সবটা সমর্পিত থাকে।কেন হাজারো মানুঢের চলাচলেও শুধু একজিন মানুষই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এসবের উত্তরে শুধু শিহাব ন্সমটই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে! শায়লা কোথায় যেন ভাবনার অতলান্তে ডুবেছে সাথে কিছু লজ্জাও মিশেছে।
শিহাব ওপ্রান্তে অপেক্ষায়।শায়লা,আমি তোমার জন্য নতুন করে বাঁচবার প্রেরণা পেয়েছি।তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না।
চলবে....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much