শায়লা শিহাব কথন
অলিখিত শর্ত (পর্ব ২৮)
শামীমা আহমেদ
বেশ কয়েকদিন জ্বরে ভুগে শিহাব আজ বিছানা ছাড়ল। শরীরটা বেশ দূর্বল লাগছে। ঘুম থেকে জেগে ঘরের চারিদিকে চোখ বুলালো। ঘরটা বেশ গোছগাছ করা। শিহাব বুঝতে পারছে না সবকিছু কিভাবে এত সুন্দর পরিপাটি করে রাখা। শিহাব নিজেকে সুস্থ ভাবছে। একবার হাত পা নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে নিলো।হ্যাঁ ভালোই লাগছে। তবে বিছানাটা একেবারে এলোমেলো হয়ে আছে।খাটের পাশে বাটিতে পানি রাখা।জলপট্টি দেয়ার কাপড়ের টুকরাটা বালিশের
পাশে পড়ে আছে।শিহাব বুঝতে পারছে না কিভাবে কি হলো! শুধু এটুকু মনে পড়ছে অফিসে বেশ খারাপ লাগছিল।দুপুরের পর পরই তাই অফিস থেকে চলে আসে।তারপর কোনমতে দরজা খুলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।শিহাব দেখছে একটু দুরেই তার জুতা মোজা খোলা। গায়ে সেই দিনের অফিসের পোশাক। শিহাব আর কিছুই মনে করতে পারছে না।শিহাব পাশে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলো। একেবারেই চার্জ নেই।শিহাব বুঝতে পারছে না সে কতদিন ঘুমিয়ে ছিল? নাকি সে কী রিপ ভ্যান উইংকেলের মত কয়েকশত বছর ঘুমিয়ে ছিল?
শিহাব বুঝতে পারলো সে প্রচন্ড জ্বরে পড়েছিল।তবে এখন ভাল লাগছে।একটু ফ্রেশ হতে হবে।অফিসে যেতে হবে।এ'কদিনে অফিসের কী অবস্থা তা আল্লাহই জানেন।
শিহাব হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে বেন্সনের প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখলো মাত্র একটি স্টিক অবশিষ্ট! শিহাব লাইটার ক্লিক করে সিগারেট স্টিকটা জ্বালিয়ে নিয়ে বেশ লম্বা একটা সুখটান দিল।যতকিছুই জীবনে পাওয়া হোক না কেন যারা স্মোক করে তারা জানে পৃথিবীতে এরচেয়ে সুখকর আর কিছু নেই! শিহাবের মনে হলো জীবন থেকে সব দুঃখ ঝরে গেলো!
শিহাব বিছানা ছেড়ে উঠলো। মোবাইলটা চার্জে দিয়ে গিজারটা অন করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। চারিদিকে সকালের আলো।গাছের ডালে পাখিদের কিচিরমিচির ডাকাডাকি।শিহাব বুঝলো বেঁচে থাকটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।
দরজায় কলিং বেল।শিহাব দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। দেখলো দরজার লক খোলাই আছে।শিহাব বেশ অবাক হলো! তবে কি এ'কদিন দরজাটা ভেরানো ছিল। তবে কী সেদিন আর দরজা লাগানোই হয়নি!
শিহাব দরজা খুলতেই দেখলো কেয়ারটেকার বেলাল দাঁড়িয়ে। হাতে বিশাল একটা ট্রেতে অনেক খাবার দাবার সাজানো। শিহাব অবাক দৃষ্টিতে বেলালেরে দিকে তাকালো।
বেলাল বললো,নীচতলার অপুর আম্মু ম্যাডামে আপবার জন্য নাস্তা পাঠাইছে।
এই কয়দিন আপনার কি বেদম জ্বর!
সেইদিন আমি ছাদে তালা দিয়া নামার সময় দেহি আপনার ঘরের দরজা খোলা।অনেকবার বেল দিয়াও যখন আপনার কোন আওয়াজ পাই নাই তখন ঢুইক্কা দেখি আপনি জ্বরে বেহুশ।আমি সারারাত আপনার পাশে বইসা ছিলাম।মাথায় জলপটী দিলাম।সেকি জ্বর? আপনি শুধু শায়লা শায়লা করতাছিলেন।আচ্ছা স্যার শায়লা কে? আপনার মাইয়া?
শায়লা! নামটা শুনে শিহাব এবার যেন নিজের মাঝে ফিরে এলো! সে রাতে বেলাল জলপটী দিয়েছিল? তবে যে সে শায়লাকে দেখেছিল।সে শায়লার হাত ধরে রেখেছিল।শিহাবের অনুভুতি বলছে শায়লা তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিল।শিহাব গভীর চিন্তামগ্ন হতে যায়।
বেলাল বলে উঠলো,স্যার নাস্তা রাইখখা গেলাম।ভালোমত পুরাডা খাইবেন।জ্বর থেকে উঠলে খুউব কাহিল লাগে।বেলাল নাস্তার ট্রে ডাইনিং টেবিলে রেখে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেলো।শিহাব দেখলো বেশ যত্ন করে সাজানো নাস্তার বাটি পেয়ালা।শিহাব হটপট খুলে দেখল গরম লুচি।সাথে বাটিতে লাবরা সবজি,ঘন করে বুটের ডাল,ডিম পোচ,এক বাটি পায়েশ,দুইপিস পাউরুটিতে বাটার দেয়া।আর একটা ছোট্ট ফ্লাস্কে চা।খুব কিউট একটা ফ্লাস্ক! মনে হচ্ছে একটা পান্ডা বসে আছে।শিহাব পান্ডাটির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো! হঠাৎ শায়লার মুখটি ভেসে উঠল।শায়লা থাকলে নিশ্চয়ই ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢেলে দিতো।শায়লার কথা মনে হতেই শিহাবের মন চাইল ওকে একটা কল করতে।পরক্ষনেই ভেবে দেখল নাহ! এখন না।অফিসে গিয়ে সময় নিয়ে কথা বলবে।শিহাব এক কাপ চা ঢেলে নিলো।সাথে সিগারেট স্টিকেও টান চলছে। দুটো শেষ করে শিহাব ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলো।আহ! কতদিন পর আজ শাওয়ার ছেড়ে গোসল করবে। নিজের প্রিয় সুগন্ধির সাবান শ্যাম্পু দিয়ে আজ ওয়াশরুম সুগন্ধে ভরিয়ে দিবে।এইসব সৌখিনতা শিহাবের বহুদিনের!শিহাব গিজারের সুইচ অফ করে আকাশী নীলরঙা বড় টাওয়েল টা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।
বেসিনের আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিল। দাঁড়ি গোঁফে মুখ একাকার। চুলও বেশ বেড়েছে।শিহাব বেসিনের কল ছেড়ে চোখ বন্ধ করে মুখে বেশ কয়েক ঝাপটা পানি ছুড়ে দিলো।মনটা আনন্দে ভরে উঠল! ঠিক এই সময়টায় শায়লাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে শায়লা যদি পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরত! ধূর! কি সব আবোলতাবোল ভাবছে। শিহাব একহাতে
শেভিং ফোম স্প্রে আর আরেক হাতে রেজর নিলো।
আর মনে মনে ভাবলো অফিসে যাওয়ার সময় নীচতলার অপুর আম্মু ভাবীকে নাস্তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে যাবে।
শায়লার প্রতিদিন এই একটিই কাজ। আর তা হলো দুপুরের জন্য রাতেই রান্নাবান্না গুছিয়ে রেখে দেয়া।আর সকাল হলেই নাস্তা সেরে নিয়ে লিস্টি দেখে শপিংএ বেরিয়ে যাওয়া।
নাস্তার পর শায়লা গোছলের প্রস্তুতি নিলো।
প্রতিদিন বাইরে যেতে হচ্ছে।ধুলাবালিতে চুলের একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। খুব সুগন্ধযুক্ত শ্যামপু শায়লার পছন্দ। আর এরজন্য তাকে শ্যাম্পু কিনতে গিয়ে অনেকবার ঠকতেও হয়েছে।শায়লা শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নিয়েই তার কোয়ালিটি না বুঝেই তা কিনবে।
শায়লা বেশ সময় নিয়ে গোসল সারলো। তার চুলের ঘ্রাণে ঘর ভরে গেছে।শায়লা চুলের টাওয়েল খুলে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল। আর টাওয়েল দিয়ে ঘষে ঘষে চুল মুছছিল। হঠাৎ মনে হলো শিহাব তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! শায়লা স্পষ্ট শিহাবকে দেখতে পেলো! পরক্ষনেই ভাবলো যাহ! এসব কি ভাবছে? আসলে সারাক্ষণ শিহাবকে ভাবনা থেকে এসব হচ্ছে। কোনদিন কি এটা সম্ভব হবে? শিহাব শায়লার বেডরুমে দাঁড়িয়ে শায়লার ভেজা চুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে আর শক্ত করে শায়লার একটা হাত ধরে রেখেছে!
এসব কি অবান্তর ভাবনা ভাবছে সে! শায়লা নিজে নিজেই লজ্জা পেলো।আজ পর্যন্ত সে শিহাবে চোখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলতে পারেনি তা আবার এত ঘনিষ্ঠতায় তাকে ভাবা। শায়লা ঘড়ি দেখলো।এগারোটা বাজছে। শায়লা আজ মেরুন রংয়ের একটি শাড়ি পরলো। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হলো! শায়লা মায়ের কাছে থেকে টাকা নিয়ে শপিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেলো।
শিহাব অফিসে পৌছে এ ক'দিনের জমানো কাজের মাঝে একেবারে ডুবে গেলো। শায়লাকে আর কল করা হয়নি।দুপুর দুইটা বাজতেই লাঞ্চ টাইম হয়ে এলো। শিহাবের এবার যেন একটু ফুসরৎ মিললো। হালকা কিছু একটা খেতে হবে।সকালে যে জম্পেশ নাস্তা হয়েছে।রাতের আগে আর ভারি কিছু খাওয়াই যাবে না। শিহাব শায়লাকে কল দিলো। মোবাইল বেজেই চলেছে।
শায়লা কেনাকাটায় ব্যস্ত।ব্যাগের ভিতর ফোন বেজেই চলেছে।হঠাৎ দোকানের ছেলেটা বলে উঠল, আফা আপনার ফোন বাজতাছে। শায়লা ফোন বের করে দেখলো শিহাবের পাঁচটা মিসকল।হায়! কিভাবে এমন হলো! শায়লা দ্রুতই কল ব্যাক কিরলো। শিহাব এক রিংয়েই ফোন রিসিভ করলো।যেন শায়লার কলের অপেক্ষাতেই ছিল।
কেমন আছো শায়লা? কোথায় তুমি এখন?
শায়লা জানালো সে ভাল আছে আর সে শপিং এ ব্যস্ত।শায়লা আরো কিছু বলতে চাইল কিন্তু শিহাবের এই একটা দোষ শায়লার কথা ছাড়া সে আর কিছুই শুনতে চায়না।
শিহাব বললো,অনেকবার কল দিয়েছি।
শায়লা জানতে চাইল,তুমি কোথায়?
আমি অফিসে,তুমি?
আমি এইতো নর্থ টাওয়ারে আছি।
লাঞ্চ হয়েছে?
না,কিছু একটা খেয়ে নিবো।আজ অনেক কেনাকাটা।
শিহাব বললো, সে হবে,তুমি নর্থ টাওয়ারের নীচে নেমে আসো।আমি আসছি। তোমাকে তুলে নিয়ে একসাথে লাঞ্চ করবো।শায়লা আর কিছু বলার আগেই শিহাব কল কেটে দিল।শায়লার সম্মতি অসম্মতির অপেক্ষা না করেই।
শায়লা কেনাকাটা বন্ধ রেখে লিফটে নীচে নেমে এলো।শিহাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।শায়লার ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভুতি হতে লাগলো। বারবার লিফটের বাইরে পায়চারী করতে লাগলো।শায়লা ঠিক বুঝতে পারছে না, শিহাব তাকে নিয়ে কতখানি ভাবছে।খুব বেশিদূর কি? নাকি শুধুই সময়ের বয়ে যাওয়া।
শিহাব চলে এলো। শিহাবের বাইকটা দেখে চেনা গেলো।শায়লা শিহাবের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বেশ খেয়াল করে।চোখে সানগ্লাস দেয়া শিহাব হেলমেট খুলে শায়লাকে ইশারায় কাছে ডাকলো। শায়লা কাছে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে বুঝালো পেছনে বসো।শায়লার কেমন যেন একটা বাধা লাগল।কিন্তু শিহাবের অস্থিরতায় আর অমত করা গেলো না। শিহাব বাইকে স্টার্ট দিলো। শায়লা শিহাবের চমৎকার সুগন্ধিতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলো! শায়লা আজ বেরুবার আগে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি আজ শিহাবের সাথে তার দেখা হবে!আচমকা এমন প্রাপ্তি বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগায়।
সিগনালে বাইক থামতেই শায়লা দেখলো শিহাব আজ চমৎকার রঙের একটি টি শার্ট পরেছে। কি জানি কোন কারণে শায়লার শিহাবকে খুব আপন মনে হলো।সে শিহাবকে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আর ভাবতে লাগলো সেই গানটি,,,এই পথ যদি না শেষ হয়,,,,! সিগনালে সবুজ বাতি জ্ব্বলে উঠলো,শিহাব বাইকে স্টার্ট দিলো।
চলবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
thank you so much