১১ ডিসেম্বর ২০২১

মোঃ হা‌বিবুর রহমান ৫ম পর্ব





ইউএন মিশ‌নে হাই‌তিতে গমণ
 ৫ম পর্ব
মোঃ হা‌বিবুর রহমান



অতঃপর নি‌মি‌ষেই আমরা সব অ‌ফিসাররা মি‌নিবাস থে‌কে ঝটপট নামলাম।  বিশাল অট্টালিকাসম ইউএস নেভাল অ‌ফিসার মেসের কারুকার্যম‌ন্ডিত সৌন্দর্য্য ‌দে‌খে সে‌দিন স‌ত্যই মুগ্দ্ধ হ‌'য়ে‌ছিলাম। আজকাল অবশ্য আমা‌দের বঙ্গ‌দে‌শেও সুন্দর সুন্দর  ম‌ডে‌লের বসতবা‌ড়ি কিংবা প্রাসাদসম হ‌রেক রক‌মের ভবন নি‌র্মিত হ‌'চ্ছে আমা‌দের বঙ্গীয় সোনার ছেলে‌দের স‌ক্রিয় তত্বাবধা‌নে। 

যা‌হোক, এখন আমা‌দের জন্য প্রধান ও মূখ্য কাজ হ‌লো ঝটপট স্নানটা সে‌রে ফেলা। নেভাল সা‌র্জেন্ট সা‌হেব আমা‌দের‌কে বিশ্রা‌মের কামরাটা দেখা‌নোর সা‌থেই ব‌লে দিয়ে‌ছি‌লো যে আধা ঘণ্টার ম‌ধ্যেই আমা‌দের রে‌ডি হ‌'তে হ‌বে। একথা বলাও সারা তারপর আর সার্জেন্ট সা‌হে‌বের দেখা মি‌লে‌নি, বু‌ঝি চম্পট দি‌য়ে‌ছে অন্য কোন কা‌জের স্বা‌র্থে। 

মা‌ঝে মা‌ঝে ম‌নে হ‌'য়ে‌ছে এরা বি‌শ্বের সব‌চে‌য়ে ধণাঢ্য দে‌শের সার্জেন্ট, এ‌দের এত কাজ করার দরকার আ‌ছে কি? এরা যেন বাতা‌সের সা‌থে পাল্লা দি‌য়ে সব সময়ই চলাচল ক‌রে। তাই প্রায়ই আনম‌নে বলতাম "মাফ চাই বাবা তোমা‌দের কা‌ছে। তোমা‌দের এক‌বেলা কাজ না কর‌লে আস‌লে কি আর আ‌সে যায়"? অতঃপর, এক অদ্ভূত ব্য‌াপার ঘট‌লো, স্না‌নে ঢু‌কেই আ‌মি শুরু‌তেই যেন একট‌ু হোছট খেলাম। আমার আ‌দি নিবাস চুয়াডাঙ্গার আঞ্চ‌লিক ভাষায় ব'ল‌তে গে‌লে একেবা‌রে যেন ভ্যাঁকা-চ্যাঁকা খে‌য়ে গেলাম আর কি! কিংবা শুদ্ধ ভাষায় বল‌তে পা‌রেন কিংকর্তব্য‌বিমূঢ় হ‌'য়ে গেলাম। ‌

সে এক এলা‌হি ব্যাপার! সেই ১৯৯৪ সা‌লের স্নানাগার যে এত সুন্দর হ‌'তে পা‌রে এখন চিন্তা ক'র‌লেই যেন ঠুঁশ ক‌রে বেহুঁশ হ‌'য়ে যে‌‌তে পারি। হয়ত এই ২৬-২৭ বছর পর সুক্ষভা‌বে বর্ণনা করা আমার প‌ক্ষে ‌ঠিক এমূহু‌র্তে স‌ত্যিই ক‌ঠিন হ‌বে। ত‌বে এক কথায় বল‌তে পা‌রি- অপূর্ব! আ‌মি গোসলকার্য সমাপ‌নের সময় বেশ একটা মু‌স্কিলেই প‌'ড়েছিলাম আর‌কি। বাংলা‌দেশ সেনাবা‌হিনীতে চাক‌ুরী করার স‌ুবাদে তৎকালীন বি‌ড়িআ‌র এ ডেপু‌টেশ‌নের সময় বি‌ডিআর সদর দপ্তর, পিলখানায় পো‌ষ্টিংকালীন তখন 'ফরেন ডে‌লি‌গেশন ডি‌লিংস' কিংবা অন্য কা‌জে অ‌নেকবারই তখন পর্যন্ত ‌দে‌শের পাঁচতারা সবগু‌লো হো‌টেলের অ‌ভিজ্ঞতা‌ তো একপ্রকার হ‌'য়েই গি‌য়ে‌ছি‌লো। 

বাথরু‌মের ফি‌টিং সি‌ষ্টেম বুঝ‌তে আমার বেশ একটা মূল্যবান সময় খরচ ক'র‌তে হ‌'য়ে‌ছি‌লো। বাথরুমে গন্ডা দু'‌য়েক হ‌রেক রক‌মের তোয়া‌লে ঝুলা‌নো, কোনটা রে‌খে কোনটা ছা‌ড়ি তার সিদ্ধান্ত নি‌তেই অ‌নেকগু‌লো মি‌নিট আমা‌কে ব্যয় ক'র‌তে হ‌য়ে‌ছি‌লো। যাক সে সব কথা। বেশ ক‌য়েক‌টি পা‌নির ট্যাপ দে‌খে স‌ত্যিই হিমশিম খে‌য়ে গি‌য়ে‌ছিলাম। কোন প্রকা‌রে গোছল শেষ ক'রলাম।আহ্, সে যেন এক অনা‌বিল আনন্দ!

যা‌হোক, গোছল শেষে রু‌মে এ‌সেই সেই সেনাবা‌হিনীর কা‌লো রং‌য়ের ইউ‌নিফর্ম প‌রে আবার যথারী‌তি ফাই‌টিং ফিট হ‌য়ে গেলাম এবং মনটাও গোছ‌লের পর বেশ চাঙ্গা হ‌'য়ে গে‌লো। ম‌নে তখন ফুরফু‌রে ভাব। ইউ‌নিফর্ম প‌'রেই এ‌ন্টিরুম বা টি‌ভিরু‌মে আসলাম। ‌সে টি‌ভিরু‌মের বর্ণনা দি‌তে গে‌লে বিশাল একটা ফি‌রি‌স্তি  দি‌তে হ‌বে তাই অ‌তি সং‌ক্ষে‌পে দু' একটা কথা না ব'ল‌লেই নাই তাই ব'ল‌ছি আর‌ কি! 

আলীসান টি‌ভিরু‌মের টি‌ভিটা বিশাল সাই‌জের যা‌তে তিনশ'র অ‌ধিক স্যা‌টেলাইট চ্যা‌নেল ছি‌লো। টি‌ভির রি‌মোর্ট দি‌য়ে বেশ কিছুক্ষণ তাই গুতাগু‌তি ক'রলাম। অ‌নেক চ্যা‌নেলই তো দেখলাম কিন্ত‌ু ভারতবর্ষ/দ‌ক্ষিণ এ‌শিয়ার কোন চ্যা‌নেল চো‌খে পড়‌লো না। ‌সেই সময় আমা‌দের দে‌শে বু‌ঝি হা‌তে গোনা ১০-১২ টা স্যা‌টেলাইট চ্যা‌নেল ছি‌ল মাত্র। আমার ম‌নে আ‌ছে, ঐ সময় একটা রব প্রচ‌লিত ছি‌লো যে, প্রাক্তন প্রে‌সি‌ডেন্ট এরশাদ সা‌হেব না‌কি শুধুমাত্র ১০০ টি এ ধর‌নের স্যা‌টেলাইট চ্যা‌নেল দেখার ‌সৌভাগ্য অর্জন ক‌'রে‌ছি‌লেন। 

এরই ম‌ধ্যে সেই সা‌র্জে‌ন্টের আবার হুংকার। কলিং বেল বা‌জি‌য়ে এ‌ন্টিরু‌মে প্র‌বেশ ক‌রে একই কায়দায় বল‌লো " Sir, if you are ready then let's go to downstairs and board on the bus. Your bus is ready and we will move around our Naval Base, okay sir"? যা‌হোক, আমরা আবার সেই মিনিবা‌সে আসীন হ'লাম। যতদূর ম‌নে প‌ড়ে আমা‌দের এই ফ্লাই‌টে সি‌নিয়র এবং জুনিয়র মিলে মোট ১০ জ‌নের মত অ‌ফিসার এক‌ত্রে ভ্রম‌ণ ক'র‌ছিলাম আর বাকীরা অন্যান্য পদবীর ছি‌লো। 

তা‌দেরকে বেই‌জের অভ্যন্ত‌রে অন্য জাগায় (হ্যাংগা‌রে) রাখা হ‌'য়ে‌ছি‌লো এবং দেখভা‌লের জন্য ‌বেশ ক‌য়েকজন সা‌র্জেন্টও নি‌য়ে‌া‌জিত করা হ‌'য়েছিলো। আ‌মি অতঃপর ঐ সা‌র্জেন্ট‌কে নিঃসং‌কো‌চে জি‌জ্ঞাসা ক'রলাম, "Yes Sergeant, where is the actual location of Pearl Harbour"?  However, he smiled a while and told me, "sir, you have asked me the same question for the third time to me so far I can remember. Sir, Pearl Harbour is no more existing but the entire Naval Base itself was the actual location of Pearl  Harbour. Are you happy now sir"?

এখন বুঝ‌তে আর একটুও দেরী হ‌লো কে‌নো এ বেটা পার্ল হারবা‌রের কথা শু‌নে বার বারই ই‌তিপূ‌র্বে আকুন্ঠ মৃদু হে‌সে‌ছে। খাওয়ার কথা‌তো ভু‌লেই গে‌ছি, ত‌বে ১০০ গজ দূ‌রে দূরে হয় কমলা‌লেবুর, কিংবা আ‌পে‌লের বা আনার‌স জুই‌সের জারের সা‌রিবদ্ধতা ‌ছি‌লো লক্ষণীয়। যে কেউ ইচ্ছা ক'র‌লেই ফিল্টার থে‌কে এসব জুইস ফ্রি খে‌তে পা‌রে। 

আর এমআরই‌ তো আ‌ছেই অজস্র। যা‌হোক, শুরু‌‌তেই সার্জেন্ট আমাদের‌কে প্রশা‌ন্ত মহাসাগ‌রের ধা‌রে ‌নি‌য়ে যে‌য়ে নীল পা‌নি দে‌খি‌য়ে নি‌য়ে আস‌লো এবং তারপর এক এক ক‌রে বেইজ ক্যা‌ম্পের গুরুত্বপূর্ণ ইনস্ট‌লেশন ঘু‌রি‌য়ে আবার আন‌লো অব‌শে‌ষে জাঁকজমকপূর্ণ পূ‌র্বের সেই স্বনামধন্য অ‌ফিসার মে‌সে। আহ্ মনটা খুব খারাপ লাগ‌ছে এ মূহু‌র্তে, ভাবলাম এক বছর কিভা‌বে পরবাসী থাক‌বো এভা‌বে বি‌দেশ বিভুঁই‌তে? মুহূর্তের ম‌ধ্যে ছোট বাবু, সহধ‌র্মিনী, স্নেহময় আব্বা ও মার কথা ম‌নে পড়ে গে‌লো। 

এখনও ঘন্টা চা‌রেক বা‌কী। কি করা যায়, শরীরটা ভীষন ক্লান্ত ম‌নে হ‌'চ্ছিল যেন সারা শরী‌রে চোর পিঁটুনী দিয়ে‌ছে কেউ। ই‌তোম‌ধ্যে সেই ইউএস নেভাল সা‌র্জেন্ট আমা‌দের‌কে রে‌খে মি‌নিবাস নি‌য়ে তার আপন জায়গায় প্রস্হান ক‌'রে‌ছে স্হানীয় সময় ঠিক বিকাল চারটায় ফির‌বে জা‌নি‌য়ে। বিশ্রামরু‌মে যে‌য়ে জানালা দিয়ে পূর্ব‌দিকে উ‌ঁকি দি‌তেই চো‌খে পড়লো রাজধানী হনুলুলুর নয়না‌ভিরাম দৃশ্য। 

আর তিন ঘণ্টা বাদ আবারও একটানা ১২ ঘণ্টাব্যাপী একই প্র‌ক্রিয়ায় আকা‌শে উড়তে হ‌বে, ত‌বে এবার খুশীর খবর হলো আকাশ থে‌কে আকাশে অথবা 'Air to air refueling' অর্থাৎ এক প্লে‌ন থে‌কে অন্য প্লে‌নে জ্বালানী সরবরাহ করা লাগবেনা কারণ এ কাজ‌টি এবার হনুলুলু আন্তর্জা‌তিক বিমান বন্দর থে‌কে বিমান কর্তৃপক্ষ সে‌রে নে‌বেন। আমা‌দের পরবর্তী গন্তব্যস্হল পোর্টোরি‌কোর সেনা প্র‌শিক্ষণ কেন্দ্র ক্যাম্প সা‌ন্টিয়া‌গো‌তে। যাই দে‌খি একটু বিশ্রাম নেওয়া যায় কিনা? 


চল‌বে....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

thank you so much