০২ অক্টোবর ২০২১

রহমান মিজানুর এর প্রবন্ধ "বিশ্বাসের ভিত্তি বৈজ্ঞানি সত্যের চেয়েও দৃঢ়"




 বিশ্বাসের ভিত্তি বৈজ্ঞানি সত্যের চেয়েও দৃঢ়



বিজ্ঞান হলো পরীক্ষণের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণলদ্ধ জ্ঞান এবং যুক্তি প্রয়োগ করে গঠিত তত্ত্ব বা সূত্র। বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো সাধারণত চুড়ান্ত নয়, সময়ের সাথে সাথে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের প্রেক্ষিতে এগুলো পরিবর্তিত হয়ে থাকে। বিজ্ঞানের গবেষণা মূলত দৃশ্যমান বা আপাত অদৃশ্য পদার্থসমূহ এবং শনাক্তযোগ্য শক্তির উপস্থিতির উপর। 
এই বিশ্বজগতে পদার্থ এবং শক্তি ছাড়াও আরও অসংখ্য  জিনিস রয়েছে, যেগুলো বিজ্ঞানের আওতাধীন বিষয়  নয়। বিজ্ঞান সেগুলো নিয়ে মাথাও ঘামায় না। যেমন, নীতি নৈতিকতা, ধর্মবিশ্বাস, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, আইন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, কৃষ্টি ইত্যাদি।
এছাড়া আরও কিছু জিনিস রয়েছে, যার ব্যাখ্যা দেওয়া এখনও বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেমন, প্রাণ, আবেগ, সুখ দুঃখবোধ, চিন্তাশক্তি ইত্যাদি। 
বিজ্ঞান প্রধানত দু'টি প্রশ্নের জবাব নিরন্তর খুঁজে যাচ্ছে, 'কি' এবং 'কিভাবে'। প্রাপ্ত জবাবকে বিশ্লেষণ করে তৈরি করছে তত্ত্ব। এক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে ভিত্তি ধরে আরও আরও তত্ত্ব দাঁড় করাচ্ছে। 
'কেন'; এই প্রশ্নের জবাব নিয়ে বিজ্ঞান ভাবে না।
যেমন পানি ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সবচেয়ে ভারী। কারন এই তাপমাত্রায় পরমাণুগুলো পরষ্পর ১২০° কোণে অবস্থান নেয়। এইটুকু বিজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, ৪° সেলসিয়াসে কেন সবচে ভারী হবে? কেন ৪ ডিগ্রিতেই পরমাণুগুলো ১২০° কোণে অবস্থান নেবে? যেখানে সহজাত তত্ত্ব হচ্ছে, একই অবস্থায় পদার্থের তাপমাত্রা যতো কমবে, ঘনত্ব ততোই বাড়তে থাকবে! বিজ্ঞান কিন্তু এই 'কেন'র জবাব দেবে না। 
আবার নীতি- নৈতিকতাও বিজ্ঞানের ভাবনার বিষয় নয়। হিরোশিমা নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা, পরিবেশ প্রকৃতি, অজস্র স্থাপনা মুহূর্তে ধ্বংস করে দেয়াকে বিজ্ঞানের সাফল্য হিসাবেই দেখা হয়। কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নে? সে প্রশ্ন বিজ্ঞানকে করা অবান্তর, কারন এই বিষয়টি বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত নয়।
বিজ্ঞান কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি করে না, অর্থাৎ সে কোনকিছুর স্রষ্টা নয়। অস্তিত্ব আছে এমন কিছুর উপর তত্ব প্রয়োগ করে অন্য কিছুতে (বস্তু বা শক্তিতে) রূপান্তর ঘটায় মাত্র। ধরা যাক বিদ্যুতের কথা। বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য চুম্বক, চৌম্বকীয় পদার্থ, পরিবাহী, অপরিবাহী ইত্যাদি প্রতিটি জিনিসই পূর্বে থেকে পৃথীবিতে মজুদ ছিলো। সেগুলোকেই ঘষেমেজে, তত্ত্ব অনুযায়ী আকার দিয়ে তার উপর যান্ত্রিক বল (mechanical force) প্রয়োগ করে কিংবা বিভিন্ন কেমিক্যালের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। 
এই পৃথিবীতে কিংবা মহাবিশ্বে বিদ্যমান মহাকর্ষ বল, মহাজাগতিক চৌম্বক ক্ষেত্র, গ্রহ নক্ষত্রের ঘূর্ণন বল, কল্পনাতীত বিশাল নক্ষত্র গ্রহের সমন্বয়ে গঠিত জগৎ,  এর কোনকিছুই বিজ্ঞান তৈরি করেনি, অন্তত মানুষের বিজ্ঞান তো নয়ই। তৈরি করার ধারনা কল্পনাতীত, এর কোটি কোটি ভাগের এক ভাগ ব্যাখ্যা করাও বিজ্ঞানের পক্ষে আজও পর্যন্ত অসম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের উপর আস্থা রেখে মুক্ত জ্ঞান সমূদ্রে অবগাহন করার দাবী নেহায়েতই বালখিল্যতা নয়? 

#বিশ্বাস
সাধারণভাবে, কোন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে তাকে সত্য/মিথ্যার নিরিখে যাচাই করার পর যদি 'মন' তাকে সত্য এবং সঠিক বলে গন্য করে, তার উপর আস্থা রাখে। তাহলে মনের এই রায়টিই হলো 'বিশ্বাস'। 

বিশ্বাস মানে আস্থা (faith) এবং ভরসা (trust)। সত্য মিথ্যা বিচার করে, রায় সত্যের দিকে গেলে তা বিশ্বাস, আর মিথ্যার দিকে গেলে অবিশ্বাস। এর মধ্যে আবার থাকতে পারে সত্য মিথ্যার দোলাচল। মিথ্যার সম্ভাবনা বেশি মনে হলে বিশ্বাস স্থির থাকবে না, উদ্ভব হবে সন্দেহের । বিশ্বাস এবং সন্দেহ পরষ্পর উল্টানুপাতিক। বিশ্বাস যত বাড়ে, সন্দেহ তত কমে বা ভাইস ভার্সা। 

কোনো তথ্য (information) বোধগম্য হওয়া এবং তাকে বিভিন্নভাবে যাচাই করার পর, সেই বোধকে সত্য বলে স্থায়ী ধারণা হলে তাকে জ্ঞান (knowledge) বলা যায়। সার্বিক জ্ঞান হচ্ছে পূর্বলব্ধ তথ্য এবং অভিজ্ঞতার সমষ্টি।  পর্যবেক্ষণের সাথে সাথে যুগপৎ যুক্তির সাহায্যে বিচার (judge) করে কোন বিষয় সত্য বলে সিদ্ধান্ত নিলে তা থেকে নতুন জ্ঞান জন্মায়। এইভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধ সত্যগুলিকে জুড়ে যে তত্ত্বের জাল বোনা হয়, তাদের বিষয়বস্তুগুলি সামগ্রিকভাবে হলো জ্ঞান। আর তাদের গ্রহণযোগ্যতার সচেতন অনুমোদনই বিশ্বাস। 

জ্ঞানের বিশেষত্ব হলো, কেবলমাত্র পূর্বের অভিজ্ঞতাই নয়, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কিংবা অজ্ঞাত পরিস্থিতি সম্পর্কেও এর সাহায্যে অনুমান করা সম্ভব। সেই অনুমানের সাফল্য বিশ্বাসকে জিইয়ে রাখে। জ্ঞানের গভীরতা, ব্যপ্তি ও বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তাকে প্রয়োগ করে ভালো ফল লাভের উপর নির্ভর করে জ্ঞান ক্ষেত্রবিশেষে বিচক্ষণতা, প্রজ্ঞা (wisdom) বা দূরদৃষ্টি (insight) ইত্যাদি হিসাবে পরিগণিত হতে পারে।

1 টি মন্তব্য:

  1. বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফল স্বরূপ আগত প্রযুক্তির প্রভাব ব্যাতিরেখে শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এক মুহূর্ত কাটানোর চেষ্টা করে দেখুন, সুস্থ মানুষের মতো বাঁচতে পারেন কিনা। তারপরে নাহয় আজগুবি সব বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবেন। 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু  তর্কে বহুদূর' এই আপ্তবাক্যটির বহুদিন হলো অপমৃত্যু  ঘটেছে।
    তাছাড়া বিজ্ঞানের সাথে নীতিবোধের কোনো সংঘর্ষ নেই। কোনো সুচিন্তক ও সুদার্শনিকই কখনও বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেননি। দুই বড় বাঙালি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল এর দর্শন যদি বোঝার চেষ্টা করেন তো সেটা স্পষ্ট ভাবে অনুভব করতে পারবেন।
    যাইহোক, এক বিজ্ঞানভাবনায় ভাবিত এক সাধারণ মানুষের মানবিক শ্রদ্ধা নেবেন।

    উত্তরমুছুন

thank you so much