মমতা রায় চৌধুরী/৭৪





উপন্যাস 



টানাপোড়েন ৭৪

একান্ত মনোভূমি

মমতা রায় চৌধুরী




রেখা সকাল থেকে একটা মনের ভেতরে আলাদা একটা প্রশান্তির জায়গা খুঁজে নিতে চাইছিল। ওদিকে পার্থর মা মানে মাসীমা আগের থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ধীরে ধীরে ফিরছেন সে দিক থেকে একটু টেনশন মুক্ত আবার এদিকে মনোজ ও  ধীরে ধীরে ক্রমশ উন্নত পর্যায়ে পৌঁছাছে স্বাস্থ্যের দিক থেকে, সে দিক থেকেও মনে একটা আলাদা ভালো লাগার জায়গা তৈরি হয়েছে। শীতের হিমেল হাওয়া গায়ে লাগছে ,তাই এক মুঠো সোনালী রোদ্দুর যেন চাই চাই।তাই ছাদে উঠে আসা। কিন্তু একা একা ভাল লাগছে না ছাদে পায়চারি করতে। 
দোলাচলতায় নিচে নেমে এসে ভাবল ' কি ব্যাপার ,আজকে মিলির বাচ্চাগুলোর কোন সাড়াশব্দ নেই কেন?'
 একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করল। রেখা দেখল "আরে ওরা তো একটার উপর আরেকটা এভাবে শুয়ে আছে। ওদের তো বস্তা পেতে দেয়া হয়েছে। তার পরেও ওদের ঠান্ডা লাগছে।'
 দুধ রুটি খাওয়ার সময় হয়েছে  বলে রেখা সামনের গেটের ছিটকিনিটা যেই না খুলেছে,  ক্যাচ শব্দ কানে যেতেই তিনটে বাচ্চা ছুটে চলে এসেছে। এসেই লেজ নাড়তে শুরু করল আর ওদের ভাষায়' ভোউ ভৌউ..উঃ করতে লাগলো'। কিন্তু লিলিটা বেরোলো না। রেখার সন্দেহ হওয়াতে কাছে গেল ।কাছে গিয়ে লিলিকে কোলে তুলে নিল। দেখল চোখ বুজে আছে।
রেখা  প্রথমে ভাবছে  'কি জানি হয় তো ওর ঘুমোতে ভালো লাগছে ,একটা চোখ খুলে একবার দেখল বটে ।
রেখা মনে মনে ভাবল খাবার দেখলে ওরা সবাই ছুটে আসে আবার কিছুটা অভিমান থাকে কোলে চাপার। কোলে না নিলে ওরা কিছুতেই খেতে আসতে চায় না।
তাই রেখা ওর কাছে গিয়ে বললো' আর ঘুমোতে হবে না ।এসো এবার একটু দুধ রুটি খাও ।'কোলে চেপে বুকের ভেতরে মাথাটা রেখে চুপ করে রইলো।
আজকাল খুব অভিমান হয়েছে ।'ওদের খেতে দিলে প্রথমে কেউ খাবে না কিন্তু গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা প্রত্যেকে এসে হাজির হবে খাবার সময় । অথচ খাবে না। ওদের উপরি পাওনা চাই তবে খাবে।
তখন রেখা ওদেরকে বলল' নে বাবা খেয়ে নে।'
সোনারে বাছারে বলে গায়ে হাত বুলাবে আর এক এক করে কোলে তুলে নেবে ।একজন করে কোলে থেকে নামাবে তারপর তারা খাবে। লিলি  খাবারটা খেলো তারপর আবার ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু মনের ভিতর একটা দুশ্চিন্তা রয়ে গেল, বাচ্চাটার কি হলো?'
রেখা ভাবল 'বেলা বাড়ুক তারপরে দেখা যাবে।'
রেখা বাচ্চাদেরকে খাইয়ে-দাইয়ে সবেমাত্র রান্নাঘরে থালাটা রেখেছে বেসিনে। ঠিক সেই সময় ফোন বেজে উঠলো'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা..
ফোনটা খাবার টেবিলের কাছে রাখা ছিল, ফলে ফোনটা ধরতে অসুবিধা হয় নি রেখার। একবার রিং হতেই ফোনটাকে রিসিভ করতে গিয়ে দেখে বড়দির ফোন।
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলে 'হ্যালো বড়দি।'
বড়দি বললেন' রেখা 'আমি বড়দি বলছি।'
রেখা বলল 'আমি বুঝতে পেরেছি বলুন'।
বড়দি ওর বললেন '12 ক্লাসের প্রজেক্ট খাতা গুলো দেখা হয়েছে তোমার?'
রেখা বলল 'যারা জমা দিয়েছে বড়দি ।তাদেরগুলো দেখা হয়েছে।
'বড়দি বললেন 'কেন তোমার সব খাতা জমা পড়ে নি?'
রেখা বলল 'না। অনেকেই দেয় নি তো?"
বড়দি বললেন' সে কি? আমায় কিন্তু নম্বর দেবে আগামী সপ্তাহে ।বোর্ডে পাঠাবো।'
রেখা বলল" যারা দেয় নি তাদের কি করবো বলুন?'
বড়দি বললেন 'কিন্তু ঐ খাতাগুলো তো তোমাকে কালেক্ট করতেই হবে রেখা ।যেভাবেই হোক।'
রেখা বলল'দিদি আমি গ্রুপে মেসেজ করেছিলাম?'
বড়দি বললেন'কোন রেসপন্স পাওনি। খাতা জমা দেয় নি।'
রেখা বলল' না দিদি।'
বড়দি বললেন' তাহলে এবার ফোন করো?'
রেখা বলল'তাহলে এবার ফোন করব? দেখি কি হয়?
বড়দি বললেন হ্যাঁ সেটাই করো।:
রেখা বলল 'বড়দি অন্য  সাবজেক্টের কি সব প্রোজেক্ট পেয়েছে?'
বড়দি বললেন 'অনিন্দিতা তো বলছিল ইংরেজি প্রজেক্ট কিছু বাকি আছে?'
রেখা বলল 'ও আচ্ছা ‌আমি ভাবলাম শুধু আমার সাবজেক্টটাই বোধহয় বাকি আছে?'
বড়দি বললেন 'আসলে আমি তোমাকে আগে থেকে ইনফর্ম করলাম । তুমি তো স্কুলে আসছো না ।তোমার ক্ষেত্রে হয়তো অসুবিধা হবে এই জন্য।'
রেখা বলল 'হ্যাঁ দিদি ,ঠিকই বলেছেন।'
বড়দি বললেন' ঠিক আছে। সাবধানে থেকো ।ভালো থেকো। রাখি।'
রেখা বলল" দিদি ,আপনিও খুব ভাল থাকবেন।'
ফোনটা কাটার পর রেখা আপন মনে বলতে লাগল বাপরে বাপ আজকালকার মেয়েদের কোন রেসপন্সিবিলিটি নেই ।ওরা জানে যে প্রজেক্ট নম্বর জমা না পড়লে প্রজেক্টে পাস না করলে বিষয়েও ফেল। এটা কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না।
এরপর মনে হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাতা কালেক্ট করতে হবে।
মনোজ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল 'তুমি কার সঙ্গে এত কথা বলছ গো?'
রেখা বলল 'আর কার সাথে কপাল চাপড়ে বলল 'কপালের সাথে।'
মনোজ হাসতে হাসতে বলল 'সেই কপালটা চাপড়ে কি বুঝতে পারলে তুমি?"
রেখা বলল 'এই যে ফোন করতে বসব এবার?'
মনোজ বলল 'কাদের ফোন করবে?'
রেখা বলল 'কাদের আবার, ছাত্রীদের।'
মনোজ বললো "ভালোই আছো?'
রেখা বলল' হ্যাঁ ভালোই তো আছি। সমাজের সব মানুষই তো এখন শুধু টিচারদের  দোষারোপ করে।টিচারদের কোন কাজ নেই ,টিচারদের স্কুল নেই। বাড়ি বসে বসে মাইনে আরো কত কিছু।
আমাদের যে কাজের পাহাড় কাকে বোঝাবো বলো?'
রেখা বলল 'এই শোনো তোমার নাস্তা খেয়ে নাও। আমি কিন্তু এখন ফোন করতে বসবো আমাকে ডিস্টার্ব করবে না।'
মনোজ বলল 'ওকে ম্যাডাম'।
রেখা বললো "ঠিকআছে। বসো দিচ্ছি খেতে।'
মনোজ বলল-'এই রেখা আজকের মেনু কি?'
রেখা বলল "বলা যাবে না । এটা সিক্রেট।'
মনোজ খাবার টেবিলে বসে ,রেখা খাবার প্লেটে খাবার বাড়ছে। তখনই গন্ধটা মনোজের নাকে আসলো।
মনোজ বলল "ঘ্রাণে অর্ধভোজন। ঠিক তুমি আমার স্পেশাল মেনু বানিয়েছ মেথিমালাই।'
রেখা বলল 'গন্ধ যখন পেয়ে গেছো ,তাহলে আর সিক্রেট কোথায় ?এই নাও খেয়ে নাও।প্লেটটা মনোজের সামনে রাখলো।
মনোজ বলল 'কতদিন যেন মনে হচ্ছে খাই নি।'
রেখা বললো 'ঠিক আছে নাও। এবার পেট ভরে খাও।'
মনোজ বলল 'এই তোমার খাবারটা নিয়েএসো তো কতদিন একসঙ্গে বসে খাই নি । '
রেখাকে হাত ধরে টেবিলে বসাল।'
রেখা বললো ' না ,এখন আমি খাবো না ।আমি কাজগুলো ততক্ষণ সেরে আসি।'
মনোজ বলল' তুমি না খেলে কিন্তু আমিও খাবো না।'
রেখা বলল  'ধেৎতেরি। মাঝে মাঝে এমন বায়না করো না, ভালো লাগে না।'
একটু বিরক্তি নিয়েই রান্নাঘরে গেল রেখা। তারপর রেখা নিজের খাবারটা নিয়ে চলে আসলে ,প্লেটটা নিয়ে বললো' নাও  শান্তি ,এবার খাও।'
মনোজ বলল" রাগ করছো রেখা ।দুজনে একসাথে আমরা কত গল্প করতাম আর খেতাম। শুধু তোমার আমার একান্ত মনোভূমি ছিল।'
রেখা বলল ' না গো রাগ করি নি।  একটা চাপ রয়েছে না মাথায় ?খাতাগুলো যদি না পাই ,কি করে কি করবো সেটাই ভাবছি।'
খেতে খেতেই রেখার আবার ফোন বেজে উঠলো 'ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা.।
রেখা বললো 'আবার কে ফোন করল ?কে জানে?'
মনোজ বললে'দেখ না ফোনটা কর?
 জরুরি কিছু হতে পারে।'
রেখা ফোনটা রিসিভ করে বলল 'হ্যালো'।
অপরিচিত ব্যক্তি বললেন' হ্যালো ম্যাম আমি সিঁড়ি পত্রিকার সম্পাদক বলছি।'
রেখা বলল 'বলুন?'
সম্পাদক বলেন নমস্কার ম্যাম।'
রেখা বলুন নমস্কার।
সম্পাদক বললেন' আপনার লেখা পাঠাচ্ছেন না তো?'
রেখা বলল 'আসলে লেখা হয়েছে সেটা পাঠানো হয়ে ওঠে নি ।আমি একটু অসুবিধার মধ্যে ছিলাম।'
সম্পাদক বললেন 'এবার পাঠিয়ে দিন ম্যাম? '
রেখা বলল 'হ্যাঁ দেব। আর বলল আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠিয়ে দিলেই হবে তো?'
সম্পাদক বললেন 'হ্যাঁ আমার ওই নম্বরেই পাঠাবেন।'
রেখা বলল 'ওকে।'
সম্পাদক বললেন' ধন্যবাদ ম্যাম।:
রেখা বলল'আজকে যতটা পারছি পাঠাচ্ছি।'
সম্পাদক বললেন ' ঠিক আছে।'
রেখা ভাবল 'এরমধ্যে আর লেখা হয়ে ওঠে নি, আগের লেখা কিছু আছে, সেগুলোই পাঠাতে হবে। এই জায়গাটাই রেখার একেবারে একান্ত মনোভূমি।
এই স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ জীবনে পৌঁছাতে পারলে প্রয়োজন হয় না বন্ধু বান্ধবীর। নিজেকে মেলে ধরার জায়গা। প্রাণের জায়গা ,খুশির জায়গা।

মন্তব্যসমূহ

সুন্দর ভিউজ নজর করুন

কবি সানি সরকারের কবিতা "দগ্ধ - মৃত - গাছ"

কবি আইরিন মনীষা এর কবিতা "বেদনার বালুচরে"

রীনা ঘোষ