২৩ জানুয়ারী ২০২২

মমতা রায়চৌধুরী'র ধারাবাহিক উপন্যাস ৯৭




উপন্যাস 

টানাপোড়েন৯৭
অসহায়তা

মমতা রায়চৌধুরী


নদী উদভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছিল নার্সিংহোমে। সমুদ্র দ্রুত বাইক চালিয়েছিল কিন্তু তাতে কি হবে ট্রাফিক জ্যাম ও প্রচুর। 
নদী শুধু সমুদ্রকে বলতে লাগলো 'একটু তাড়াতাড়ি চল?'
সমুদ্র বলল 'আমি চেষ্টা করছি তো বাবু।'
নদী আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল
'আমার জন্যই বোধহয় সবকিছু হলো।'
সমুদ্র মেডিকেল কলেজ থেকে  ছুটে গিয়েছিল নদীকে ধরার জন্য ।তারপর দ্রুত বেগে গাড়ি নিয়ে উডল্যান্ড নার্সিং হোম এর দিকে। 
রূপসার হঠাৎ ভীষণভাবে গল গল করে ঘাম  দেখে ঝরনা ঘাবড়ে  যায় ঠিকই কিন্তু দ্রুত ছুটে এসে বলতে থাকে 'বৌদি ,বৌদি ,কি হয়েছে তোমার? কি হয়েছে বলো ,একবার আমাকে বল?'
রূপসার তখন বুকের ভেতরে একটা তীব্র যন্ত্রণা যেন কাঁকড়া বিছের  মত কামড় তার হৃদপিন্ডে বসিয়েছে। কোনমতে তার নিজের বুকটাকে হাত দিয়ে দেখাতে পেরেছে ঝর্নাকে।
ঝরনা অত্যন্ত উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারিণী। সে কাল বিলম্ব না করে তার বৌদির ফোন থেকে ফোন করেছে তাদের অফিসের বস মিস্টার মালহোত্রাকে।'
রূপসার ফোন থেকে ফোন যেতেই মিটার মালহোত্রা অত্যন্ত প্রসন্ন কণ্ঠে বলেন 'হ্যাঁ রেস্ট হলো ,কেমন আছো?'
এ প্রান্ত থেকে ঝরনা বলে ওঠে ' আমি রুপসা বৌদির বাড়ির কাজের মেয়ে।'
মিস্টার মালহোত্রা বলেন' ও ।কিছু কি হয়েছে?'
ঝরনা বলে' হ্যাঁ ,স্যার ।বৌদির হঠাৎ করেই বুকে যন্ত্রণা ।কি করব বুঝে উঠতে পারছি না?'
মিস্টার মালহোত্রা বলেন 'সেকি কথা ইমিডিয়েট অ্যাম্বুলেন্স খবর করুন। আচ্ছা, ঠিক আছে আপনাকে করতে হবে না ।আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।'
ঝরনা ভরসার কন্ঠে বলে 'ঠিক আছে, স্যার। তাই হোক  কোথায় নিয়ে যাবেন?'
মিস্টার মালহোত্রা বলেন 'উডল্যান্ড নার্সিং হোম।'- বলেই ফোনটা কেটে দেন।
অ্যাম্বুলেন্স আসার মাঝের সময়টিতেই ঝরনা ফোন করে দিয়েছিল নদীকে, তার মায়ের কন্ডিশনের কথা জানিয়ে।
এর মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হয়ে
 যায়। রুপসাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স  দ্রুতগতিতে নার্সিংহোমে পৌঁছে যায়। 
ওখানে পৌঁছাতেই মিস্টার মালহোত্রার তদারকিতে রুপসাকে প্রথম ইসিজি করা হয়। ইসিজি রিপোর্টে দেখা যায় এটা ততটা মারাত্মক নয় । হার্টে ধাক্কা লেগেছে ঠিক ই কিন্তু প্রাচীর তার অক্ষত
 আছে। তখন সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস 
ফেলে ।
ডাক্তারবাবু ,মিস্টার মালহোত্রাকে বলেন 'এটা এতটা মারাত্মক নয় ।টোটাল বেডরেস্ট এর প্রয়োজন আর শরীর মনটাকে ঠিক রাখার জন্য এখন ডাক্তারদের তদারকিতে রাখতে হবে ।সে ক্ষেত্রে নার্সিংহোম সবথেকে উপযুক্ত নিরাপদ জায়গা।'
মিস্টার মালহোত্রা বললেন ' আপনারা যেটা বুঝবেন ,সেই ভাবেই কাজ করা হবে।'

সমুদ্র নদীকে নিয়ে বাইক দ্রুতগতিতে চালিয়ে মেডিকেল কলেজ থেকে রবীন্দ্রসদনে পৌঁছায় উডল্যান্ড নার্সিং হোমে।
নদী  উদভ্রান্তের মতো এসে নার্সিংহোমে যখন ঢোকে, তখন দেখতে পায় নার্সিংহোমের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ঝরনা। একটা অশান্ত উদ্বেগ চোখেমুখে।
নদীকে দেখে ঝরনা বলে'
'মামনি ,বৌদি ভিতরে। এখন কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বাইরে ওয়েট করো।'
নদী ঝর্ণাকে বলে' মাসি আগে বলো মা কেমন আছে?'
ঝরনা বলে 'বললাম তো ঠিক হয়ে যাবে , অতটা মারাত্মক নয়।'
নদী বলে 'কি হয়েছে মায়ের?'
ঝরনা বলে' হার্ট অ্যাটাক।'
নদী খেয়াল করল মিস্টার মালহোত্রা এসেছেন। কিন্তু আজকে মিস্টার মালহোত্রাকে দেখে নদীর কোন বিরক্তি চোখে মুখে নেই। শুধু এই টুকুই প্রত্যাশা মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুক।
বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সকলে। নদীর যেন মনে হলো তার মায়ের থেকে সে আলোকবর্ষ দূরে আছে।
ঝর্ণা নদীকে বলল 'তোমার মাসিমনিকে ফোনটা করো খবরটা জানাও। দাদুকেও  খবর টা জানাও।
তোমার কাকাকে আমি ফোনটা করে দিয়েছি।'
নদীর পেছনে নদীর বন্ধুরাও এসে হাজির হয়েছে। মাসিমনির ফোনটা নম্বর ডায়াল করল রিং হতে লাগলো । একবার বেজে যাবার পর আবার রিং করলো ।
এবার অপরপ্রান্ত থেকে ফোনটা রিসিভ করে বলল ' হ্যালো।'
নদী বলল  'মাসিমনি আমি নদী বলছি।'
টুকাই ফোন ধরে বলল ', দিদিভাই তুমি ভালো আছো?
নদী বলল  'হ্যাঁ ,আছি একরকম। মাসিমনি আছে রে?'
টুকাই বলল' এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি তুমি একটু হোল্ড করো দিদিভাই।'
'মা ,মা.আ.আ.আ,মা…
বিপাশা রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দিল
' কি হলো এভাবে চিৎকার করছো কেন?'
টুকাই বলল 'দিদি ভাই ফোন করেছে।'
বিপাশা বলল' হ্যাঁ ,যাচ্ছি দাঁড়া।'
বেসিনের কল টা বন্ধ করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে তাড়াতাড়ি চলে আসলো এবং ফোনটা রিসিভ করে বললো' হ্যাঁ বল স্রোতস্বিনী। কেমন আছিস?'
নদী ডুকরে কেঁদে উঠে ।
বিপাশা বলে' কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল আমাকে?
নদী বলে 'মাসিমনি, মা ,মা, মা বলতে বলতেই গলা ধরে আসে।
বিপাশা বলে" কি হয়েছে দিদি র।'
নদী বলে মাকে ' নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।'
বিপাশা বলে 'সে কিরে ?এখন কেমন? ঠিক আছে সব?'
নদী বলে 'ডাক্তারবাবু বলেছেন অতটা ঘাবড়ানোর কিছু নেই। মাকে এখন চেকাপ করা হচ্ছে  কমপ্লিটলি নাকি বেড রেস্টে থাকতে 
হবে ।অবজারভেশনে থাকবে নার্সিংহোমে।
বিপাশা বলে 'থ্যাংকস গড ।ঠিক আছে কাঁদিস 
না ।আমরা আগামীকাল যাব ।রাতে খবর নেব কেমন থাকে বলিস ।'
নদী বলল 'কালকে আসবে মাসিমনি?
বিপাসা বলল 'এত রাত হয়ে গেছে, বাচ্চাদের নিয়ে...।'
নদী বুঝল 'তাই তো মাসিমনি ও   সংকটের মধ্যে আছে।'
 তারপর বলল  'ঠিক আছে।'
ইতিমধ্যে মিস্টার মালহোত্রার সঙ্গে ডাক্তারবাবু হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন ঘরে ।
নদীর হাতের  চাপ অজান্তেই ঝরনার হাতের ওপর পড়েছে ।খরস্রোতা নদীতে মানুষ যখন ডুবে যেতে বসে তখন যেমন সে ভাসমান কচুরিপানা দেখলে তাকে আঁকড়ে ধরতে চায়, ঠিক তেমনি।
কতটা অসহায়ত্ব ছুঁয়েছিল নদী আর ঝর্ণাকে। ঝরনা বুঝেছিল সত্যিই ঝর্নার না যতটুকু বিপদ হবে , বিপাশা না থাকলে, তার থেকে বেশি বিপদ হবে নদীর ।কারণ ঝরনা একটা জীবন পার করে এসেছে ।সে নিজেকে কোনমতে মানিয়ে নিতে পারবে কিন্তু এই বিপুলা পৃথিবীতে নদীর কি 
হবে? কারণ নদী যতই মাকে নির্লিপ্ত ভাবুক না  কেন ?তার মাথার উপর ছাতা হয়ে রয়েছে। 'শিকড় উপড়ানো অসহায়তার কাছে নিজের কষ্ট অভিমানগুলো সবকিছুই যেন মনে হলো আজ তুচ্ছ।
দুজন অসহায় জীব পরস্পর পরস্পরকে হাতে হাত রেখে জীবনের গিরিখাত , ধ্বস পার করতে চাইছে। চলো দুজনে বলতে চাইছে ' আয় বেঁধে বেঁধে থাকি"।
মিনিট দশেক পরে ডাক্তারবাবু বেড়িয়ে আসলেন এবং বললেন ঘাবড়াবার কিছু নেই ।একটা টেনশন থেকে বোধ হয় এরকম কিছু একটা ঘটেছে।
মিস্টার মালহোত্রা এসে নদীর মাথায় হাত রেখে বললেন 'টেনশন নিও না। আমরা আছি।'
যে লোকটার প্রতি এতটা বিরক্ত, এতটা ঘৃণা জমে ছিল ,নদীকে সেই লোকটাই  মাথায় হাত রেখে আশ্বাসবাণী শোনাচ্ছেন ।নদীর মুখ যেন অনেকটা স্বাভাবিক ।শুধু মাঝে মাঝে ঠোঁট দুটো অল্প নড়ে উঠলো ।কিছু বলতে পারলো না।
ঝরনা খেয়াল করছিল নদীকে। নদী আবার না কোন সিনক্রিয়েট করে ফেলে ?
কিন্তু না, নদী আজ কিচ্ছু করে নি। নদীর সে অবস্থাও নেই ,সেরকম কিছু করার। আজকে তার কাছে তার মায়ের মুল্য অনেক বেশি মনে হয়েছে।
 আজ নদীর বুকে উথাল পাথাল ঢেউ ঢেউ। কি করলে  শান্ত হবে  , ঝড় থেমে যাবে ,বৃষ্টির বেগ কমে যাবে । নতুন ভাবাবেগের উচ্ছ্বাসে  মেতে উঠবে আবার স্রোতস্বিনী। নাকি কোনো অন্ধকার অধ্যায় শুরু হবে তার জীবনে ?সে কি হারিয়ে যাবে কোন পঙ্কিল আবর্তে যেখানে সহস্ত্র শৈবালদাম এসে বাসা বাঁধবে। নিজের মনের আশঙ্কা ছাপিয়ে তাকে যেন ক্রমশ সেই অসহায়তা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। নদী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার মায়ের কেবিনের দিকে। নদীর চোখ জলে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে ।সে শুধু মনে মনে ভাবে তার মায়ের উপর নির্ভর করছে তার জীবনটা। সে কি এবার বিশাল জনসমুদ্রে একলাই হাঁটবে নাকি তার মা তার পাশে থাকবে সর্বদা ।সন্ধ্যায় শহরে যখন রাস্তার বাতিগুলো এক এক করে জ্বলে
 ওঠে ।তখন মনে হয় নদীর এই শহরে কেউ এমন  কি আছে যে তার সত্যি কারের বন্ধু হতে
 পারে ?হৃদয়ের জমা কষ্ট, অভিমান, যন্ত্রণা গুলোকে তার কাছেই শুধু বলতে পারে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much